পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / bharat

কোরোনা থেকে বাঁচতে জরুরি রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা, যত্ন নিন শরীরের

কোরোনার মতো ভাইরাসের মোকাবিলা করতে প্রয়োজন শরীরের প্রতি যত্ন নেওয়া ৷ ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার খেলে এবং নিয়মিত শরীর চর্চা করলে ভাইরাস মোকাবিলা সহজ হয় ৷

Vitamins and minerals prevent virus like corona
কোরোনা মোকাবিলা

By

Published : Apr 20, 2020, 9:19 PM IST

আমরা মন দিয়ে হাত পরিষ্কার করছি । আমরা কনুই দিয়ে মুখ ঢেকে হাঁচা অভ্যেস করছি । আমরা মুখে হাত দিচ্ছি না । আমরা মাস্ক পরছি এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছি । একটা-দুটো নয়, আমরা COVID-19 থেকে নিরাপদে থাকার কয়েকশো নিয়ম মেনে চলছি । কিন্তু তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় আছে, তা হল আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে রক্ষা করা । যখন মহামারী আমাদের জীবন ও জীবিকা ধ্বংস করছে, তখন আমাদের অনাক্রম্যতাকে রক্ষা করাটা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ । আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় । বয়স হলে, তা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে ।

যখন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তখন বাকি সবকিছু পিছনের সারিতে চলে যায় ৷ সংক্রমণের ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে সত্য । যদি প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিকমতো কাজ করে, তাহলে কোনও অ্যান্টিজেন শরীরকে আক্রমণ করতে পারে না । অনেক বয়স্ক মানুষ নভেল কোরোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন । প্রবীণদের মধ্যেই এই রোগের ভয়াবহতা সবথেকে বেশি । তাই, সবার নজর এখন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপরে ।

আসলে, মাতৃগর্ভে থাকার সময় থেকেই এটা আমাদের মধ্যে গড়ে ওঠে । মায়ের জরায়ু থেকে ইমিউনোগ্লোবিউলিনের মাধ্যমে ভ্রূণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পায় । এটা মায়ের স্বাস্থ্যের ওপর, তাঁর আগে কোনও অসুখ হয়েছে কিনা, বা ভ্যাক্সিনেশনের ওপর নির্ভর করে । স্তন্যপানের মাধ্যমে কিছু ইমিউনোগ্লোবিউলিন শিশুর শরীরে প্রবেশ করে । এইভাবে যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জিত হয়, তা কয়েক মাস স্থায়ী হয় । সংক্রমণ, টীকাকরণ ও শরীরে থাকা ব্যাকটেরিয়া তখন একটা স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করে । কিন্তু কৈশোর থেকেই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক অনাক্রম্যতা কমতে থাকে । ষাটের ঘরে পৌঁছলে, এই ক্ষয় আরও দ্রুত হতে থাকে । কিন্তু ভালো দিকটা হল এই যে, বয়স সত্ত্বেও কিছু লোকের বেশি অনাক্রম্যতা থাকে ও কিছু লোকের কম । কয়েকটি সাধারণ পদক্ষেপের মাধ্যমে একজন তাঁর এই ক্ষমতাকে বাড়াতে পারেন ।

1918-র স্প্যানিশ ফ্লু-এর পরে COVID-19’কে দ্বিতীয় বৃহত্তম মহামারী বলে মনে করা হচ্ছে । নভেল কোরোনা ভাইরাস এখন থাকবে ৷ কারণ এর জন্য কোনও ভ্যাকসিন এখনও বের হয়নি । তাই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলা গুরুত্বপূর্ণ । কিন্তু এটা একদিনের কোনও রেস নয় । এর জন্য টানা অভ্যাস প্রয়োজন । আমাদের মনে রাখা উচিত, সামনে যে দীর্ঘ যুদ্ধ অপেক্ষা করছে, তা শুধু নিরবিচ্ছিন্ন

প্রচেষ্টার মাধ্যমেই জেতা সম্ভব । ইমিউন সিস্টেমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাইমাস গ্রন্থি । এটা মেরুদণ্ডের পিছনে অবস্থিত । এখানেই টি-লিম্ফোসাইটরা সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশিক্ষণ নেয় । থাইমাস গ্রন্থি শৈশবে সক্রিয় থাকলেও, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তা নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে । কৈশোরের শুরু থেকে, এই গ্রন্থি বছরে তিন শতাংশ করে ছোট হতে থাকে এবং বার্ধক্যে তা পুরোপুরি মিলিয়ে যায় । এটাই অন্যতম কারণ, যখন বৃদ্ধ বয়সে নতুন কোনও সংক্রমণের মোকাবিলা করাটা কঠিন হয়ে পড়ে । শিশুদের মধ্যে COVID-19 সংক্রমণের সংখ্যা কম ৷ তার একটা কারণ হতে পারে থাইমাস গ্রন্থি ।

কারি পাতায় রয়েছে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট

অনাক্রম্যতা হচ্ছে আমাদের শরীরের দ্বিতীয় জটিলতম ব্যবস্থা । এটা তৈরি হয়েছে কয়েকশো বিভিন্ন ধরনের কোষ এবং জৈব গঠন দিয়ে । আট হাজার জিন তাদের চালনা করছে । এটা দু’টি স্তরে প্রতিরক্ষা দেয় । একটা হচ্ছে সহজাত ক্ষমতা, যা নিয়ে আমরা জন্মাই । এই সিস্টেম নিউট্রোফিল এবং ম্যাক্রোফাজদের তৈরি করে, যা শরীরের যে কোনও অচেনা বস্তুকে তৎক্ষণাৎ মেরে ফেলে । দ্বিতীয়টা হচ্ছে গড়ে ওঠা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা । আমাদের মধ্যে এটা তৈরি হয়, যখন আমাদের শরীরের জীবাণুদের এবং জীবাণুদের ত্যাগ করা রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসে । এই ব্যবস্থা তৈরি T-সেল, B-সেল এবং অ্যান্টিবডিদের দিয়ে । তারা একটু ধীর গতিতে হামলা করে । B-সেলের আবার জোরালো স্মৃতিশক্তিও থাকে । তারা মনে রাখে, অতীতে কোনও জীবাণু আমাদের শরীরকে সংক্রমিত করেছিল । দ্বিতীয়বার সংক্রমণের সময় তারা জীবাণুদের মারতে অ্যান্টিবডি তৈরি করে । ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো ভাইরাস B-সেলকে এড়াতে তাদের জিনগত গঠন বদলে ফেলে ।

নভেল কোরোনা ভাইরাসও সম্ভবত সেই পদ্ধতিতেই কাজ করছে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর চাপ তৈরি করছে । বেশিরভাগ মানুষ তাদের হ্রাস পেতে থাকা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বড় বিপদের কারণ বলে মনে করেন না । আসলে, আমাদের অনাক্রম্যতা বয়ঃসন্ধি থেকেই ক্রমশ কমতে থাকে । আমাদের জীবনচর্যার বিভিন্ন দিক তাতে ইন্ধন জোগায় । যাঁরা অলস জীবনযাপন করেন, ধূমপান বা মদ্যপান করেন, তাঁদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে । সাধারণভাবে, যখন একটা অচেনা বস্তু শরীরে প্রবেশ করে, প্রথমেই পৌঁছে যায় নিউট্রোফিলরা (একধরণের শ্বেত রক্তকণিকা) । তারা সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়তে সাইটোকাইনের মতো উৎসেচক তৈরি করে । বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিউট্রোফিলরাও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে । পুরনো নিউট্রোফিলরা ধীরে কাজ করতে থাকে । এর জেরে একদিকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শিথিল হয়ে যায় এবং অন্যদিকে রোগযন্ত্রণা বাড়ে । নিউট্রোফিলদের অস্বাভাবিক কাজকর্ম মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে । তারা সক্রিয় নিউট্রোফিলদেরও কাজ করতে দেয় না ।

এই সমস্ত কিছুর জেরে প্রবীণরা COVID-19 এর ঝুঁকির মুখে রয়েছেন । নিউট্রোফিলদের কাজকর্ম স্বাভাবিক করার পথও রয়েছে । যে উৎসেচক তাদের চালিত করে, তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে নিউট্রোফিলদেরও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে । দেখা গেছে, কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ দিয়ে এই উৎসেচক বা এনজাইমকেও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে । কিন্তু এর কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও আছে । তাই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে গেলে প্রাকৃতিক উপায়েরই সাহায্য নেওয়া ভালো । এর জন্য কিছুটা কঠিন পরিশ্রম প্রয়োজন । সত্যি বললে, যদি আমরা একটা সুস্থ ও দীর্ঘ জীবনের কামনা করি, তাহলে এই পরিশ্রম ততটাও কঠিন নয় ।

ব্যায়াম- এতে হৃদস্পন্দন বাড়ে ও রক্ত সঞ্চালনের উন্নতি হয় । শ্বেত রক্তকণিকা এবং ইমিউনোগ্লোবিউলিন, যা ক্ষতিকর জীবাণুকে দূরে রাখে, তা ব্যায়ামের সময় দ্রুত শরীরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে । এটা উল্লেখযোগ্য, যে নিউট্রোফিলরা সেই সব মানুষের শরীরে ভালোভাবে কাজ করে, যাঁরা নিয়মিত ব্যায়াম করেন । নিউট্রোফিলরা ভাইরাস আটকাতে নাও পারে, কিন্তু তারা ভাইরাসের দ্বারা তৈরি সেকেন্ডারি ইনফেকশনগুলো প্রতিরোধ করতে পারে । নভেল কোরোনা ভাইরাস আক্রমণের সবথেকে বড় বিপদ হল নিউমোনিয়া । এটা একটা ব্যাকটেরিয়া ঘটিত সংক্রমণ, যা ফুসফুসকে ক্ষতিগ্রস্ত করে । থাইমাসের ক্ষয় হওয়ার হারও কমায় নিয়মিত শরীরচর্চা । এতে আরও বেশি ম্যাক্রোফ্যাগ তৈরি হয়, যারা ইনফ্লেমেশন প্রক্রিয়ায় বাধা দেয় । তাই দিনে অন্তত 10 হাজার স্টেপ হাঁটা উচিত ।

খাবার- আমরা যে যেমন, সে তেমনই খাই । পেটের মধ্যে থাকা প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়াদের দিকে নজর দিতে হবে । পেট ভালো থাকলেই আমরা দীর্ঘ জীবনসহ ভালো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অধিকারী হব । দই ও ঘোলের মতো খাবার ক্ষুদ্রান্তে ভালো ব্যাকটেরিয়াদের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে । ফল ও শাকসবজি খাওয়া বাড়িয়ে দেওয়াও ভালো । সবুজ পাতার ফাইবার ভালো ব্যাকটেরিয়াদের বৃদ্ধি করে ৷ যারা শরীরে অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট এবং মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টস সরবরাহ করে । কারি পাতা, পেঁপে, পালং, লেবু, আদা, রসুন, গোলমরিচ এবং হলুদও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করতে সাহায্য করে ।

গোলমরিচ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়

উপবাস- আমরা ক্যালোরি গ্রহণ কমিয়েও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারি । যারা নিয়মিত উপবাস করেন, তাঁদের সুস্থ শরীর, যথাযথ মানসিক স্বাস্থ্য এবং ভালো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে । ক্যালরি গ্রহণ কমাতে নির্দিষ্ট সময় অন্তর উপবাস করা যেতে পারে । অনেকরকমভাবে এটা করা যায় । যেমন, আমরা দিনের 16 ঘণ্টা না খেয়ে শুধুমাত্র বাকি 8 ঘণ্টায় খাওয়া দাওয়া করতে পারি ।

ওজন নিয়ন্ত্রণ- বেশি ওজন বা কম ওজন, দুটোই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাধা দিতে পারে । B-সেলের কর্মক্ষমতা বয়সের সাথে সাথে কমে যায় । শরীর যথেষ্ট অ্যান্টিবডি তৈরি করতে ব্যর্থ হয় এবং ভ্যাকসিনেশনে ঠিকমতো সাড়া দেয় না । গবেষণায় দেখা গেছে, স্থূলত্বও একই ধরণের সমস্যা তৈরি করে । কারণ ফ্যাটযুক্ত টিস্যু অ্যান্টিবডির কার্যক্ষমতাকে কমিয়ে দেয় । জীবনচর্যাজনিত অসুখকে দূরে রাখতে হলে ঠিকমতো ওজন বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ । ডায়াবেটিস আক্রান্তদের নভেল কোরোনা ভাইরাসের সংক্রমণে ঝুঁকি অনেকটাই বেশি ।

ভিটামিন- নিউট্রোফিল থেকে ঠিকমতো সংকেত না আসা এবং ইনফ্লেমেশন বৃদ্ধি T-সেলের কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে । ভিটামিন-E এই সমস্যা মেটাতে সাহায্য করে । সঠিক পরিমাণে (200 IEU) ভিটামিন গ্রহণ প্রবীণদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারে । অনাক্রম্যতা বাড়াতে একই রকম গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন-D । এটা শ্বেত রক্তকণিকাকে ঠিকমতো কাজ করতে সাহায্য করে । এক হাজার IEU ডোজে এটা গ্রহণ করা যেতে পারে । বেশি পরিমাণে গ্রহণ করলে তা T-সেলের সক্রিয়তাকে প্রভাবিত করতে পারে ।

ভিটামিন-D শ্বেত রক্তকণিকাকে ঠিকমতো কাজ করতে সাহায্য করে

জিঙ্ক- শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ঠিকমতো কাজ করতে গেলে এই খনিজ প্রয়োজনীয় । এটা ভাইরাস সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে । তবে দৈনিক সীমার থেকে এটা বেশি গ্রহণ করা উচিত নয় । প্রতিদিন 0.50 মিলিগ্রামই যথেষ্ট । চিবিয়ে খাওয়ার মতো জিঙ্ক সাপ্লিমেন্ট একটা ভালো বিকল্প ।

ABOUT THE AUTHOR

...view details