বর্তমান সময়ে আন্তর্জাতিক ও ভূ-রাজনৈতিক বিষয়গুলি নিয়ে যে দুর্বিপাক ও অনিশ্চয়তা চলছে, সে রকম অবস্থার সাক্ষী প্রায় হতেই হয়নি ভারতকে। নিরাপত্তা বোঝাপড়া, বাণিজ্য বন্দোবস্ত, বহুপাক্ষিক বা বহুমুখী সম্পর্ক, আজকের দিনে আর কোনও কিছুই অলঙ্ঘনীয় বা অনতিক্রম্য নয়। এমনকী এই পরিস্থিতিতে কোনও কিছুই আগে থেকে আন্দাজ করাটাই বেশ কঠিন । কোরোনা প্যানডেমিকের আবহে এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নিয়েছে। এই পরিস্থিতির প্রধান কৃতিত্ব দুই কুশীলবের— আমেরিকার 45তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি 2017 সালের মধ্য জানুয়ারি ক্ষমতায় এসেছেন, আর দ্বিতীয় জন চিনা কমিউনিস্ট পার্টির ‘সম্রাট’ শি জিনপিং, যিনি সেই 2012 সাল থেকে ক্ষমতায় রয়েছেন ।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বললেই যে ধকরনের মূর্তি সামনে ভেসে ওঠে, সেই ধারণার সম্পূর্ণ ভঙ্গকারী ট্রাম্প ক্ষমতায় আসেন ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন’ এবং ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এর মতো স্লোগানকে সঙ্গী করে। এসেই তিনি সহযোগী দেশগুলিকে সরাসরি দোষ দিতে শুরু করেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, তারা সবাই আমেরিকার ভালো মানুষীর সুযোগ নিচ্ছে। তাঁর অভিযোগের মূল লক্ষ্য ছিল প্রধানত G7 এবং NATO রাষ্ট্রগুলি । ট্রাম্পের বক্তব্য ছিল, যে শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য আমেরিকা বহু ত্যাগ স্বীকার করেছে, তার মর্যাদা দিচ্ছে না সহযোগী দেশগুলি । এমনকি আর্থিক বোঝাও নাকি সঠিক ভাবে ভাগ করে নেওয়া হচ্ছে না। যে সব দেশের প্রতি তাঁর বেশি ক্ষোভ ছিল, তাদের বেশির ভাগই মোট GDP-এর 1 শতাংশেরও কম প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করে।
ক্ষমতায় আসার প্রথম দিন থেকেই তাঁর পূর্বতনদের দৃষ্টিভঙ্গী ও নীতি নিয়ে একেবারেই ভাবিত ছিলেন না তিনি। ওবামার ছাপ থাকা সব কিছুর উপরই তিনি প্রায় টর্নোডার মতো আছড়ে পড়েন। প্রথমেই তিনি বহু আশার TPP (ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ) বাণিজ্য চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসেন। এর পর বেরিয়া আসেন প্যরিসের জলবায়ু চুক্তি, JCPOA (জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশান), ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি থেকে। তালিকাটা দীর্ঘ এবং এগুলি হীমশৈলের চূড়ামাত্র। পরমাণু চুক্তি অনুসারে যখন ইরান যখন সদর্থক সিদ্ধান্ত নিচ্ছিল, তখনই ট্রাম্প সে দেশের উপর আরও কড়া নিষেধাজ্ঞা চাপাতে শুরু করেন। বেশির ভাগ বিশ্বনেতা এবং জার্মানি, ফ্রান্স, কানাডা, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো আমেরিকার বিশ্বস্ত বন্ধুদের কার্যত পাত্তা দেওয়াই বন্ধ করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ।
কিন্তু ট্রাম্প একটা বিষয়ে একেবারেই বুঝতে পারেননি, আর তা হল চিনা আগ্রাসন । 2016 সালের ডিসেম্বরে আমেরিকার 35 বছরের ‘ওয়ান চায়না পলিসি’ নীতি থেকে সরে এসে প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট ট্রাম্প তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের অভিনন্দনসূচক বার্তা গ্রহণ করেন। এর পর তিনি টুইট করেন, “আমায় আজ তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট ফোন করে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেতার জন্য অভিনন্দন জানান। ধন্যবাদ। তাইওয়ানকে আমেরিকার কোটি কোটি ডলারের সমরাস্ত্র বিক্রির দিকে তাকিয়ে আছি। তবে আমার ওই অভিনন্দনের ফোন গ্রহণ করা উচিত হয়নি ।”
ঘটনায় আকস্মিকতায় চমকে গেলেও চিনের তরফে বিষয়টি নিয়ে মারাত্মক কোনও প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়নি । চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়্যাং উই বিষয়টিকে ‘তাইওয়ানের ছোট্ট চালাকি’ হিসাবে ব্যাখ্যা করে বলেন, চিন চায় না আমেরিকার সঙ্গে রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা খারাপ হোক । কিন্তু ট্রাম্প মনস্থির করে ফেলেছিলেন । তাঁর মনে হয়েছিল, শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ চিন বছরের পর বছর ধরে আমেরিকার সুযোগ নিয়ে চলেছে। তিনি চিনের সঙ্গে বার্ষিক 375 বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়টি সামনে আনেন । চিনের বিরুদ্ধে তিনি আমেরিকার স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগ করেন । চিনের বিরুদ্ধে শিল্পক্ষেত্রে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ করেন। তিনি বহু চিনা পণ্যে কর বসান । হুয়েই এবং ZTE-এর মতো চিনা SOE (স্টেট ওনড এন্টারপ্রাইস) সংস্থা, যাদের সঙ্গে PLA (পিপলস লিবারেশন আর্মি)-র সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে, তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে অ্যামেরিকানদের এই সব সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার আর্জি জানান। এর ফলে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের উচ্চাকাঙ্খার আগুনে যেন জ্বালানী যোগ হয়। তিনি আরও কঠিন ভাবে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ জারি করেন । দুর্নীতি দমনের নামে বিরোধী স্বর এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের দমনে উদ্যোগী হন । শান্তিপূর্ণ উত্থানের সমস্ত পথ বন্ধ করে দেওয়া হয় । তাইওয়ান, তিব্বত, হংকং এবং জিনঝিয়াংয়ের উপর রাশ কঠিন করা হয় । দক্ষিণ চিন সাগরে সেনা সমাবেশ বাড়ানো হয়। জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত এবং ASEAN গোষ্ঠীভুক্ত অন্য দেশগুলির প্রতি অপ্রয়োজনীয় ভাবে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে বেজিং ।
প্রাদেশিক নিয়ন্ত্রণে মার্কিন প্রভাব বিনষ্ট করতে দ্বিতীয় বৃহত্তম 13.5 ট্রিলিয়ন অর্থনীতির দেশ চিন সেনাবাহিনীকে আধুনিক ভাবে সাজাতে শুরু করে । নৌবাহিনীকে ঢেলে সাজা হয় এবং ইন্দো-প্যাসিফিক ক্ষেত্রে বহু চিনা সেনা ঘাঁটি তৈরি করা হয়।
পাশাপাশি তারা BRI (দ্য বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ) প্রকল্প শুরু করে রপ্তানিতে জোর দেয়। একই সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলিকে ঋণের জালে ফাঁসাতে থাকে। আমেরিকার সঙ্গে টক্করে চিন পেশী শক্তির প্রদর্শন শুরু করে। আর এ ভাবেই তারা যেন আমেরিকার হাতে খেলা শুরু করে। তাঁর প্রবল প্রতিপক্ষ ট্রাম্প বিষয়টিকে আরও জটিল করে শত্রুতার মাত্রা বাড়িয়ে দেন ৷