কোরোনা নিয়ে দেশের প্রধান সমন্বয়কারী সংস্থা ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চ (ICMR) বলছে, দেশে সংক্রমণ ও পরীক্ষার অনুপাতটা মোটামুটি 4.5 শতাংশ এবং রোগের লেখচিত্র ক্রমেই সরল হচ্ছে । তখনই সংস্থার প্রাক্তন অতিরিক্ত ডিরেক্টর জেনেরাল সুজিতকুমার ভট্টাচার্য বলছেন, বিস্তারিত পরীক্ষালব্ধ তথ্য সামনে না এলে ছবিটা পরিষ্কার হবে না । আরও পরীক্ষা করার উপরে জোর দিতে বলেছেন তিনি ।
ETV ভারতের নিউজ় কো-অর্ডিনেটর দীপঙ্কর বসুর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে ইমিউনোলজি ও মাইক্রোবায়োলজির বিশেষজ্ঞ এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কলেরা অ্যান্ড এনটারিক ডিজ়িজ়-এর (NICED) প্রাক্তন অধিকর্তা সুজিত ভট্টাচার্য দেশ ও বিশ্বে COVID-19-এর সংক্রমণ নিয়ে তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছেন । কোরোনা মোকাবিলায় আমাদের দেশের কী করা উচিত, তার উপরও বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন ।
প্রশ্ন- অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা কোরোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য কাজ করছেন । গবেষণা সফল হলে নতুন প্রতিষেধকের হাত ধরে এই প্যানডেমিকের হাত থেকে সম্ভবত আমরা মুক্তি পেতে পারব । গবেষকরা ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন যে, তাঁরা SARS-CoV-2 এর জিনোম সিকোয়েন্স জেনে ফেলেছেন এবং DNA প্রক্রিয়ার সাহায্যে একটি অ্যান্টিজেন তৈরির চেষ্টা করছেন । এই বিষয়টা আপনার কাছে কতটা সদর্থক বলে মনে হচ্ছে?
- সুজিতকুমার- এটা ঠিকই যে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা COVID-19-এর একটি প্রতিষেধক তৈরির চেষ্টা করছেন। তাঁরা ইতিমধ্যেই দু’জন সুস্থ মানুষকে এই প্রতিষেধক দিয়েছেন এবং তার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছেন । এটা একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ের (ফেজ় 1) পরীক্ষা, যেখানে নিরাপত্তা এবং কিছুটা কার্যক্ষমতা পরখ করা হবে । পরবর্তী পর্বের পরীক্ষার জন্যও প্রস্তুত অনেকে । এই প্রতিষেধক যে সফল হবে সে বিষয়ে 80 শতাংশ নিশ্চিত এই গবেষণার ট্রায়াল কো-অর্ডিনেটর । পরীক্ষা সফল হলে বিপুল সংখ্যক প্রতিষেধক তৈরি করতে হবে এবং সে ক্ষেত্রে ভারত হবে তার অন্যতম অংশীদার । প্রতিষেধক প্রথমে ব্রিটেনের মানুষদের দেওয়া হবে এবং তার পর বাকি বিশ্বকে । আমাদের পরীক্ষার ফলের জন্য এখন অপেক্ষা করতে হবে ।
প্রশ্ন- ICMR বলছে এ দেশে মোটামুটি 4.5 শতাংশ মানুষ কোরোনা পজ়িটিভ এবং আক্রান্তের হারের লেখচিত্র প্রায় সরলরেখায় পরিণত । আপনি কি এই তথ্যের সঙ্গে একমত?
- সুজিতকুমার-এর সঙ্গে দ্বিমত হওয়ার কোনও কারণ নেই । তবে এ ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই নমুনার আকার দেখতে হবে। আর এর পরই নির্দিষ্টভাবে কোনও সিদ্ধান্তে আসা উচিত হবে। আমরা কোনও অবস্থাতেই অনুমানভিত্তিক ফলের উপর নির্ভর করতে পারি না।
প্রশ্ন- আপনার কি মনে হয় দেশজুড়ে আরও অনেক বেশি সংখ্যক পরীক্ষা হওয়া উচিত ছিল? বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে, যেখানে তেমন ভাবে পরীক্ষা হয়নি? এর ফলে কি আমরা সঠিক চিত্রটা পাচ্ছি না?
- সুজিতকুমার-হ্যাঁ, এটা একদম ঠিক। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই যে আরও অনেক বেশি পরীক্ষা হওয়া উচিত ছিল এবং যত বেশি পরীক্ষা হবে ততই চিত্রটা পরিষ্কার হবে । তবে এ ক্ষেত্রে টেস্টিং কিটের সংখ্যা, দেশের বড় অংশের মানুষের কাছে পৌঁছানো, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মতো বিষয়গুলিকেও মাথায় রাখতে হবে ।
প্রশ্ন- জানা গিয়েছে, চিন থেকে আসা বেশ কিছু ব়্যাপিড অ্যান্টিবডি ভিত্তিক রক্ত পরীক্ষার কিট ত্রুটিপূর্ণ ছিল এবং ICMR সেগুলি বাতিল করেছে। যেহেতু RT-PCR পরীক্ষার ফলাফল মিলতে যথেষ্ট সময় লাগে তাই আপনার কি মনে হয়, COVID-19 রোগীদের পরীক্ষা করতে ব়্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট কিট ছাড়া অন্য কোনও ব্যবস্থা করা সম্ভব?
- সুজিতকুমার-দেখুন, এই ভাইরাসের গতিপ্রকৃতি ও সংক্রমণের হার জানতে পরীক্ষার কোনও বিকল্প নেই । এটা শুধুমাত্র টেস্ট কিটের ব্যবস্থা করার বিষয় নয়, সমস্যার একটা নির্দিষ্ট সমাধান করাটাই বেশি জরুরি। এ বিষয়ে দিল্লি IIT- র সম্পূর্ণ দেশীয় পদ্ধতিতে তৈরি টেস্টিং কিট খুবই কাজের। আমরা আশা করছি খুব শীঘ্রই সস্তায় আরও কিছু টেস্টিং কিট বাজারে চলে আসবে । এই বিষয়ে বিশ্বজুড়ে প্রচুর পরিমাণে গবেষণা চলছে এবং আমি নিশ্চিত যে খুব শীঘ্রই খুব ভালো খবর পাব।
প্রশ্ন- কোরোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে ICMR ও সরকারের কাছে আপনার উপদেশ কী?
- সুজিতকুমার-ভারতে কোরোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একেবারে সামনের সারিতে রয়েছে ICMR। তবে এই সংকটের সময়কালে ICMR-কে আমি কিছু পরামর্শ দিতে চাই0 । প্রথমত, আরও সুনির্দিষ্ট পরীক্ষা পদ্ধতির জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে । টানা পরীক্ষা করে একটা নির্দিষ্ট ও উপযোগী চিকিৎসা ব্যবস্থা খুঁজে বের করতে হবে। আমরা বিক্ষিপ্তভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যেতে পারি না। ICMR-এর বাইরেও এই বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তি ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে যত সম্ভব মতামত নিতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো এ দেশেও যে প্রতিষেধক তৈরির চেষ্টা চলছে, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। এ বিষয়ে ICMR-কে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে এবং গবেষণার জন্য আরও বেশি করে অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। COVID-19 রোগীদের চিকিৎসা ও খেয়াল রাখার মতো বিষয়গুলি শুধুমাত্র ঘোষণার মাধ্যমে হলে হবে না। আমাদের মতো বিশাল দেশে বেশির ভাগ মানুষের কাছে পৌঁছাতে, তাঁদের সঠিকভাবে সাহায্য করতে প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট প্রশিক্ষণের। এক জন গবেষক হিসেবে আমি সব সময়ই চাইব আরও উন্নতমানের পরীক্ষা হোক এবং ICMR-এর গবেষণাপত্রগুলি প্রকাশিত করা হোক । এর ফলে জ্ঞান আদান-প্রদানের পরিমাণ বাড়বে । সব শেষে, COVID-19 সংক্রান্ত সব ধরনের পরীক্ষার দিকে নজর রাখতে একটা টাস্ক ফোর্স তৈরি করা উচিত ।
প্রশ্ন- কোরোনা ভাইরাস মোকাবিলায় BCG বা ম্যালেরিয়ার ওষুধ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের প্রয়োগে কোনও সুনির্দিষ্ট ফলাফল পাওয়া যায়নি । আপনার মতে এর কারণ কী হতে পারে?
- সুজিতকুমার- BCG এমনিতেই নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে দেরি করে প্রতিক্রিয়া দেখায়। ফলে COVID-19-এর ক্ষেত্রে এর সফল হওয়ার কোনও কারণ আমি দেখি না। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন হার্টের পক্ষে খুবই খারাপ। এটি হার্টের গতিকেও কমিয়ে দেয় । এটা যে কার্যকর নয়, তা হালের পরীক্ষাগুলো থেকে প্রমাণ হয়েছে। তাই বিকল্প খুঁজে বের করতেই হবে। একটা সঠিক প্রতিষেকই এর সব সমস্যার সঠিক সমাধান করতে পারে ।
প্রশ্ন- লকডাউনের মেয়াদ বেড়েই চলেছে। লকডাউন উঠে যাওয়ার পর আপনার কি মনে হয়, শুধুমাত্র বয়স্ক ব্যক্তিদেরই বিপদ থাকবে? না কি বাকিদেরও একই রকম ভয় থাকবে?
- সুজিতকুমার- প্রত্যেকেরই বিপদ থাকবে। এ ছাড়া আমরা কোরোনা থেকে সুস্থ হয়ে ফেরা ব্যক্তিদের শরীরে ফের সংক্রমণ হতে দেখেছি। যদিও, অর্থনীতির কথা চিন্তা করলে ইউরোপ এবং অন্য বেশ কয়েকটি দেশ যে ভাবে ধাপে ধাপে লকডাউন তোলার কথা ভাবছে, সে ভাবে ধাপে ধাপে এ দেশেও লকডাউন তোলা উচিত। হঠাৎ করে একসঙ্গে পুরো দেশে লকডাউন তুলে নিলে তার পরিণাম ভয়ঙ্কর হতে পারে। এর প্রধান কারণ আমাদের দেশের বিপুল জনসংখ্যা ।