শ্রীনগর, 18 নভেম্বর: নভেম্বর শেষ হওয়ার পথে তাপমাত্রা একটু একটু করে নামছে গোটা দেশে । কিন্তু ভুয়ো এনকাউন্টারের অভিযোগ ঘিরে উপত্যকায় বিক্ষোভের উত্তাপ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী । হাড় কাঁপানো ঠান্ডাকে উপেক্ষা করেই সেখানে প্রতিবাদে শামিল সাধারণ মানুষ । তাতে হায়দরপোরা-কাণ্ডে এবার ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দিতে বাধ্য হলেন জম্মু-কাশ্মীরের লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহা । দোষীদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করার আশ্বাস দিলেন তিনি ।
সোমবার হায়দরাপোরার ঘটনায় ইতিমধ্যেই কাশ্মীর পুলিশ তথা কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে সব মহল থেকে । এমন পরিস্থিতিতে লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজের দফতর থেকে টুইট করা হয়, ‘হায়দরপোরা এনকাউন্টার-কাণ্ডে অ্যাডমিরাল পদমর্যাদার অফিসারকে দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে । নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিপোর্ট জমা পড়বে, তার ভিত্তিতে সরকার দোষীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করবে । জম্মু-কাশ্মীর প্রশাসন উপত্যকার মানুষের নিরাপত্তায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ । কোনওরকম অবিচার বরদাস্ত করা হবে না ।’
উপত্যকার ডিজিপি দিলবাগ সিংও নিরপেক্ষ তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন । তিনি বলেন, ‘‘নিহতদের পরিবারের দাবি খতিয়ে দেখছি আমরা । যদি কিছু ভল হয়ে থাকে, তা শুধরে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত আমরা । পুলিশও তদন্ত করছে । কী নিয়ে অভিযোগ, তা খতিয়ে দেখছি আমরা । হায়দরপোরা এনকাউন্টারে ঠিক কী হয়েছিল, দেখা হচ্ছে । মানুষের নিরাপত্তায় আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ । তদন্তে কোনও ঢিলেমি করা হবে না ।’’
আরও পড়ুন:Mahua Moitra : কেন্দ্রীয় এজেন্সি প্রধানদের মেয়াদ বাড়ানোর বিরোধিতায় মহুয়া, পিটিশন সুপ্রিম কোর্টে
গত সোমবার হায়দরাপোরায় উপত্যকার পুলিশের গুলিতে চারজনের মৃত্যু হয় । পুলিশ জানায়, মৃতদের মধ্যে দুই পাকিস্তানি জঙ্গি রয়েছে । বাকি দু’জনের নাম মহম্মদ আলতাফ ভাট এবং মুদাসির গুল ৷ শুরুতে পুলিশ দাবি করে, জঙ্গিদের গুলিতেই মৃত্যু হয়েছে আলতাফ এবং মুদাসিরের ৷ পরে দাবি করা হয়, জঙ্গিদের সঙ্গে পুলিশের গুলি বিনিময় চলাকালীন মাঝে পড়ে মৃত্যু হয়েছে দু’জনের ৷
তারপরে ফের বয়ান বদল করে আলতাফ এবং মুদাসিরকে জঙ্গিদের সহযোগী বলে দাবি করে উপত্যকার পুলিশ ৷ বলা হয়, আলতাফের বাড়িতেই জঙ্গিরা লুকিয়েছিল এবং সেখান থেকেই পুলিশকে লক্ষ্য করে তারা গুলি চালাতে শুরু করে ৷ অন্যদিকে, মুদাসির জঙ্গিদের নাশকতামূলক কাজকর্মে সাহায্য করতেন বলে পুলিশের দাবি ৷
মৃতদের কাছ থেকে নাশকতামূলক পরিকল্পনার নথি, 2টি পিস্তল, 3টি ম্যাগাজিন, 6টি মোবাইল, ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রোটোকল প্রযুক্তি-সহ 6টি কম্পিউটার, আলফা, বিটা, গামা কোড, আমেরিকার একটি মানচিত্রও উদ্ধার হয় বলেও জানায় পুলিশ ৷ কিন্তু পুলিশের দাবি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয়রা ৷ তাঁদের অভিযোগ, যে দু’জনকে জঙ্গিদের আশ্রয়দাতা বলে প্রতিপন্ন করতে চাইছে পুলিশ, তাঁরা স্থানীয় বাসিন্দা ৷ কোনও প্রমাণ ছাড়া বাড়ি থেকে আচমকা তাঁদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ৷ তার পর মেরে ফেলা হয় ভুয়ো এনকাউন্টারে ৷
নিহত মুদাসির পেশায় দন্ত চিকিৎসক ছিলেন ৷ তাঁর স্ত্রী হুমেইরা দু’বছরের মেয়েকে কোলে নিয়ে রাস্তায় প্রতিবাদে নেমেছেন ৷ তাঁর স্বামী জঙ্গিদের সাহায্য করতেন, পুলিশকে এর প্রমাণ পেশ করতে হবে বলে দাবি তুলেছেন তিনি ৷ তিনি বলেন, ‘‘সৎ পথে রোজগার করে সংসার চালাতেন আমার স্বামী ৷ যে পুলিশ তাঁকে হত্যা করল, কয়েক দিন আগে রাওয়ালপোরায় একটি বিয়েবাড়িতে, তারাই স্বামীর সঙ্গে গল্পগুজব এবং একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করছিল ৷’’
আরও পড়ুন:Cryptocurrency : ক্রিপ্টোকারেন্সির অপব্যবহার বন্ধ নিশ্চিত করতে হবে, বিশ্বকে বার্তা প্রধানমন্ত্রীর
আলতাফ পেশায় ব্যবসায়ী ছিলেন ৷ তাঁর 13 বছরের কন্যা জানায়, আচমকা বাড়ি থেকে তার বাবাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ৷ পরে সে জানতে পারে যে,মারা গিয়েছে ৷ মেয়েটি জানিয়েছে, বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে পুলিশের কাছে ছুটে যায় সে ৷ জানতে চায়, কেন মেরে ফেলা হল বাবাকে ৷ কিন্তু তাঁকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে সকলে হাসতে থাকে ৷
শুধু তাই নয়, যে দু’জনকে পুলিশ পাকিস্তানি জঙ্গি বলে দাবি করছে, তাঁদের মধ্যে একজনকে আমির মাগরে বলে শনাক্ত করা গিয়েছে ৷ পুলিশে তাঁকে জঙ্গি বলে চিহ্নিত করলেও, স্থানীয়দের দাবি, মুদাসিরের ক্লিনিকে সহযোগীর কাজ করতেন আমির ৷ তাঁর বাবা আবদুল লতিফ মাগরের দাবি, ঠান্ডা মাথায় তাঁর ছেলেকে খুন করা হয়েছে ৷
আবদুল মাগরে নিজেই উপত্যকায় নাশকতা বিরোধী হিসেবে পরিচিত ৷ 2005 সালে পাথর দিয়ে এক জঙ্গিকে মেরে ফেলেছিলেন তিনি ৷ তার জন্য সেনাবাহিনীর তরফে তাঁকে সম্মানিতও করা হয়েছিল ৷ জঙ্গিদের হাত থেকে বাঁচতে সারা জীবন ছেলেমেয়েকে লোকচক্ষুর আড়ালে সরিয়ে রাখতেন তিনি ৷ কিন্তু ভুয়ো এনকাউন্টারে ছেলেকে মেরে ফেলার পর এখন ছেলের দেহও পুলিশ ফেরত দিচ্ছে না বলে অভিযোগ আবদুলের ৷ তাঁর কথায়, ‘‘আমার ছেলের দেহ পর্যন্ত ফেরত দেওয়া হচ্ছে না ৷ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এই কি পুরস্কার ! আজও আমার বাড়িতে পাহারা দেয় সেনা ৷ কাল তো তাহলে আমাকেও মেরে ফেলে জঙ্গি বলে দাগিয়ে দিতে পারে !’’
পুলিশ জানিয়েছে, কুপওয়াড়া জেলার হান্দোয়ারায় নিহতদের সমাধিস্থ করা হয়ে গিয়েছে । কিন্তু মৃতদের পরিবারের দাবি, অবিলম্বে সবক’টি দেহ ফেরত দিতে হবে তাদের । নইলে প্রতিবাদ চলবেই ।