পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / bharat

Mongoose Hunting for Paint Brush তুলির জোগানে বলি হাজার হাজার বেজি, নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য

আঁকার তুলি এবং মেকআপ ব্রাশ তৈরি করার জন্য ভারতে (India) প্রতি বছর 50 হাজার থেকে 1 লক্ষ বেজি শিকার করা হয় (Mongoose Hunting for Paint Brush) ৷ এর জেরে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য ৷ লিখেছেন ইটিভি ভারতের সুপর্ণা দাস ।

In India at least 50 thousand Mongoose Hunting for Paint Brush every year
Mongoose Hunting for Paint Brush তুলির জোগানে বলি হাজার হাজার বেজি

By

Published : Aug 29, 2022, 1:03 PM IST

Updated : Aug 29, 2022, 1:33 PM IST

কলকাতা, 29 অগস্ট :ধরা যাক, আপনি কোনও আর্ট এগজিবিশনে গিয়েছেন । একের পর এক ছবি দেখে বাক্যিহারা দশা ! ভাবছেন, একজন শিল্পী কীভাবে এমন অনায়াস তুলির টান রপ্ত করেন ! সত্যি বলতে কী, এই মুগ্ধতায় দোষের কিছু নেই । শিল্পীর মুন্সিয়ানাও অবশ্য প্রশংসনীয় । কিন্তু, কখনও ভেবে দেখেছেন কি, কোন তুলির টানে জীবন্ত হয়ে ওঠে রঙের আঁচড় ? কী তার রহস্য ? আপনি যদি ছবিপ্রেমী হন, তাহলে অবশ্যই এগুলো ভাবুন । কারণ, ভাবাটা ভীষণ দরকার । আপনার, আমার বেঁচে থাকার জন্যই এটা জরুরি ।

প্রত্যেক শিল্পীর নিজস্ব ধরন যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে নিজের পছন্দ । তাঁরা সকলে একইরকম তুলি দিয়ে কাজ করতে স্বচ্ছন্দ নন । তথ্য বলছে, শিল্পী মহলে এক বিশেষ ধরনের তুলির কদর বাদবাকিদের থেকে বেশি । কী এই তুলির বিশেষত্ব ? আজ হঠাৎ এ নিয়েই বা আলোচনার প্রয়োজন হয়ে পড়ল কেন ?

আরও পড়ুন :'মগজখেকো অ্য়ামিবা'র শিকার 36-এর যুবক ! প্রাণ গেল ইজরায়েলি নাগরিকের

বিষয়টি কিছুটা খোলসা হল অয়ন বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের কথায় । ছবি আঁকা এবং মূর্তি তৈরি তাঁর পেশা । একইসঙ্গে, বন্যাপ্রাণ সংক্রান্ত বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতাও রয়েছে । তিনি জানালেন, তুলির মান যত উন্নত হবে, শিল্পীর পক্ষেও সেই তুলির ততটাই সাবলীল ব্যবহার সম্ভব হবে । একটা সময় এইসব ক্ষেত্রে শুধুমাত্র বিশেষ কয়েক ধরনের বন্যপ্রাণীর শরীরের লোম ব্যবহার করা হত । কিন্তু, বর্তমানে ভারতের অধিকাংশ বন্যপ্রাণীই সংরক্ষণের আওতাভুক্ত । তাদের শিকার বেআইনি । ফলত, আঁকার কাজে ব্যবহারের যোগ্য তুলি তৈরি করতে এখন সিন্থেটিক বিভিন্ন সামগ্রীর উপরেই ভরসা করতে হয় । তবে, সেইসব তুলির কাজ প্রাকৃতিক তুলির (প্রাণীর লোম থেকে তৈরি) মতো সূক্ষ হয় না । তাহলে কি, ভালো কাজ করার তাগিদে আজও এই ধরনের প্রাকৃতিক তুলি ব্যবহার করছেন শিল্পীরা ? আর সেইসব তুলির ছোঁয়াতেই প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে কাগজে আঁকা অবয়ব ? না । এই প্রশ্নের উত্তর আমরা অয়নের কাছে পাইনি । তিনি জানিয়েছেন, তিনি নিজে সবসময় সিন্থেটিক তুলিতেই কাজ করেন । অন্য কেউ এই তুলি ব্যবহার করেন কিনা, সেটাও তাঁর জানা নেই । তিনি শুধুমাত্র তুলির গুণাগুণ সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন । অগত্যা আমরা দ্বারস্থ হলাম এমন দু'জনের, যাঁদের এই সম্পর্কে সম্যক ধারণা রয়েছে । শিল্পের সঙ্গে তাঁদের কোনও প্রত্যক্ষ যোগাযোগ না থাকলেও শিল্পের আড়ালে বন্যপ্রাণ আইন ভাঙা হলে, তা নিয়ে তাঁদের মাথা ঘামাতে হয় বইকী !

এঁরা দুজনেই ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিস (Indian Forest Sevice) বা আইএফএস (IFS) অফিসার । একজনের নাম সন্তোষ জি আর এবং অন্যজন সাকেত বাডোলা । এঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে ইউরোপ এবং আমেরিকায় একটি বিশেষ ধরনের তুলির বিরাট বাজার রয়েছে । এটি হল, সেবল হেয়ার ব্রাশ (Sable Hair Brush) । অর্থাৎ সেবল নামক একটি প্রাণীর লোম থেকে তৈরি তুলি । তথ্য বলছে, সেবল নামক এই প্রাণীটি আমাদের দেশের বাসিন্দা নয় । তবে, ইউরোপ এবং এশিয়ার কিছু অংশের বনাঞ্চলে এদের দেখা পাওয়া যায় । এই সেবলদের লোম থেকে তৈরি তুলি নাকি সবথেকে উৎকৃষ্ট শ্রেণির ! সেবলকে দেখতে অনেকটা আমাদের অতি পরিচিত বেজির মতো । অথচ সেবল আদতে ভোঁদরর নিকট আত্মীয় । সেবল এবং ভোঁদর, দু'টোই আদতে মাস্টেলিডি পরিবারের (Mustelidae Family) অন্তর্ভুক্ত । শোনা যায়, তুলির চাহিদা মেটাতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সেবল চাষ করা হয় । পশুপ্রেমীরা এ নিয়ে অনেক প্রতিবাদ করলেও তাতে বিশেষ লাভ হয়নি ।

এখন ঘটনা হল, আমাদের দেশে সেবল পাওয়া যায় না । তাই তার বদলে শুয়োর, কাঠবেড়ালি এবং বেজির লোম ব্যবহার করে তুলি তৈরি করা হয় । এগুলির মধ্যে আবার বেজির লোমের তুলি হল সেরা মানের । অথচ বেজি শিকার এদেশে নিষিদ্ধ । কারণ, ছোট্ট, ছটফটে এই প্রাণীটি বন্যপ্রাণ আইন অনুসারে সংরক্ষণের (শিডিউল-২) আওতাভুক্ত । এই বিষয়টি শিল্পীদেরও অজানা নয় । সত্যি বলতে কী, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই আইন মেনে সিন্থেটিক তুলিতেই কাজ করেন । কিন্তু, ব্যতিক্রম এখানেও আছে । সন্তোষ এবং সাকেতের আক্ষেপ, সবকিছু জানার পরও কিছু শিল্পী আজও গোপনে বেজির লোমের তৈরি তুলি ব্যবহার করে চলেছেন । আর তাঁদের চাহিদা মেটাতেই প্রতিদিন ভারতের সর্বত্র গোপনে বেজি নিধন চলছে ।

সেবল নামক এই প্রাণীর লোম থেকে তৈরি হয় উৎকৃষ্টমানের তুলি ৷

ভারতে মূলত দুধরনের বেজির লোম দিয়ে তুলি তৈরি করা হয় । একটি হল, ইন্ডিয়ান গ্রে মঙ্গুস (Indian Grey Mongoose) এবং অন্যটি স্মল ইন্ডিয়ান মঙ্গুস (Small Indian Mongoose) । এদেশের সর্বত্রই এদের দেখা মেলে । আকারে ছোট হওয়ায় এক-একটি বেজির শরীর থেকে খুব বেশি হলেও 50 থেকে 60 গ্রাম লোম পাওয়া যায় । সুতরাং, বহু ক্ষেত্রে শুধুমাত্র একটি তুলি তৈরি করার জন্যই একাধিক বেজি মারতে হয় ! সাকেত জানালেন, শুধুমাত্র ছবি আঁকার জন্য নয় । রূপচর্চায় ব্যবহৃত, আরও স্পষ্ট করে বললে মেকআপের জন্য যেসব ব্রাশ বা তুলি ব্যবহার করা হয়, সেখানেও বেজির লোমের কদর সবথেকে বেশি ! বন্যপ্রাণ অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ব্যুরো (Wildlife Crime Control Bureau) বা ডাব্লিউসিসিবি (WCCB) সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রতি বছর ভারতে অন্তত 50 হাজার বেজি শিকার করা হয় (Mongoose Hunting for Paint Brush) ! কোনও কোনও বছর সংখ্য়াটা পৌঁছে যায় 1 লক্ষের কাছাকাছি ! আর এই কাজ করা হয় শুধুমাত্র চিত্রশিল্পী এবং মেকআপ আর্টিস্টদের একাংশের চাহিদা পূরণ করতে !

ইন্ডিয়ান গ্রে মঙ্গুস ৷

সাম্প্রতিককালে দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ-সহ ভারতের বিভিন্ন অংশে অভিযান চালিয়ে বেজির লোমের তৈরি তুলির বিরাট কনসাইনমেন্ট উদ্ধার করা হয়েছে । কখনও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে 50 হাজার তুলি, আবার কখনও মিলেছে 20 কেজি লোম ! সুতরাং, ভারতে যে কী হারে বেজি নিধন চলছে, তা এর থেকেই স্পষ্ট ।

সাকেত জানালেন, নিয়মিত অভিযান চললেও বেজি শিকার সম্পর্কে ভারতব্যাপী কোনও নির্দিষ্ট তথ্যাবলী নেই । আসলে যাঁরা বেজি শিকার করেন, তাঁরা সাধারণত বংশ পরম্পরায় এই কাজ করে আসছেন । কখনও তারের ফাঁদ পেতে, কখনও জাল বিছিয়ে বেজি ধরা হয় । তারপর প্রাণীগুলিকে মেরে লোম ছাড়িয়ে নেওয়া হয় । এভাবেই রোজ একটি-দু'টি করে বেজি মারেন শিকারিরা । অনেকটা পরিমাণে লোম জমে গেলে তা শিকারিদের কাছ থেকে কিনে নেন দালালরা । তারপর তা চালান হয়ে যায় তুলি তৈরির কারখানায় । উত্তরপ্রদেশের বিজনৌরে এমন অনেক কারখানা রয়েছে ।

পিছিয়ে নেই আমাদের রাজ্যও । দক্ষিণ 24 পরগনার বন বিভাগের দায়িত্বে থাকাকালীন সেই অভিজ্ঞতা হয়েছিল সন্তোষের । আমাদের কলকাতার কাছেই বেহালা, ফলতা এবং ভাঙড়ে এমন বহু মানুষ আছেন, যাঁরা বেজি শিকার এবং তার লোম থেকে তুলি তৈরির কাজ করেন । এই বেআইনি কারবার ঠেকাতে ধরপাকড় কম হয়নি । কিন্তু, লাভ খুব বেশি হয়েছে বলে মনে করেন না বনাধিকারিকরা । আর এখানেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন পরিবেশপ্রেমী ও পশুপ্রেমীরা । তাঁরা বলছেন, এই প্রবণতা মারাত্মক । বাঘ, হাতি বা গন্ডারের মতো বিরাট জন্তুদের নিয়ে মানুষ যতটা সচেতন, বেজির মতো ছোট্ট প্রাণীর ক্ষেত্রে তেমনটা নয় । অথচ, বেজির বংশ ধ্বংস হলে তার প্রভাব হবে মারাত্মক । বস্তুত, আমাদের চারপাশের পরিবেশের ভারসাম্যটাই নষ্ট হয়ে যাবে ।

স্মল ইন্ডিয়ান মঙ্গুস ৷

ভয়ের কারণ আরও আছে । অতিমারি কী ভয়ঙ্কর জিনিস, করোনার দৌলতে আজ তা আমাদের সকলেরই জানা । মানবদেহে করোনার সংক্রমণের সূচনা নিয়ে এখনও অনেক বিতর্ক রয়েছে । তবে, বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, বাদুড় বা ওই জাতীয় কোনও প্রাণীর মাংস থেকেই এই বিভীষিকার সূত্রপাত । চিন্তার কথা হল, লোমের লোভে বেজি শিকারের পর অধিকাংশ শিকারিই তার মাংসটা ফেলে দেন । কেউ কেউ সেই মাংস খান বলেও শোনা গিয়েছে । তবে, প্রকাশ্যে এ নিয়ে কেউই মুখ খোলেন না । কিন্তু, এই তথ্য সঠিক হলে আগামী দিনে আমরা যে নতুন কোনও প্রাণঘাতী ভাইরাসের কবলে পড়ব না, তেমন গ্যারান্টি কিন্তু কেউ দিচ্ছেন না ।

তবে, আশার কথা হল, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকস্তরে শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে । তাঁদের বোঝানো হচ্ছে, পরিবেশের স্বার্থে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে, তাঁরা যেন বেজির লোমের তুলি ব্যবহার না করেন । ইতিমধ্যে তার সুফলও মিলতে শুরু করেছে । কিন্তু, তারপরও ভারত তথা বিদেশের বাজারে ভারতীয় বেজির লোম দিয়ে তৈরি তুলির চাহিদা সমূলে মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি ।

Last Updated : Aug 29, 2022, 1:33 PM IST

ABOUT THE AUTHOR

...view details