আমরা মন দিয়ে হাত পরিষ্কার করছি । আমরা কনুই দিয়ে মুখ ঢেকে হাঁচা অভ্যেস করছি । আমরা মুখে হাত দিচ্ছি না । আমরা মাস্ক পরছি এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছি । একটা-দুটো নয়, আমরা COVID-19 থেকে নিরাপদে থাকার কয়েকশো নিয়ম মেনে চলছি । কিন্তু তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় আছে, তা হল আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে রক্ষা করা । যখন মহামারী আমাদের জীবন ও জীবিকা ধ্বংস করছে, তখন আমাদের অনাক্রম্যতাকে রক্ষা করাটা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ । আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় । বয়স হলে, তা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে ।
যখন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তখন বাকি সবকিছু পিছনের সারিতে চলে যায় ৷ সংক্রমণের ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে সত্য । যদি প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিকমতো কাজ করে, তাহলে কোনও অ্যান্টিজেন শরীরকে আক্রমণ করতে পারে না । অনেক বয়স্ক মানুষ নভেল কোরোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন । প্রবীণদের মধ্যেই এই রোগের ভয়াবহতা সবথেকে বেশি । তাই, সবার নজর এখন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপরে ।
আসলে, মাতৃগর্ভে থাকার সময় থেকেই এটা আমাদের মধ্যে গড়ে ওঠে । মায়ের জরায়ু থেকে ইমিউনোগ্লোবিউলিনের মাধ্যমে ভ্রূণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পায় । এটা মায়ের স্বাস্থ্যের ওপর, তাঁর আগে কোনও অসুখ হয়েছে কিনা, বা ভ্যাক্সিনেশনের ওপর নির্ভর করে । স্তন্যপানের মাধ্যমে কিছু ইমিউনোগ্লোবিউলিন শিশুর শরীরে প্রবেশ করে । এইভাবে যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জিত হয়, তা কয়েক মাস স্থায়ী হয় । সংক্রমণ, টীকাকরণ ও শরীরে থাকা ব্যাকটেরিয়া তখন একটা স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করে । কিন্তু কৈশোর থেকেই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক অনাক্রম্যতা কমতে থাকে । ষাটের ঘরে পৌঁছলে, এই ক্ষয় আরও দ্রুত হতে থাকে । কিন্তু ভালো দিকটা হল এই যে, বয়স সত্ত্বেও কিছু লোকের বেশি অনাক্রম্যতা থাকে ও কিছু লোকের কম । কয়েকটি সাধারণ পদক্ষেপের মাধ্যমে একজন তাঁর এই ক্ষমতাকে বাড়াতে পারেন ।
1918-র স্প্যানিশ ফ্লু-এর পরে COVID-19’কে দ্বিতীয় বৃহত্তম মহামারী বলে মনে করা হচ্ছে । নভেল কোরোনা ভাইরাস এখন থাকবে ৷ কারণ এর জন্য কোনও ভ্যাকসিন এখনও বের হয়নি । তাই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলা গুরুত্বপূর্ণ । কিন্তু এটা একদিনের কোনও রেস নয় । এর জন্য টানা অভ্যাস প্রয়োজন । আমাদের মনে রাখা উচিত, সামনে যে দীর্ঘ যুদ্ধ অপেক্ষা করছে, তা শুধু নিরবিচ্ছিন্ন
প্রচেষ্টার মাধ্যমেই জেতা সম্ভব । ইমিউন সিস্টেমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাইমাস গ্রন্থি । এটা মেরুদণ্ডের পিছনে অবস্থিত । এখানেই টি-লিম্ফোসাইটরা সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশিক্ষণ নেয় । থাইমাস গ্রন্থি শৈশবে সক্রিয় থাকলেও, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তা নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে । কৈশোরের শুরু থেকে, এই গ্রন্থি বছরে তিন শতাংশ করে ছোট হতে থাকে এবং বার্ধক্যে তা পুরোপুরি মিলিয়ে যায় । এটাই অন্যতম কারণ, যখন বৃদ্ধ বয়সে নতুন কোনও সংক্রমণের মোকাবিলা করাটা কঠিন হয়ে পড়ে । শিশুদের মধ্যে COVID-19 সংক্রমণের সংখ্যা কম ৷ তার একটা কারণ হতে পারে থাইমাস গ্রন্থি ।
অনাক্রম্যতা হচ্ছে আমাদের শরীরের দ্বিতীয় জটিলতম ব্যবস্থা । এটা তৈরি হয়েছে কয়েকশো বিভিন্ন ধরনের কোষ এবং জৈব গঠন দিয়ে । আট হাজার জিন তাদের চালনা করছে । এটা দু’টি স্তরে প্রতিরক্ষা দেয় । একটা হচ্ছে সহজাত ক্ষমতা, যা নিয়ে আমরা জন্মাই । এই সিস্টেম নিউট্রোফিল এবং ম্যাক্রোফাজদের তৈরি করে, যা শরীরের যে কোনও অচেনা বস্তুকে তৎক্ষণাৎ মেরে ফেলে । দ্বিতীয়টা হচ্ছে গড়ে ওঠা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা । আমাদের মধ্যে এটা তৈরি হয়, যখন আমাদের শরীরের জীবাণুদের এবং জীবাণুদের ত্যাগ করা রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসে । এই ব্যবস্থা তৈরি T-সেল, B-সেল এবং অ্যান্টিবডিদের দিয়ে । তারা একটু ধীর গতিতে হামলা করে । B-সেলের আবার জোরালো স্মৃতিশক্তিও থাকে । তারা মনে রাখে, অতীতে কোনও জীবাণু আমাদের শরীরকে সংক্রমিত করেছিল । দ্বিতীয়বার সংক্রমণের সময় তারা জীবাণুদের মারতে অ্যান্টিবডি তৈরি করে । ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো ভাইরাস B-সেলকে এড়াতে তাদের জিনগত গঠন বদলে ফেলে ।
নভেল কোরোনা ভাইরাসও সম্ভবত সেই পদ্ধতিতেই কাজ করছে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর চাপ তৈরি করছে । বেশিরভাগ মানুষ তাদের হ্রাস পেতে থাকা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বড় বিপদের কারণ বলে মনে করেন না । আসলে, আমাদের অনাক্রম্যতা বয়ঃসন্ধি থেকেই ক্রমশ কমতে থাকে । আমাদের জীবনচর্যার বিভিন্ন দিক তাতে ইন্ধন জোগায় । যাঁরা অলস জীবনযাপন করেন, ধূমপান বা মদ্যপান করেন, তাঁদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে । সাধারণভাবে, যখন একটা অচেনা বস্তু শরীরে প্রবেশ করে, প্রথমেই পৌঁছে যায় নিউট্রোফিলরা (একধরণের শ্বেত রক্তকণিকা) । তারা সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়তে সাইটোকাইনের মতো উৎসেচক তৈরি করে । বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিউট্রোফিলরাও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে । পুরনো নিউট্রোফিলরা ধীরে কাজ করতে থাকে । এর জেরে একদিকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শিথিল হয়ে যায় এবং অন্যদিকে রোগযন্ত্রণা বাড়ে । নিউট্রোফিলদের অস্বাভাবিক কাজকর্ম মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে । তারা সক্রিয় নিউট্রোফিলদেরও কাজ করতে দেয় না ।