ভারতীয় সিনেমার এক স্তম্ভ আজ এই বাসভূমি ছেড়ে তাঁর স্বর্গীয় বাসস্থানের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছেন ৷ এটা মেনে নেওয়া আমাদের সবার পক্ষে কঠিন ৷ তিনি এমন একজন চিত্র পরিচালক যাঁর অনবদ্য সৃষ্টিশৈলী আমাদের গর্বিত করে ৷ বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (Buddhadeb Dasgupta) একজন সাহসী পরিচালক ছিলেন ৷ তিনি সিনেমায় নতুন একপ্রকার ভাষার প্রবর্তন করেছিলেন ৷ তিনি তাঁর সিনেমায় এমন কিছু বিষয় নিয়ে কাজ করেছিলেন যা বিশ্বজুড়ে সুনাম ও প্রশংসা কুড়িয়েছে ৷ ওঁর 'গৃহযুদ্ধ' দেখে বড় হয়েছি ৷ ওঁর সিনেমায় মমতা শঙ্কর, অঞ্জন দত্ত বা গৌতম ঘোষের অভিনয় মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখেছি ৷ এসব সিনেমা যখন দেখছি, তখন আমি টিনএজারও নই ৷ কিন্তু সেই বয়সেই আমার কাকা আমাকে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত নামটির সঙ্গে আলাপ করান ৷ এই কাকা, যিনি পেশায় ডাক্তার, তাঁর তথাকথিত ভিন্ন ধারার সিনেমার মানে বোঝান আমাকে ৷
ওঁর মন্দ মেয়ের উপাখ্যানে মূল চরিত্রে অভিনয় করতে পেরে আমি ব্যক্তিগতভাবে গর্ব অনুভব করি ৷ চরিত্রটি আমাকে অভিনেত্রী হিসাবে পরিণত করেছে ৷ অভিনয়ের বহু সূক্ষ অলিগলির সন্ধান পেয়েছিলাম ওই চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে ৷ উনি একজন পারফেকশনিস্ট পরিচালক ৷ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের থেকে তাঁদের সেরাটা বের করে আনতে পারতেন ৷ মন্দ মেয়ের উপাখ্যানে পরিচালক যেমনটা চাইছিলেন তা বের করে আনতে গিয়ে নিজেকে প্রচুর ভাঙাচোরা করতে হয়েছিল ৷ কেরিয়ারের শুরুর দিকেই অমন একটা চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে রাতের ঘুম প্রায় উড়ে গিয়েছিল ৷ একজন বণিতা আবার যে একটা মা-ও বটে... তেমন চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে রাতের পর রাত জেগে শুধু ভেবেছি ৷
পুরুলিয়া হল বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের প্রিয় লোকেশন ৷ অনেক ছবিতেই উনি পুরুলিয়াকে নানাভাবে ব্যবহার করেছেন ৷ মন্দ মেয়ের উপাখ্যানও পুরুলিয়াতেই শু্যট করা হয়েছিল ৷ গোটা ইউনিট নিয়ে সেখানে পৌঁছনই বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল ৷ পুরুলিয়ার মতো প্রত্যন্ত গ্রামে মানুষ যখন জানতে পেরেছেন তারকা অভিনেত্রী আসছেন... সে ভিড় দেখার মতো ৷ তার উপর পুরুলিয়ার ওই গরম ৷ কিন্তু কিছুতেই পরিচালককে দমানো সম্ভব নয় ৷ মাথায় টুপিটি চাপিয়ে ভিড় ঢেলে এগিয়ে কীভাবে যেতে হয় তা শিখতে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকেই দেখতে হবে ৷ যাই হোক সেটে উনিই সবার প্রথমে পৌঁছবেন ৷ লাইট চেক করে লেন্স টেন্স সব দেখে নেওয়া ছিল ওঁর নিত্যদিনের কাজ ৷ উনি ছিলেন একজন টাস্কমাস্টার ৷ ওঁর সিনেমার মধ্যে দিয়ে ওঁর কারুশিল্পের প্রতিভা ব্যক্ত হয়েছে ৷ উনি ওঁর নিজের জেনারেশনের তো বটেই আগামী অনেক জেনারেশনের প্রদর্শক ৷
উনি ভোরবেলা এবং সন্ধ্যার ন্যাচারাল লাইটে কাজ করতে খুব পছন্দ করতেন ৷ এই লাইট নিয়ে কাজ করার কঠিন দিকটি ছিল- খুব অল্প সময়ের জন্য এই লাইট পাওয়া যেত ৷ তার মধ্যেই ভীষণ নিয়মানুবর্তীতার মধ্যে কাজ করতে হত ৷ ঠিক মতো শু্যট দিতে না পারলেই রেগে যেতেন ৷ আমি তো ওঁকে শুধু লাইট পছন্দ না হওয়ার জন্য এক একটা গোটা দিন প্যাক-আপ বলে দিতে শুনেছি ৷ এই লাইট নিয়ে ওঁকে বহুবার হতাশ হতেও দেখেছি, যেটা আমাদের মানে গোটা ইউনিটকেই গ্রাস করত ৷ কিন্তু যত যাই হোক, শেষ অবধি পরিচালক সেরাটা বের করে আনবেনই ৷