পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / bharat

তাঁরা কোথায় হারিয়ে গেলেন, কেন হারিয়ে গেলেন ?

প্রতিটি থানার সামনে নিখোঁজ ব্যক্তিদের একটি বোর্ড ঝোলানো থাকে । কোনও কোনও ক্ষেত্রে আবার নিখোঁজ ব্যক্তিটির পরিবারের তরফে আর্থিক পুরষ্কারের কথাও ঘোষণা করা হয় । হায়দরাবাদের মতো বড় শহর, যেখানে প্রতিদিন বহু মানুষ বাড়ির বাইরে বের হন । কেউ বের হন ব্যক্তিগত কাজে, কেউ আবার পারিবারিক কাজে । 11 জন অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক এবং 14 জন মহিলা-সহ শুধুমাত্র নভেম্বর মাসেই নিখোঁজ হয়েছেন 40 জন । পুলিশ অনেক খুঁজলেও তাদের কোনও হদিশ পাওয়া যায়নি ।

ছবিটি প্রতীকী
ছবিটি প্রতীকী

By

Published : Dec 9, 2019, 10:28 PM IST

পরিবারটি সুন্দর জীবনযাপনের স্বপ্ন নিয়ে দিল্লিতে এসেছিল । 16 বছরের মেয়েটি তার অবসর সময়ে চায়ের দোকানের কাজে মাকে সাহায্য করত । একদিন রাতে হঠাত্ই মেয়েটি নিখোঁজ হয়ে গেল । অনেক খুঁজেও মেয়েকে পেলেন না মা । খালি হাতেই ফিরে আসতে হল বাড়িতে । গরচিবোলি থানায় রাত 11টা নাগাদ দায়ের করা হল একটি নিখোঁজ ডায়েরি । পর দিন বাড়িতে পৌঁছল একটি ভয়ঙ্কর খবর । পুলিশ ওই মেয়েটির পরিবারকে জানায়, একটি নির্জন স্থানে একটি দেহ পাওয়া গেছে । মা গিয়ে দেখতে পান মেয়ের নিথর দেহটি পড়ে আছে, দেহে একাধিক আঘাতের চিহ্ন ।

দিন কয়েক আগে শামসাবাদে যুবতি চিকিত্সক দিশাকে ধর্ষণের পর খুন করা হয় । পুড়িয়ে দেওয়া হয় । সেই ভয়ঙ্কর দিনে রাত নটা নাগাদ যুবতি তাঁর বোনকে ফোন করে তাঁর পরিস্থিতির কথা জানয়েছিলেন । অপরাধীরা তার পিছু ধাওয়া করায় ভয় পেয়েছিলেন চিকিত্সক । এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই যুবতির ফোন বন্ধ হয়ে যায় । যুবতির চিন্তিত পরিবার পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে যায় । কিন্তু, পুলিশের গাফিলতির জন্য দিশার দগ্ধ দেহ উদ্ধার হয় । সমাজের সর্বস্তর এক বাক্যে স্বীকার করে নেয়, পুলিশ একটু সক্রিয় হতে পারলে পরিস্থিতি কোনওভাবেই এমনটি হতো না ।

প্রতিটি থানার সামনে নিখোঁজ ব্যক্তিদের একটি বোর্ড ঝোলানো থাকে । কোনও কোনও ক্ষেত্রে আবার নিখোঁজ ব্যক্তিটির পরিবারের তরফে আর্থিক পুরষ্কারের কথাও ঘোষণা করা হয় । হায়দরাবাদের মতো বড় শহর, যেখানে প্রতিদিন বহু মানুষ বাড়ির বাইরে বের হন । কেউ বের হন ব্যক্তিগত কাজে, কেউ আবার পারিবারিক কাজে । 11 জন অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক এবং 14 জন মহিলা-সহ শুধুমাত্র নভেম্বর মাসেই নিখোঁজ হয়েছেন 40 জন । পুলিশ অনেক খুঁজলেও তাদের কোনও হদিশ পাওয়া যায়নি । কেবল মাত্র জুবলি হিলসের থানায় এক মহিলা অভিযোগ করেছিলেন তাঁর স্বামী এবং দুই সন্তান নিখোঁজ হয়ে গেছে, যদিও পুলিশ ওই ব্যক্তকে খুঁজে পায় । আবার এক বাবা থানার অভিযোগ করেছিলেন , তাঁর মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না , এক মাস এর কেটে গেলেও মেয়েটির কোনও এখনও দিতে পারেনি ।

জুনের 1 থেকে 10 তারিখের মধ্যে 540 জন নিখোঁজের খবর ছিল । এর মধ্যে 303 জন হায়দরাবাদ, সায়বারাবাদ এবং রিচাকোন্ডা এলাকা থেকে । এর মধ্যে 276 জন মহিলা, 55 জন যুবতি, 26 জন যুবক এবং 183 জন পুরুষ । 222 জনের খোঁজ মিলেছে । নভেম্বর মাসে এই তিন পুলিশ স্টেশনে 38-40টি নিখোঁজ ডায়েরি করা হয়েছিল । দেখে গেছে, গড়পরতা প্রতিদিন 60 জন করে নিখোঁজ হয়েছে, যার বেশির ভাগেই গ্রেটার হায়দরাবাদ এলাকা থেকে । তারা কী শেষ হয়ে যাচ্ছে ? নাকি তারা কোনও দুর্নীতিমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে ? মেয়েরা সুস্থ ভাবে বাড়ি ফেরা না পর্যন্ত শান্তিতে থাকতে পারেন না বাবা-মায়েরা । নিখোঁজ হওয়া মহিলা-যুবতিদের মধ্যে মাত্র 50 শতাংশের খোঁজ পাওয়া গেছে । পাচার রোখা এই মুহূর্তে পুলিশের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ । এ কাজের জন্য রীতিমতো পুলিশের টহল চলছে । দেখা গেছে, চাকরি এবং বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েও অনেক ক্ষেত্রে পাচার করা হচ্ছে ।

KPHB-র বাসিন্দা রামানা তাঁর মানসিক প্রতিবন্ধী ভাইকে খুঁজে চলেছেন, যে গত 24 জুন থেকে নিখোঁজ । দুর্গি বালেশ্বরী পেশায় একজন নিরাপত্তা কর্মী । ওই একই এলাকার বাসিন্দা । গত 23 সেপ্টেম্বর থেকে তাঁর 17 বছরের মূকবধির ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছেন না । বেশ কয়েকবার থানায় গেছেন, অভিযোগ করেছেন, কিন্তু, কোনও ফল পাওয়া যায়নি । KPHB এলাকার অপর এক বাসিন্দা ভি এস রাজু । গত 21 জুন থেকে তাঁর মানসিক প্রতিবন্ধী বাবাকে খুঁজে পাচ্ছেন না । এখনও পর্যন্ত যার কোনও খবর নেই । ইন্দিরা নগরের বাসিন্দা 40 বছরের গীতা একজন দৈনিক মজুরির শ্রমিক । 2017 সালের মে মাসে বাড়ি থেকে কাজে বেড়িয়েছিলেন, কিন্তু এখনও পর্যন্ত বাড়ি ফেরেননি । ওনার মা জয়াম্মা বালানগর থানায় অভিযোগ দায়ের করেছিলেন, কিন্তু, এখনও পর্যন্ত কোনও হদিশ পাওয়া যায়নি । রাজু কলোনির বাসিন্দা 36 বছরের সঞ্জীবা রাও, তিন মাস ধরে নিখোঁজ । তাঁর স্ত্রী করুণা শ্রী থানায় অভিযোগ করেও কোনও ফল পাননি ।

লালাগুডা পুলিশ নিখোঁজের অভিযোগগুলি সমাধান করার ক্ষেত্রে একটা দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে । কোনও সূত্র না থাকলেও তারা অতি সক্রিয়ার সঙ্গে বিষয়গুলির দিকে নজর দিয়েছে । লালাপেট, শান্তি নগর, চন্দ্রবাবু নগর, সত্য নগর, ইন্দিরা নগর, লালাগুডা এবং মেত্থুগুডার মতো জায়গায় বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ ভাগ হয়ে নজরদারি শুরু করে, এক অপ্রত্যাশিত দৃষ্টান্তও স্থাপন করে । 2016 থেকে 2019 সালের মধ্যে ওই থানায় নথিভুক্ত 69টি নিখোঁজ অভিযোগের মধ্যে একটি বাদে বাকি সবগুলির সমাধান করা হয়েছে । 68 জন মহিলাকে নিরাপদে তাঁদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয় ।

KPHB কলোনির একটি পরিসংখ্যান এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায় । দেখা গেছে, এখান থেকে অনেক মহিলা স্বেচ্ছাতেই তাঁদের ঘর ছেড়েছেন । কিছু ক্ষেত্রে মহিলারা ঘর ছাড়ার আগে চিঠি লিখে বিস্তারিত জানিয়েছেন । মহিলা চিকিত্সকের ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডের পর বাবা-মায়েরা তাঁদের মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে অত্যন্ত অতঙ্কিত । 2017 সালের KPHB কলোনি থেকে 191টি নিখোঁজ ঘটনার অভিযোগ করা হয়েছিল, এর মধ্যে 180টি ক্ষেত্রেই পুলিশ সমাধান করেছে । KPHB-র পুলিশ সিআই লক্ষ্মী নারায়ণ দাবি করেছেন, তাঁরা সব নিখোঁজ অভিযোগগুলির সমাধান করবেন, দ্রুততার সঙ্গে । বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, 18 বছর হওয়ার পর অনেক মেয়েই পালিয়ে গেছে । কিছু আবার বিয়ের পর বাড়ি ফিরে আসে, এ সব ক্ষেত্রে পুরুষবন্ধুটি তাকে ঠকানোর পর বাধ্য হয়ে বাড়ি ফিরে আসতে হয় মেয়েটিকে । বিয়ে করার জন্য পালিয়ে যাওয়া এবং পরে ফিরে আসার পর পুলিশের তরফে বিশেষ কাউন্সেলিং করার ব্যবস্থা করা হয়, যাতে মেয়েটিকে ঘরে ফিরিয়ে নেওয়া হয়, সে জন্যও উদ্যোগ নেয় পুলিশ । কোনও পরিবারের কাছে কোনওরকম হুমকি এলেই পুলিশের তরফে নিরাপত্তার দ্রুত ব্যবস্থা করা হয় । বাড়ি ফিরিয়ে আনার পর ওই যুবতির নিখোঁজের সঙ্গে যে বা যারা যুক্ত তাদের গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ।

হায়াতনগর পুলিশ সূত্রে খবর, নিখোঁজদের অধিকাংশই বৃদ্ধাবাস এবং অনাথ আশ্রমের । প্রবীণ নাগরিক এবং যাঁরা কানে শুনতে পান না, তাঁদের খুঁজে বের করা খুবই সমস্যার । হায়াতনগর পুলিশ রেল লাইন এবং বাস স্ট্যান্ড থাকা শিশুদের অনাথ আশ্রমে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে । যাদের মধ্যে বেশির ভাগই বাড়ি থেকে পালিয়েছিল, বাড়ি পালানোর কিছুদিনের মধ্যেই তাদের সন্ধান পাওয়া যায় । মালকাজিগির পুলিশ সূত্রে খবর, 2019 সালে 134 টি নিখোঁজ মামলা দায়ের করা হয়েছিল । এই নিখোঁজদের মধ্যে 20 শতাংশ মহিলা, 95 শতাংশকে নিরাপদে বাড়ি ফেরানো সম্ভব হয়েছে । 2014 সালে বালানগর পুলিশের কাছে 303টি নিখোঁজ মামলা দায়ের করা হয়েছিল । এর মধ্যে 286টির সমাধান হয়ে গেছে । 17টি ক্ষেত্রে এখনও কোনও সমাধান মেলেনি । এই থানায় 40-70 শতাংশ অভিযোগই নিখোঁজের । বালানগরের সিআই ওয়াইউদ্দিন জানিয়েছেন, প্রতিটি মামলার ক্ষেত্রে আসল কারণ- উদ্দেশ্য জেনেই তা দ্রুত সমাধান করা হচ্ছে ।

গত চার বছরে জুবিলি হিলসে এই ধরণের নিখোঁজের অভিযোগ উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে । 90 শতাংশ ক্ষেত্রে সমস্যার সমাধান করা হয়েছে । গত চার বছরে 546টি অভিযোগ দায়ের হয়েছিল । জুবিলি হিলসের সিআই পি বালাভানতাইয়া জানিয়েছেন, অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে আধুনির প্রযুক্তি ব্যবহার করার সুফল পেয়েছেন তাঁরা । বানজারা হিলসের অবশ্য গত চার বছরে নিখোঁজের অভিযোগ বেশি জমা পড়েছে ।গত চার বছরে 735 টি অভিযোগ জমা হয়েছে । পুলিশের দাবি, এর মধ্যে 90 শতাংশের সমাধান করা সম্ভব হয়েছে । বাচুপল্লী পুলিশ সূত্রে খবর, গত দুই বছরে 194টি অভিযোগ জমা পড়েছে । 96 জনের নিখোঁজ হওয়ার খবর রয়েছ 2018 সালে । এর মধ্যে 51 জন মহিলা এবং 12 জন যুবতি । 2019 সালে 54 জন পুরুষ, 39 জন মহিলা, 4 জন যুবক এবং এক জন যুবতি । 98টি নিখোঁজ অভিযোগের মধ্যে 81 জনের সন্ধান পেতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ ।

কুতবুল্লাপুর মন্ডলের দান্ডিগাল থানায় গত চার বছরে 576টি নিখোঁজের অভিযোগ দায়ের করা হয় । 2018 সাল পর্যন্ত 78টির সমাধান হয়নি । বাবা-মায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মেয়েকে অপহরণের অভিযোগ দায়ের হয়েছে । শেষ দুই বছরে 19টি অপহরণের অভিযোগ দায়ের হয়েছে, এর মধ্যে তিনটির কোনও অগ্রগতি হয়নি । দান্ডিগালের এসআই শেখর রেড্ডি জানিয়েছেন, অভিযোগ দায়েরের এক বছরর পরও যে অভিযোগগুলির ক্ষেত্রে খুব একটা অগ্রগতি ঘটেনি, তেমন অভিযোগগুলি বিশেষ ভাবে নজর দেওয়া হচ্ছে । তিনি আরও যোগ করেছেন, পরিস্থিতি বর্তমানে অনেকটাই পাল্টে গেছে । বাবা-মায়ের অভিযোগের পরও বিস্তারিত অনুসন্ধান করে অভিযোগ নেওয়া হচ্ছে । পেশায় নিরাপত্তা রক্ষী 45 বছরের মহম্মদ ইব্রাহিম 2016 সালের 13 ফেব্রুয়ারি কাজের জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন । গত তিন বছরে তাঁর কোনও হদিশ পাওয়া যায়নি । তাঁর স্ত্রী সালেমা বেগম চন্দ্রয়ানা গুট্টা থানায় অভিযোগ দায়ের করেছিলেন, কিন্তু, তিন বছর পরও কোনও রকম হদিশ পাননি । 2016 সালের 20 ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি নিখোঁজ, সে দিন শেষ বার ফোনে স্বামীর সঙ্গে কথা হয়েছিলেন সালেমার । তার পর থেকেই ফোন বন্ধ । পুলিশ অনেক খুঁজেও এখনও কোনও সন্ধান দিতে পারেনি । সব চেষ্টাই আপাতত ব্যর্থ ।

ABOUT THE AUTHOR

...view details