হায়দরাবাদ, 28 সেপ্টেম্বর: ক্রিকেটে একটা কথার চল আছে, ‘ইউ মিস আই হিট’ । মানে ব্যাট বলকে স্পর্শ করতে না-পারলে বল কিন্তু উইকেটে গিয়ে লাগবে । রাজনৈতিক পরিসরে ক্ষমতায় আসা এবং ক্ষমতা ধরে রাখার ব্যাপারটাও খানিকটা এরকম । সদাসতর্ক না-থাকলেই বিপদ । পুজোর মুখে রাজ্য-রাজনীতি নতুন করে উত্তাল নজরদারির অভিযোগকে ঘিরে । রাজভবনে নাকি রাজ্য পুলিশ নজরদারি চালাচ্ছে । সাংবিধানিক প্রধানের কার্যালয় থেকে এমন বক্তব্য আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি । তবে রাজনৈতিক মহলে এ নিয়ে চর্চার অন্ত নেই । বিজেপির মতো বিরোধী দল তৃণমূলকে কটাক্ষ করতে ছাড়েনি । আবার শাসক শিবির মনে করছে, রাজভবন অকারণে ভীত হয়েছে । এই তরজার মধ্যেই রাজনৈতিক মহলে তাজা হয়ে উঠেছে কিছু স্মৃতি । নজরদারি এবং গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ্য প্রভাবে রাষ্ট্রনেতাদের পদত্যাগ পর্যন্ত করতে হয়েছে অতীতে ।
গান্ধিদের বাড়িতে ওরা কারা ?
আটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে জাতীয় রাজনীতিতে বেশ কিছুটা অস্থিরতার জন্ম হয় । মেয়াদ শেষের আগে সরকার পড়ে যায় । প্রধানমন্ত্রীদের পদ ছাড়তে হয় । মাত্র কয়েকমাসের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন চন্দ্রশেখর । ‘বালিয়ার বাবুসাহেব’ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে এবং পরে অন্য কোনও মন্ত্রিত্ব করেননি । রাজীব গান্ধির নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস বাইরে থেকে চন্দ্রশেখরের সরকারকে সমর্থন করে । কিন্তু সেই জোট কোনও পক্ষের জন্যই সুখের হয়নি বলে মনে করে রাজনৈতিক মহল । একসময় কংগ্রেস ছেড়ে জনতা দলে যাওয়া সমাজবাদী মননের চন্দ্রশেখর সরকার টিকিয়ে রাখতে পুরোপুরি নির্ভর করতেন কংগ্রেসের উপর । শতাব্দী প্রাচীন রাজনৈতিক দলটি নাকি তাঁকে প্রভাবিত করতে চাইত সব ব্যাপারেই । স্পষ্টবক্তা চন্দ্রশেখরের পক্ষে এ জিনিস হজম করা বেজায় কঠিন ছিল ।
এমনই আবহে কংগ্রেসের তরফ থেকে আসে এক বিস্ফোরক অভিযোগ । অভিযোগ ওঠে, গান্ধি পরিবারের বাড়িতে নাকি উকিঝুঁকি দিতে দেখা গিয়েছে হরিয়ানা পুলিশের দুই আধিকারিককে । কংগ্রেস মনে করে, প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠরা গান্ধিদের গতিবিধি আগাম বুঝে নেওয়ার জন্য এমন কাজ করেছেন । কানে টান পড়লে মাথার আর করার কী থাকে ? ক্ষমতার অলিন্দে ঘুরতে থাকে একটি সম্ভাবনা । আশঙ্কা বললেই ঠিক বলা হবে । সেটা এই যে, নেতার বাড়িতে এই ধরনের নজরদারি কংগ্রেস বরদাস্ত করবে না । সরকার থেকে সমর্থন তুলে নেবে । এখানেও দলের তরফে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই বলা হয়নি । তবে চন্দ্রশেখর বুঝেছিলেন এভাবে সরকার চালাতে পারবেন না । আর তাই পদ ছেড়ে দেন ।
সময়কাল খুব অল্প হলেও চন্দ্রশেখর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেশ কিছু মনে রাখার মতো কাজ করেছিলেন । সে সময় দেশের আর্থিক পরিস্থিতি মোটেই সন্তোষজনক ছিল না । বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার তলনাতি এসে ঠেকেছিল । এমন অবস্থায় বিশ্বব্যাংকে দেশের সোনা বন্দক রাখার সিদ্ধান্ত নেন চন্দ্রশেখর । রিজার্ভ ব্যাংকের সংগ্রহে থাকা সোনা গচ্ছিত রেখে মোটা অঙ্কের ঋণ নেওয়া হয় । পাশাপাশি দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে টিএন সেশনকে নিয়োগও করা হয়েছিল চন্দ্রশেখরের সময়ে । দেশের নির্বাচনের ইতিহাস বদলে দিয়েছিলেন সেশন । ভোটার কার্ড দিয়ে ভোট করানোর ভাবনাও তাঁর । রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ভয়ের অন্য নাম হয়ে উঠেছিলেন তিনি । সেশন নিজেই বলতেন, ‘‘আই ইট পলিটিশিয়ানস ফর ব্রেকফাস্ট’’ ।
রিচার্ড নিক্সন ও ওয়াটার গেট:
আমেরিকার রাষ্ট্রপতিদের কাজকর্মের প্রভাব অনেক সময় মার্কিন মুলুক ছেড়ে অন্যত্রও প্রবলভাবে পড়ে । রিচার্ড নিক্সনও ব্যতিক্রম নন । আমেরিকার ইতিহাসে নিক্সনই একমাত্র রাষ্ট্রপতি যিনি পদত্যাগ করেছিলেন । করতে বাধ্য হয়েছিলেন বললেই ঠিক হবে । পদত্যাগের নেপথ্যেও ছিল এরকমই এক নজরদারির অভিযোগ । সাতের দশক আমেরিকার রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন এনেছিল । শুধু রাজনীতিতে নয়, এই দশকের কয়েকটি ঘটনা দেশের আইন ব্যবস্থাকেও প্রভাবিত করেছিল । সুপ্রিম কোর্ট যে আদতেই সুপ্রিম মানে সর্বশক্তিমান সে কথাও প্রমাণিত হয়েছিল এই দশকে ।
আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কতগুলি বিশেষ নিয়ম আছে । তারমধ্যে একটি হল নির্বাচনের দিন। আমেরিকার প্রথম নাগরিককে বেছে নেওয়ার ভোট হয় নভেম্বরের প্রখম মঙ্গলবার । 1972 সালে আমেরিকায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয় । তার আগে 17 জুন ঘটে যায় এক ভয়াবহ ঘটনা। আমেরিকার দু’টি দল- ডেমোক্র্যাট আর রিপাবলিকান । নিক্সন রিপাবলিকান পার্টির নেতা হিসেবে ভোটে জিতে দেশ পরিচালনা করছেন । তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে গুপ্তচর পাঠানোর ।
সেই ঘটনাই ঘটেছিল 17 জুন । ডেমোক্র্যাটদের কার্যালয়ে ঢুকে পড়ে পাঁচজন । তাদের কাজ ছিল মূলত দু’টো ৷ এক, কয়েকটি বাছাই করা নথি নিয়ে আসতে হবে । দুই, দফতরের ফোনে রেকর্ডিং ডিভাইস বসিয়ে দিয়ে আসতে হবে । সেখান থেকে ফোন কে কাকে কী বলছে সেটা জানতেই এমন ব্যবস্থা । তবে শেষরক্ষা হল না কিছুতেই । দফতরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক রক্ষী সময় থাকতে থাকতেই পুলিশকে খবর দিয়ে দিলেন । পুলিশ এল । একে একে পাঁচজনকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল । ওয়াশিংটনের ওয়াটারগেট ভবনে এই কার্যালয়টি অবস্থিত বলে এটি ওয়াটারগেট স্ক্যান্ডেল নামে পরিচিত ।
আরও পড়ুন: রাজভবনের পুলিশি নজরদারির অভিযোগ, কী বলছে রাজনৈতিক মহল ?
প্রথম দিকে সকলেরই মনে হয়েছিল এটা সাধারণ চুরির ঘটনা । তবে তদন্ত খানিক এগোতেই বোঝা যায় সাধারণ চুরির নেপথ্যে আছে অসাধারণ কিছু ঘটনা । ওয়াশিংটন পোস্টের দুই সাংবাদিক কার্ল বার্নস্টাইন এবং বব উডওর্য়াড দীর্ঘ সময় ধরে অনুসন্ধান চালাতে থাকেন । এফবিআই’ও আসরে নামে । এর মধ্যে অবশ্য আবারও নির্বাচনে জিতে গিয়েছেন নিক্সন । পরের বছরের গোড়ার দিকে কয়েকটি সূত্র দাবি করে, এই পাঁচজনেকে ওয়াটারগেট বিল্ডিংয়ে পাঠিয়েছিল হোয়াইট হাউজ । প্রথম দিকে অভিযোগ মানতে চায়নি নিক্সন প্রশাসন । পরে ওয়াশিংটন পোস্টে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে থাকে । তা থেকে এই কাণ্ডের সঙ্গে নিক্সন এবং তাঁর প্রশাসনের বহু কেষ্টবিষ্টুর নাম জড়াতে থাকে।
আরও পরে মামলা যায় সুপ্রিম কোর্টে । দাবি ওঠে, গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ’কে ব্যবহার করে এফবিআইয়ের তদন্তকে প্রভাবিত করা হচ্ছে । আরও দাবি ওঠে, সিআইএ’কে কাজে লাগানোর প্রমাণ হিসেবে বেশ কিছু অডিও ক্যাসেটও আছে । সেগুলি আপাতত নিক্সন প্রশাসন প্রকাশ্যে আনছে না । সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে শেষমেশ কয়েকটি অডিয়ো রেকর্ডিং দিনের আলো দেখে । তা থেকে ঘটনার সঙ্গে নিক্সনের যোগ থাকার বড় ইঙ্গিত মিলেছিল । এরপর সক্রিয় হয় মার্কিন কংগ্রেস । রাষ্ট্রপতিকে গদিচ্যুত করতে ইমপিচমেন্ট আনার প্রক্রিয়া শুরু হয় । মার্কিন সংসদের এই সংক্রান্ত কমিটি ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়া শুরু করার সবুজ সংকেতও দিয়ে দেয় । বিপদ বুঝে পদ ছেড়ে দেন নিক্সন । সমাপ্তি হয় ওয়াটার গেট কাণ্ডের ।