যদি এমন একটি সমাজ দেখতে পেতাম, যেখানে খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, লুটপাট, জুলুমবাজির মতো কোনও ঘটনা না ঘটত। সত্যিই, স্বপ্ন কতটা সুন্দর হতে পারে ?
মানুষের প্রতিনিধিরা যখন ধর্ষণের মত অপরাধে জড়িত হয়ে পড়েন, তখন কেবল রাজনীতিই নয়, কলুষিত হয়ে পড়ে গোটা সমাজ । যখন প্রতিটি পাতায় ধর্ষণের খবর চোখে পড়ে তখন ভারতীয় সমাজের চিত্রটা এক ধাক্কায় অনেকটা নিচে নেমে যায় ।
ভারতীয় সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য কিন্তু তেমন নয় । এই সংস্কৃতি প্রতিটি ভালো অনুষ্ঠানকে পালন করতে শেখায় । ভালো ভাবে বাঁচতে শেখায় । কিন্তু, বাস্তবের সঙ্গে এর অনেকটাই পার্থক্য দেখা যায় । যেখানে আইনের সমতার কথা বলা হয়, ক্ষেত্র বিশেষে সেখানেই পার্থক্যটা বেশ চোখে পড়ে । আবার ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, হয়রানির মতো ঘটনার সঠিক-ন্যায্য বিচার করতে ব্যর্থতা চোখে পড়ছে বার বার । অনেক ক্ষেত্রেই নির্যাতিতা সঠিক ন্যায়বিচার পারছেন না ।
যখন একটি মেয়ে ন্যায়বিচারের দাবিতে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন, তখন সঠিক বিচার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই শুরু করে । ন্যায় বিচারের দাবিতে যখন এক জন নির্যাতিতা বার বার আবেদন করেও ব্যর্থ হন, তখন বিচার ব্যবস্থার দায়িত্বজ্ঞানহীনতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে । যখন বার বার অনুরোধ করার পর পুলিশ কোনও পদক্ষেপ করে না, তখন তাদের সদিচ্ছা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করে । সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তথাকথিত পুলিশকর্তারা তদন্ত শুরু করতে বাধ্য হন । এবং মাত্র দেড় মাসের মধ্যে সামনে আসে আসল তথ্য । শেষ পর্যন্ত মূল অভিযুক্তের শাস্তি ঘোষণা করে আদালত ।
উন্নাওয়ের ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কী কী করতে পারে । বিচার প্রার্থনা করে মেয়েটি জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েছে । একাধিকবার অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে । একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাঁকে । অবশেষে সুবিচার পেয়েছে ।
নিচের বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া যাক---
যে কোনও অপরাধ কঠোরভাবে দমন করার জন্য যোগী আদিত্যনাথের সরকার সম্প্রতি বেশ কয়েকটি কঠোর পদক্ষেপ করছে । এই পদক্ষেপের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে 100 জনের বেশি দুষ্কৃতী এবং অসামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে । দেওয়া হয়েছে শাস্তিও ।
যোগী আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার মাত্র তিন মাসের মধ্যে একটি ঘটনার কথা বলা যাক । মানখি গ্রাম থেকে 17 বছরের একটি মেয়ে নিখোঁজ হয়ে যায় । অভিযোগ ওঠে, বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সিং সেঙ্গার এবং তার ভাই অথুপ সিং ওই মেয়েটিকে অপহরণ করে এবং ধর্ষণ করে । মেয়েটির বাবা পুলিশে অভিযোগ করার পর অভিযুক্তদের হাত থেকে মুক্তি মেলে মেয়েটির । যদিও পরে পুলিশ কুলদীপের বিরুদ্ধে কোনও মামলা নিতে চায়নি । উলটে সেঙ্গারকে বিয়ে করে নেওয়ার জন্য মেয়েটির উপর চাপ সৃষ্টি করা হতে থাকে ।
অত্যাচার এখানেই শেষ হয় না । বেআইনি অস্ত্র মামলায় মেয়েটির বাবাকে ফাঁসিয়ে দেয় বিধায়ক । মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে মেয়েটির বাবাকে গ্রেপ্তার করা হয় । এর পর মেয়েটিকে প্রাণে মেরে দেওয়ারও চেষ্টা শুরু হয় । সে সময় সুবিচার পেতে বাধ্য হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে গায়ে আগুন জ্বালিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে মেয়েটি । ঠিক তার পর দিনই পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু হয় মেয়েটির বাবার । এলাহাবাদ হাইকোর্টের নির্দেশে তদন্তভার দেওয়া হয় CBI-এর হাতে । তারা বিধায়ক এবং তার ভাইকে গ্রেপ্তার করে । ধর্ষণের ঘটনার নতুন কর তদন্ত শুরু হয় । কিন্তু, আশ্চর্যজনকভাবে CBI কোনও দ্রুত পদক্ষেপ করতে পারেনি । তদন্ত চলত থেকে এক বছরের বেশি সময় ধরে । আর এর মধ্যে বিধায়ক এবং তার ভাই দলবল নিয়ে নিগৃহীতা এবং তার পরিবারের লোকজনকে নানাভাবে ভয় দেখাতে শুরু করে । শুরু হয় হুমকি । টাকার লোভ দেখানো থেকে শুরু করে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি-- সব কিছুই চলতে থাকে । ইতিমধ্যেই মিথ্যা মামলায় মেয়েটির কাকার দশ বছরের জেল হয় ।
গোটা পরিবারকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করা হয় । লরির ধাক্কায়ে মেয়েটির পরিবারকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় । ভয়ঙ্কর সেই দুর্ঘটনায় মেয়েটি এবং তাঁর আইনজীবী মারাত্মক জখম হন । দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান মেয়েটির দুই জন আত্মীয় ।
এই ভয়ঙ্কর ঘটনার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে গোটা দেশ । বিধায়কের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ করে BJP । দল থেকে তাকে সাসপেন্ড করা হয়। পরবর্তী সময় আদালত সেঙ্গারকে দোষী সাব্যস্ত করে । যাবজ্জীবন কারদণ্ডের সাজা ঘোষণা করা হয় ।
গত জুলাই মাসে মেয়েটিকে যখন প্রাণ মেরে ফেলার চেষ্টা হয় তখনই বিষয়টির দিকে সবার নজর পরে । মামলাটি দিল্লির একটি আদালত থেকে সুপ্রিম কোর্টে স্থানান্তরিত হয় । শুরু হয় জরুরিভিত্তিতে শুনানি । দৈনিক শুনানি চলতে থাকে । দীর্ঘ শুনানির পর বিধায়ককে দোষী সাব্যস্ত করা হয় । তার যাবজ্জীবন সাজা হয় ।
যাই হোক, পুলিশ এবং তদন্তকারী সংস্থা শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করেছিল বিধায়ককে, শেষ পর্যন্ত মেয়েটি ন্যায়বিচার পেয়েছিল । উন্নাওয়ের মতো ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টের কঠোর অবস্থান লক্ষ্য করা যায় । সামান্যতম শিথিলতা না দেখিয়ে দোষীর বিরুদ্ধে আইনত সর্বোচ্চ শাস্তিবিধান দিয়েছে শীর্ষ আদালত । আইন এবং নিয়ম মেনে যে কোনও রকম পদক্ষেপ করতে যে শীর্ষ আদালত বদ্ধপরিকর তা স্পষ্ট করে দেওয়া হয় । এই মামলার শুনানি চলার সময় সুপ্রিম কোর্ট বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করে । এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের
মন্তব্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । এই ঘটনা প্রমাণ করে দেয় গোটা দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ । বুঝিয়ে দেয় গোটা দেশে কী চলছে এই মুহূর্তে । গত সেপ্টেম্বরে শুধুমাত্র উত্তরপ্রদেশে পাঁচটি ধর্ষণ এবং একটি খুনের ঘটনা ঘটেছে । ধর্ষণের ঘটনায় আদালত সাক্ষী দিতে যাওয়ার সময় একটি মেয়ের উপর হামলার ঘটনা ঘটে । প্রথমে মেয়েটিকে মারধর করা হয়, তার পর ছুরি দিয়ে হামলা চালানো হয় । এমনকী, গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয় । আশঙ্কাজনক অবস্থায় মেয়েটিকে হাসপাতালে ভরতি করা হয় । সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয় ।
বাড়ি থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে মেয়েটির উপর হামলা চালানো হয়েছিল । অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় বেশ কিছুটা পথ দৌড়ে পালাতে গিয়েছিল মেয়েটি । কিন্তু পারেনি । হাসপাতালে মৃত্যুর আগে বেশ কয়েকজনের নাম বলে যায় মেয়েটি ।
একই রকম একটি ঘটনা সামনে আসে পঞ্জাবে । ধর্ষণের পর মেয়েটি গিয়েছিল থানায় । পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করতে । কিন্তু অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে পুলিশ । এর পর লজ্জায়-অপমানে আত্মহত্যা করে মেয়েটি । পরিস্থিতি এমন দিকে মোড় নিচ্ছে, যা দেখে মনে হচ্ছে রাজনৈতিক শক্তি যেন অপরাধ করার ক্ষেত্রে শক্তি জোগাচ্ছে । দেশের গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে এটা একটা বড় বিপর্যয় তৈরি করতে পারে । অবিলম্বে এক বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ করতে হবে ।
বাস্তব সত্য হচ্ছে, ভারতের গণতন্ত্র তার চরিত্র থেকে বিচ্যুত হচ্ছে । যখন কোনও রাজনৈতিক দল এমন দুষ্কৃতদের পাশে দাঁড়ায় তখন পরিস্থিতি খুবই খারাপ হয়ে ওঠে । শুধু পাশে দাঁড়ানোই নয়, সংসদ-বিধানসভায় নেতা করে পাঠানো হয় । এই ছবে দেশের গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে মোটেই স্বাস্থ্যকর নয় । চারবারের বিধায়ক ছিল সেঙ্গার । কোনও রাজনৈতিক দলই সেঙ্গারকে উপেক্ষা করার সাহস দেখাতে পারেনি। শুরু করেছিল কংগ্রেসে, তার পর বহুজন সমাজ পার্টি, তৃতীয় বার সমাজবাদী পার্টি এবং চতুর্থ বার গেরুয়া শিবিরের হয়ে বিধায়ক হয়েছিল সেঙ্গার ।
এতে কোনও সন্দেহ নেই, দেশের সর্বত্র এই ছবিটাই দেখা যাচ্ছে । প্রতিটি ক্ষেত্রেই সব কয়টি রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেই একই কথা বলা যায় । যদি ক্ষমতাশীন দলের ক্ষেত্রেই এমনই ছবি ধরা পড়ে তাহলে তা খুবই ভয়ঙ্কর । গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে এটা কোনওদিনই সুস্থতার লক্ষণ হতে পারে না ।
ভয়ে কেউ সেঙ্গারের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারেনি । সেঙ্গারের ভাই জেলা শাসককে খুন করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু, আশ্চর্যজনকভাবে আইন সেক্ষেত্রে কিছু করতে পারেনি । বিষয়টি এখনও বিচারাধীন । উন্নাও মামলায় বিচারপতি মামলা চলাকালীন একটি কথা জানান ।
বলেন, দেশের সংবিধান এবং আইন সব কিছুর উপরে । এই উপলব্ধি বুঝিয়ে দেয়, রাজনীতির ছত্রছায়ায় থাকলেও কেউই আইনের উপরে যেতে পারবেন না । এই পরিস্থিতি তখনই বন্ধ করা সম্ভব, যখন পুলিশ এবং তদন্তকারী সংস্থা কঠোরভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে । যে কোনও রকম অপরাধের ক্ষেত্রে সঠিক পথে তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করবে ।
এখন সময় এসেছে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার । রাজনৈতিক দলগুলিকে এই সব দুর্নীতিপরায়ণ নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে । রাজনীতিকে হাতিয়ার করে কোনও অন্যায় কাজ করা যাবে না । আর তা না হলে পুলিশ-প্রশাসনকে কঠোর পদক্ষেপ করতে হবে ।