নয়াদিল্লি, 30 ডিসেম্বর: সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি সঞ্জয় কিষান কৌল ইটিভি ভারত-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে কাশ্মীরী পণ্ডিতদের উপত্যকা ছেড়ে চলে আসা নিয়ে জানিয়েছেন যে কোনও অপরাধমূলক প্রভাব না থাকলেও এই ঘটনায় ভুল হয়েছে, তা স্বীকার করা উচিত ৷ তাহলে যাঁরা এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন, তাঁদের অন্তত কিছু স্বান্তনা দেওয়া যাবে ৷
বিচারপতি কৌল জানিয়েছেন যে তিনি বিশ্বাস করেন যে সেখানে পুনর্মিলনের একটি পথ রয়েছে ও কাশ্মীরের লোকেদের তাঁদের শিকড়ে ফিরে যাওয়ার জন্য একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে । কাশ্মীরে যাঁদের সংখ্যা বেশি, তাঁদের উচিত যাঁরা সংখ্যায় কম, তাঁদের আপন করে নেওয়া ৷
এছাড়াও তিনি একাধিক বিষয় নিয়ে মন্তব্য করেছেন ৷ সেগুলিই তুলে ধরা হল এখানে -
প্রশ্ন: আপনি জানিয়েছেন যে কাশ্মীরে আপনার পুড়ে যাওয়া বাড়িটি তিনি নতুন করে তৈরি করবেন ৷ এই বিষয়ে কি বিস্তারিত বলবেন ?
উত্তর: আমরা সমস্যার শুরুতে দু’টি কটেজ হারিয়েছিলাম (কাশ্মীরি পণ্ডিতদের কাশ্মীর ছাড়ার) ৷ কিছু বিদ্রোহী সেখানে লুকিয়ে ছিল এবং যখন পুলিশ সেখানে যায়, তারা এটি (বাড়ি) জ্বালিয়ে দেয় । 2005 সালে যখন সবকিছু কমবেশি শেষ হয়ে গিয়েছিল, তখন একটি... ৷ আমি মনে করি না যে এটা বিদ্রোহীদের কারণে হয়েছে ৷ সরকার এটা অধিগ্রহণ করতে ইচ্ছুক ছিল এবং কিছু স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিও এতে আগ্রহী ছিলেন ৷ কিন্তু আমরা বাধা দিই । আমার মনে হয় যে বোঝানোর চেষ্টা হয়েছিল যে আর ফিরে আসবেন না... । আমরা হসপিটালিটি সেক্টরের জন্য বাড়িটি নতুনভাবে তৈরি করে দিয়েছি ৷ আমি 34 বছর পর ওই বাড়িতে থেকেছি । বাড়িতে দুই সপ্তাহ থেকেছি । আমি মনে করি কয়েক বছরে (কাশ্মীরে) অনেক উন্নতি হয়েছে ৷ সকলে বুঝতে পেরেছে যে যা হয়েছে তা কাটিয়ে উঠে সকলকে একসঙ্গে নিয়ে পথ চলাই বাস্তববাদ ৷
প্রশ্ন: ধারা 370 নিয়ে রায় লেখার সময় কি আপনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন ?
উত্তর: একজন বিচারপতি হিসাবে আপনি এই ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য প্রশিক্ষিত ৷ এই বিষয়টি আমার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল ৷ তবে আমার চিন্তাভাবনার প্রক্রিয়ায় আইনি দিকগুলি কখনোই আমার মনের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল না । আমি কাশ্মীরের ইতিহাস সম্পর্কে আমার জ্ঞান ব্যবহার করেই এই রায় দিয়েছি ৷ আমি যা লিখেছিলাম, সেখানে উপসংহার খুব আবেগপ্রবণ ছিল ৷ বছর দুয়েক আগে যখন শুনানি শুরু হয়, সেই সময় থেকেই আমার মনে হয়েছিল যে আমাদের অবশ্যই এগিয়ে যেতে হবে । 1947-এর পরের মতো ওই সময়ও লোকেরা আরও ক্ষুব্ধ ছিল এবং কিছু ঘটনা ঘটেছিল ৷ কিন্তু সভ্যতা তো এগিয়ে গিয়েছে । সভ্যতাকে এগিয়ে যেতে হবে, অন্যথায় যা ঘটেছে, তা সেখানেই থেকে যাবে ৷ যা ঘটেছে, সেটাকে মেনে নিলে, সেটাই আসল নিরাময়ের প্রক্রিয়া হবে ৷ তারা যেমন বলে যে এতে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য 30 বছরের প্রমাণ নাও থাকতে পারে ৷ কিন্তু অপরাধমূলক প্রভাব ছাড়াই ঘটেছে এমন ভুলকে মেনে নেওয়া সেই ব্যক্তিদের স্বান্তনা দেবে, যাঁরা এই পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন ৷
প্রশ্ন: অনেক বছর কেটে যাওয়ার পর কি আর নিরাময় সম্ভব ? আপনি কী মনে করেন ?
উত্তর: আমি তাই বিশ্বাস করি ৷ চলে যাওয়া মানুষগুলো যে হঠাৎ করে ফিরে আসবে, এমনটা তো নয় । তাঁরা তাঁদের জীবনে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন । আমি দ্বিতীয় প্রজন্মের অনেককে জানি, যাঁরা তাঁদের জীবনকে সম্পূর্ণরূপে অন্যত্র প্রতিষ্ঠিত করেছে, সেটা বিদেশে বা দেশের বিভিন্ন জায়গায় হতে পারে । কিন্তু তাঁরা তাঁদের মতামত প্রকাশ করেন যে তাঁরা ফিরে চান ৷ কারণ, তাঁদের শিকড় সেখানে রয়েছে । তাঁরা যাতে সেখানে (কাশ্মীর) যেতে পারেন, তার প্রয়োজনীয় পরিবেশ আমাদের তৈরি করতে হবে ৷ তবেই নিরাময় প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হবে ।
প্রশ্ন: কাশ্মীরে যাঁদের সংখ্য়া বেশি, তাঁরা কি যাঁদের সংখ্যা কম তাঁদের আপন করে নেবেন ? আপনার কী মনে হয় ?
উত্তর: আমি বিশ্বাস করি এটা হওয়া উচিত । আমি বিশ্বাস করি এটা ঘটবে ৷ এমন মানুষ অবশ্যই আছেন, যাঁরা শান্তি পছন্দ করেন না ৷ কিন্তু এই প্রক্রিয়ার 30 বছরের মধ্যে একটি নতুন প্রজন্ম বড় হয়েছে ৷ তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ভালো সময় দেখেননি । তাঁরা তাঁদের মা-বাবার কাছ থেকে এটা শুনেছেন এবং আমি অনুভব করি যে একসঙ্গে থাকা আরও ভালো হতে পারে ৷ তা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে ।
প্রশ্ন: ধারা 370 রায় নিয়ে সমালোচকরা জানিয়েছেন যে এই রায় সাংবিধানিক কাঠামোর উপর প্রভাব ফেলেছে ৷ আর 370 ধারা এমনই ছিল না ৷ বরং এর নির্দিষ্ট মূল্য ছিল । এই নিয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী ?
উত্তর: ধারা 370 সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি আদেশ জারি করার মাধ্যমে আরও অনেক দিকের সঙ্গে এটাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল ৷ তখন সবাই এটা গ্রহণ করেছিল । তখন এটা একটি খোলসের ভিতরে ছিল ৷ তার ভিতরেও কিছু ছিল ৷ দারুণ বেশি কিছু নয় ৷ কিন্তু যখন রাজনৈতিক ব্যবস্থা সিদ্ধান্ত নেয় যে একটি ক্ষণস্থায়ী বিধান এখন তার উদ্দেশ্য পূরণ করেছে এবং এটি শেষ করা উচিত, তখন এটি শেষ করা হয়েছিল… । আসল প্রশ্ন ছিল, কীভাবে এটি শেষ করা হবে ৷ সম্ভবত এই প্রক্রিয়ার আরো সমস্যা ছিল ৷ আর পাঁচজন বিচারপতির মনে হয়েছে যে এটি একটি পদ্ধতি হতে পারে শেষ করার ৷ আর সেটাকে বহাল রাখা হয়েছে ।
উল্লেখ্য, বিচারপতি কৌল চলতি মাসের শুরুতে অবসর নিয়েছেন ৷ 1958 সালের 26 ডিসেম্বর তাঁর জন্ম ৷ তিনি 1982 সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ল সেন্টার থেকে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ওই বছর 15 জুলাই দিল্লির বার কাউন্সিলে অ্যাডভোকেট হিসেবে নথিভুক্ত হন ৷ 1999 সালের ডিসেম্বরে তিনি একজন সিনিয়র অ্যাডভোকেট হিসাবে মনোনীত হন । 2001 সালের মে মাসে বিচারপতি কউলকে দিল্লি হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে উন্নীত করা হয় ৷ 2003 সালের 2 মে তাঁকে স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত করা হয় ।
তিনি 2013 সালের 1 জুন তিনি পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি পদে নিযুক্ত হন ৷ বিচারপতি কৌল 17 ফেব্রুয়ারি 2017-তে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন । তিনি শীর্ষ আদালতের সেই বেঞ্চের অংশ ছিলেন, যা বর্তমান আইন অনুযায়ী সমলিঙ্গ বিবাহের আবেদন খারিজ করে দেয় ৷ ওই রায়ে শীর্ষ আদালত জানায়, মামলাটি কঠোরভাবে আইনি নয় ৷ তবে সামাজিক সমস্যা জড়িত৷ সরকার চাইলে ভবিষ্যতে এই অধিকার কার্যকর করার জন্য একটি আইন প্রবর্তন করতে পারে ।
আরও পড়ুন:
- বছর শেষে ফিরে দেখা 2023 সালে সুপ্রিম কোর্টের 10 গুরুত্বপূর্ণ রায়
- সংবিধানের অনুচ্ছেদ 370 বাতিল নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের যুগান্তকারী রায়ের 10টি মূল বক্তব্য
- 370 ধারা বিলোপের সিদ্ধান্ত অসাংবিধানিক নয়, জম্মু ও কাশ্মীরের মামলায় জানাল শীর্ষ আদালত