ছ’বছর আগে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল যে, সুশাসনের অর্থ, অপরাধীদের দ্রুত শাস্তি সুনিশ্চিত করা । অপরাধমূলক অতীত রয়েছে, এমন নেতারা অন্তর থেকে আত্মবিশ্বাসী যে যখন তাঁরা নিজেরাই শাসক এবং জনতার প্রতিনিধি, তখন তাঁদের শাস্তির সম্ভাবনা কোথায়? রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণন বলেছিলেন, যদি রাজনৈতিক দলগুলি সংকল্প নেয় যে তারা অপরাধমূলক অতীত রয়েছে, এমন মানুষদের টিকিট দেবে না এবং সরাসরি তাঁদের নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তাহলে এই সমস্যার সহজে সমাধান হতে পারে ।
রাজনৈতিক দলগুলি কি এইটুকু করতে পারবে ? সেই সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলিকে ধন্যবাদ, যারা সুপরামর্শ এড়িয়ে, অপরাধীদের সম্মান প্রদর্শন করে, দলে টানার লড়াইয়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে । বর্তমান লোকসভার 43 শতাংশ জনপ্রতিনিধিরই অপরাধের অতীত রয়েছে ! 14 দিন আগে সুপ্রিম কোর্টের তরফে জারি করা নির্দেশিকা মেনে তেলাঙ্গানা হাইকোর্ট এই প্রসঙ্গে একটি উদ্যোগ নিয়েছে । গণতন্ত্রকে দুুর্নীতি এবং অপরাধমূলক রাজনীতি থেকে রক্ষা করতেই সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্ত ।
হাইকোর্ট ইতিমধ্যেই এবিষয়ে উদ্যোগী হয়েছে । 118 টি বিশেষ আদালত, CBI এবং ACB আদালতে এই সব জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে আটকে থাকা মামলাগুলির নিত্য শুনানির ব্যবস্থা করেছে । MP—দের বিরুদ্ধে বেশিরভাগ মামলাতেই সমন ইশু না হওয়ায় বিরক্ত হয়ে সর্বোচ্চ আদালত পুলিশ কর্তৃপক্ষকে যথাযথ পদক্ষেপ করতে নির্দেশ দিয়েছে ।
অ্যামিকাস কিউরি বিজয় হানসারিয়া সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছেন, প্রাক্তন এবং বর্তমান MP ও MLA—দের বিরুদ্ধে গোটা দেশে 4,442 টি মামলা ঝুলে রয়েছে, যার মধ্যে 2,556 টি মামলা নথিবদ্ধ রয়েছে বর্তমান বিধায়কদের বিরুদ্ধে । যে 413 টি মামলায় অভিযুক্তের বিরুদ্ধে যাবজ্জীবনের সাজার আশঙ্কা বেশি, তার মধ্যে 178টি-ই ক্ষমতাসীন MP বা MLA—দের বিরুদ্ধে । যদিও অতীতে দু'টি তেলুগু রাজ্য ছাড়াও কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ, তামিলনাড়ু এবং পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ আদালত গঠন করা হয়েছে, তবুও সব মামলাই এখনও ঝুলে আছে । আশা করা হচ্ছে যে তেলাঙ্গানা হাইকোর্টের উদ্যোগে দেশের অপরাধীদের বিচার ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠবে ।
2018 সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা ছিল যে তথ্যের অধিকার সংক্রান্ত নাগরিকদের অধিকারকে একটি হাতিয়ারে পরিণত করতে হবে এবং নির্বাচনে দাঁড়ানো প্রার্থীদের ব্যক্তিগত ইতিহাস সামগ্রিকভাবে জনতার গোচরে আনতে হবে সংবাদপত্র এবং অন্য পাবলিক মিডিয়ার মাধ্যমে । কিন্তু নির্বাচন কমিশন যেহেতু কোনও প্রধান চ্যানেল বা সংবাদপত্র নির্দিষ্ট করে দেয়নি, তাই প্রার্থীরা আইনি বিধির জাঁতাকল এড়াতে কম জনপ্রিয় সংবাদপত্রের ব্যবহার করেছে এবং চোখে পড়বে না এমন সময়ে চ্যানেলগুলিতে নিজেদের বিরুদ্ধে থাকা অপরাধমূলক মামলার বৃত্তান্ত সূচিত করেছে ।
সেপ্টেম্বর মাসে সুপ্রিম কোর্ট সংসদকে অপরাধীদের হাত থেকে রাজনীতিকে বাঁচাতে কড়া আইন লাগু করতে নির্দেশ দিয়েছিল । সংবিধানের আওতা থেকে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকদের কারবারে ইতি টানার চেষ্টায় বিচারবিভাগীয় ব্যবস্থা কার্যত একক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে । অথচ সুপ্রিম কোর্টের এই উদ্যোগের প্রেক্ষিতে কংগ্রেস আগের নির্বাচনের তুলনায় 47 জন আরও বেশি অপরাধময় অতীত থাকা প্রার্থীকে দাঁড় করিয়েছে, যেখানে বর্তমান লোকসভায় BJP-র এই গোত্রের 59 জন সাংসদ আছেন ।
এবার দেখার বিষয় হল, গত ফেব্রুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্টের শেষ নির্দেশিকা কতটা সক্রিয় হয়? রাজনৈতিক দলগুলি কতদূর যেতে পারে, কেন তারা অপরাধময় অতীত থাকা প্রার্থীদের নির্বাচন করেছে, জনতাকে তার উত্তর দেওয়ার জন্য ? যদি রাজনৈতিক দলগুলি ভোটে জেতার জন্য অর্থ ও পেশীর জোরে এমন অপরাধীদের বাছাই করে, তাহলে জেতার পর এই অপরাধীরাই সাংবিধানিক কর্তৃপক্ষগুলিতে রাজত্ব চালাবে এবং গণতান্ত্রিক মতাদর্শগুলিকে অশ্রদ্ধা করবে । জেলে থাকার যোগ্য বিধায়কদের জেলের বদলে বিধানসভায় প্রবেশ বন্ধ করার জন্য কঠোর বিধি চালু করতে সংসদ তৈরি নয় । অন্তত, বিচারবিভাগীয় ব্যবস্থার এই নয়া উদ্যোগের মাধ্যমে যদি কলঙ্কিত নেতাদের বিরুদ্ধে ঝুলে থাকা মামলাগুলির দ্রুত শুনানির ব্যবস্থা করা যায় এবং তাদের যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করে যদি বিচারবিভাগীয় ব্যবস্থার উপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা যায়, তাহলে ভারতীয় গণতন্ত্র স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচবে ।