হায়দরাবাদ, 28 মে: ইংরেজি ভাষায় একটি প্রবাদ আছে, 'ব্লাড ইজ থিকার দ্যান ওয়াটার' । অর্থাৎ, রক্তের ঘনত্ব জলের থেকে বেশি। দ্বাদশ শতকে জার্মানিতে এই ধরনের একটি কথার চল ছিল । তারও প্রায় দু'শো বছর বাদে ইংরেজ লেখক জন লয়েডগেট তাঁর লেখার মাধ্যমে এই প্রবাদটিকে আরও জনপ্রিয় করেছিলেন । ভারতীয় রাজনীতিতেও এই লাইনটি ব্যবহার হয়ে আসছে সেই কোন কাল থেকে। ছোট ছেলে সঞ্জয় যখন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির সব প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করছেন তখন প্রিয় ইন্দুকে উপদেশ দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় । সে সময় তাঁকেও এই প্রবাদটির কথা মনে করিয়ে নিরস্ত্র করেছিলেন কংগ্রেসী সতীর্থরা ।
গণতন্ত্র দেশে সুপ্রতিষ্ঠিত কি না তা নিয়ে তর্কের অবকাশ থাকলেও 140 কোটির দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র যে ডালপালা মেলতে পেরেছে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই । ভারতের এই প্রতিনিধিত্ব মূলক গণতন্ত্রের প্রাণ হয়ে থেকেছে দিল্লির সংসদ মার্গের এই বাড়িটা । দেশ খাতায়-কলমে স্বাধীন হওয়ার আগে এই বাড়িতেই তৈরি হয়েছিল সংবিধান সভা । এখানেই গৃহিত হয়েছিল দেশের সংবিধান । এখান থেকেই স্বাধীনতার সদর্প ঘোষণা করেছিলেন জওহরলাল নেহরু । আবার গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করা জরুরি অবস্থা জারির প্রস্তাবও পাশ হয়েছিল এখানেই । দু'শো বছরের পরাধীনতার অন্ধকারকে দূর করে 1947 সালে সদ্য জন্ম নেওয়া দেশকে সাবালক করেছে এই বাড়িটা ।
ব্রিটিশ স্থাপত্যবিদ এডউইন লুটিয়ান্স সংসদ ভবনের পাশাপাশি দিল্লির এই এলাকার বেশ কিছু ভবন নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে এই প্রতিটি বাড়িতেই ইতিহাস ফিসফিস কথা বলেছে। তাই অনেকেই দিল্লির এই অংশকে 'লুটিয়ান্স দিল্লি' বলেন । এবার সব বদলে যাচ্ছে ।
এবার নয়া ভবন থেকে চলবে দেশের সংসদের উচ্চ ও নিম্মকক্ষ । পুরনো ভবনটিকে মেরামত করা হবে । আধুনিকীকরণ হবে। সরকার জানিয়েছে, পরবর্তী সময়ে কোনও বড় অনুষ্ঠান বা ওই ধরনের কিছু করতে হলে এই ভবনকেই ব্যবহার করা হবে । কিন্তু দেশে আইন প্রণয়ণে আর ভূমিকা থাকবে না বাড়িটার । তবে থেকে যাবে ইতিহাস । আজকের এই মাহেন্দ্রক্ষণে ফিরে দেখা সেই ইতিহাসের কিছু মণি-মাণিক্য ।
গোড়ার কথা...
1927 সালের 18 জানুয়ারি সংসদ ভবন তৈরির কাজ শুরু হয় । কমবেশি ছ’বছর সময় লাগে ভবনটি তৈরি করতে । খরচ হয় তৎকালীন হিসেবে প্রায় 83 লক্ষ টাকা । 1947 সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে 1946 সাল থেকেই এখানে সংবিধান তৈরির কাজ হয় । প্রতিনিয়ত দেশের তাবড় নেতাদের দেখা সেই শুরু এই ভবনের ।
স্বাধীনতার সেই রাত...
1947 সালের 15 অগস্টে এই ভবন থেকেই স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করেছিলেন নেহরু । ভাষণে তিনি বুঝিয়ে দেন, দুনিয়ার তামাম বড় বড় দেশ এখন ঘুমিয়ে থাকলেও ভারত জেগে উঠেছে । সদ্যজাত এই দেশ সারা দুনিয়াকে চ্যালেঞ্জ করতে প্রস্তুত । আবার পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা করতে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল ভারত । নেহরু-তনয়া এই সংসদে দাঁড়িয়েই দেশকে জানিয়েছিলেন, যুদ্ধ শেষে এক নতুন দেশের জন্ম হয়েছে ।
জরুরি অবস্থা...
গণতন্ত্রের মৃত্যদিন হিসেবে কোনও একটি দিনের কথা যদি বলতে হয়, তাহলে জরুরি অবস্থার কথা মনে করতেই হবে । ইন্দিরা গান্ধির সেই সিদ্ধান্ত 19 মাসের জন্য বদলে দিয়েছিল দেশের পরিচালন ব্যবস্থাকে । 25 জুন রাত বারোটায় রেডিওতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছিলেন ইন্দিরা । সেই থেকে লাগু হয়ে যায় জরুরি অবস্থা । দেশে তখন কোনও আইনসভা নেই । নেই কোনও বিরোধী স্বর। আনুষ্ঠানিকভাবে ইন্দিরা মন্ত্রিসভার প্রবীণ সদস্য বাবু জগজীবন রাম সংসদে সেই প্রস্তাব পেশ করেন । এরপরে অবশ্য তিনি নিজেই কংগ্রেস ত্যাগ করেন । আরও অনেক পরে তাঁর মেয়ে মীরা কুমার লোকসভার প্রথম মহিলা অধ্যক্ষ হন।
মুক্ত বাণিজ্য...
পিভি নরসিমা রাওয়ের প্রধানমন্ত্রী হওয়া জাতীয় রাজনীতির অন্যতম চমকপ্রদ ঘটনার অন্যতম ।প্রবীণ নেতা ধরেই নিয়েছিলেন তাঁর রাজনৈতিক জীবন শেষ হয়ে গিয়েছে। ঠিক সে সময় এলটিটিই-র হানায় প্রাণ গেল রাজীব গান্ধির । আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পেলেন নরসিমা । দলের সভাপতির পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ এসে গেল তাঁর কাছে । ভাবলেন, দেশের অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আনার সময় হয়েছে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিলেন তৎকালীন সময়ের ইউজিসির চেয়ারম্যান মনমোহন সিংকে। সরকার গঠনের পর প্রথম বাজেটে রাও-সিং জুটি বিস্ফোরণ ঘটাল । ভারতীয় বাজার বিদেশি সংস্থার জন্য খুলে গেল । সেদিন মনমোহন সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, কোনও একটি ধারণা যার সময় এসে গিয়েছে তাকে পৃথিবীর কোনও শক্তি রুখতে পারবে না । তিনি বলতে চেয়েছিলেন, ভারত আসলে তেমন এক ধারনা আর যাকে রোখা যাবে না ।