পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / bharat

শাহিনবাগের আন্দোলন ও নারীশক্তি

নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের প্রতিবাদে সত্যাগ্রহের পথে হেঁটে প্রতিবাদ জানান সাধারণ মানুষ । নতুন নাগরিকত্ব আইন (CAA), প্রস্তাবিত জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (NRC) এবং জাতীয় জনগণনা পঞ্জির (NRP) বিরুদ্ধে রাস্তায় নাগাড়ে বসে আন্দোলন চলে প্রায় 40 দিন । প্রবল ঠান্ডা, পুলিশের আর্জি (অভিযোগ, হুমকিও) আর রাস্তা খালি করার চাপের মুখেও প্রতিবাদ প্রত্যাহারের প্রশ্ন ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেন শাহিনবাগের মহিলারা । শাহিনবাগের এই প্রতিবাদ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ।

Shaheenbagh
শাহীনবাগ

By

Published : Jan 22, 2020, 11:00 AM IST

ভারতের সংসদে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) পাশ হয় 11 ডিসেম্বর, 2019 তে । তার পরই জনগণের একটা একটা অংশ এই আইনের প্রতিবাদে ক্ষোভে ফেটে পড়েন । দেশের নানা প্রান্তের মানুষ এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন । নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, ভারতের প্রতিবেশী বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে নির্যাতিত হয়ে যে অমুসলিম সংখ্যালঘুরা (হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, ক্রিশ্চিয়ান, জৈন ও পার্সি) 2014 সালের 31 ডিসেম্বরের আগে ভারতে শরণার্থী হিসেবে এসেছে তাদের এদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে । এই সংশোধিত আইনে মুসলিমদের এই সুবিধা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে । শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের ধর্মীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য এই আইনটির বিরুদ্ধে ভারতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ ও সমালোচনা শুরু হয়েছে । এই আইনটির বিরুদ্ধে মূল সমালোচনাটি হল, নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে শরণার্থীদের ধর্মীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিকে অপমান করা হয়েছে । সমালোচকরা বলছেন, সংবিধানের 14 নম্বর ধারায় ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে যে সমান অধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তা এই আইনের দ্বারা লঙ্ঘিত হয়েছে । একই মত পোষণ করেন রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার । হাইকমিশনারের মুখপাত্র বলেছেন, ‘‘নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, 2019 সকল মানুষের সমান অধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারত যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তার পরিপন্থী । এই আইন নাগরিকত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে বিভেদ তৈরি করবে।’’

এই আইনের প্রতিবাদে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের রাজ্যগুলিতে তুমুল বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ শুরু হয়েছে । কারণ ওই রাজ্যগুলির ভূমিপুত্রদের আশঙ্কা, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, 2019 – এর জেরে প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে আগত বহু সংখ্যক অনুপ্রবেশকারী বৈধ নাগরিকত্ব পেয়ে যাবে আর তার ফলে ওই রাজ্যগুলিতে জাতিগত ও ভাষাগত সমস্যা তৈরি হবে । আর তার জেরে আগামীদিনে ওই রাজ্যগুলির ভূমিপুত্ররা সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে । এই আইনের প্রতিবাদে মুসলিমদের একটা বড় অংশ সরব হয়েছে । তাদের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় সরকার মুসলিম বিদ্বেষী ও বিভেদকামী । কারণ এই আইন ভারতে শরণার্থী হিসেবে আগত মুসলিমদের নাগরিকত্ব প্রদান থেকে বঞ্চিত করবে । নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, 2019 প্রকারান্তরে যেটা বলতে চেয়েছে তা হল, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানে সেই দেশের অ-মুসলিম সংখ্যালঘুরা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার আর তার জেরে ওই দেশগুলিতে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা যথেষ্ট কমে গিয়েছে । তাই এটা নিশ্চিত ছিল যে, ওই দেশগুলি এবং তাদের সমর্থকরা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ জানাবে । যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এই আইনের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে । মন্ত্রকের তরফে নাগরিকত্ব আইনের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, প্রথমত, 1987 সালের 1 জুলাইয়ের আগে যাঁরা ভারতে জন্মেছেন, তাঁরা সকলেই এ দেশের নাগরিক। দ্বিতীয়ত, 1 জুলাই 1987 সাল থেকে 3 ডিসেম্বর 2004-এর মধ্যে যাঁরা জন্মেছেন এবং যাঁদের বাবা-মায়ের মধ্যে কোনও এক জন ভারতের নাগরিক, তিনিও ভারতীয়। তৃতীয়ত, 3 ডিসেম্বর 2004 সালের পরে যাঁরা জন্মেছেন এবং যাঁদের বাবা-মা দু’জনেই ভারতের নাগরিক কিংবা এক জন ভারতীয় নাগরিক এবং অন্য জন সেই সময়ে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নন, তাঁরাও ভারতের নাগরিক হিসেবে গণ্য হবেন ।

নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের প্রতিবাদে সত্যাগ্রহের পথে হেঁটে প্রতিবাদ জানান সাধারণ মানুষ । নতুন নাগরিকত্ব আইন (CAA), প্রস্তাবিত জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (NRC) এবং জাতীয় জনগণনা পঞ্জির (NRP) বিরুদ্ধে রাস্তায় নাগাড়ে বসে আন্দোলন চলে প্রায় 40 দিন । প্রবল ঠান্ডা, পুলিশের আর্জি (অভিযোগ, হুমকিও) আর রাস্তা খালি করার চাপের মুখেও প্রতিবাদ প্রত্যাহারের প্রশ্ন ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেন শাহিনবাগের মহিলারা । শাহিনবাগের এই প্রতিবাদ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে । এই সত্যাগ্রহ আন্দোলন এতটাই জনপ্রিয় হয়ো ওঠে যে কংগ্রেস নেতা শশী থারুর, আম আদমি পার্টির বেশ কয়েকজন নেতা, সমাজকর্মী মেধা পাটকর-সহ অন্যান্যরা আন্দোলনে যোগ দেন এবং আন্দোলনকারীদের সমর্থন জানান । যখন বিরোধীরা শাহিনবাগের আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়ান, তাদের সমর্থন করেন, ঠিক তখনই BJP রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি মোকাবিলা করার চেষ্টা শুরু করে । গেরুয়া শিবির থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে, দৈনিক মজুরির বিনিময়ে আন্দোলনে বসেছেন শাহিনবাগের কিছু মহিলা । এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা এই আন্দোলেন থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আলোচনায় অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয় । হাজারো চেষ্টা-নির্দেশ-হুমকি দিয়েও আন্দোলনকারীদের তুলতে ব্যর্থ হয় পুলিশ । শাহিনবাগের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে একটি প্রশ্ন সামনে চলে আসে । কেন এই আন্দোলেন সামনের সারিতে মহিলারা ।

এর প্রথম কারণ ছিল আবেগ । শাহিনবাগের আন্দোলনে মহিলাদের অংশ গ্রহণের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল আবেগ । কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, তাতে মহিলা-শিশুরা অংশ নিয়ে একটা অবেগের সূচনা করেছিল । একটা অবেগ এবং পারস্পরিক মেলবন্ধনের ছবিটা কতটা দৃঢ় হয়েছিল, তার একটা উদাহরণ দেওয়া যাক । সব ঝাঁ-চকচকে শপিং মল এবং দোকানের সঙ্গে শাহিনবাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের এত দিন বড়সড় দূরত্ব ছিল, এখন সেই সব দোকানের মালিক-কর্মীরাই তাদের পরম বন্ধু হয়ে ওঠেন । আন্দোলনকারীরাই গড়ে তোলেন স্বেচ্ছাসেবকের দল। তারাই 24 ঘণ্টা নজর রাখেন দোকানের ওপর। কলেজ পড়ুয়া রিয়াজ়ের কথায়, ‘‘একটা দোকানের শাটারে আমরা পোস্টার লাগাতে দিইনি। বাইরের কোনও ভুলভাল লোক এখানে ঢুকে যাতে দোকান বা মলের সম্পত্তি নষ্ট না করে, সে দিকে কড়া নজর রাখা হচ্ছে।’’

দোকান-মালিকদের একটা অংশ খাবার জোগানের দায়িত্ব নেন। প্যাকেটে ভরে কাজু, কিশমিশ, আখরোট বিলি করতে দেখা গিয়েছিল কিশোর থেকে বৃদ্ধকে । কথায় কথায় বৃদ্ধ বলে ফেললেন, ‘‘ঠিকঠাক খায়, নাকি ভুখা থাকে জানি না তো ৷ তাই খাওয়াতে এসেছি ।’’ শাহিনবাগের এই আন্দোলন মনে করিয়ে দিয়েছিল 1970-80 দশকে আমেরিকায় সমান অধিকারের দাবিতে মিছিলে হাঁটার কথা । যেখানে সমান অধিকারের দাবিতে পথে নেমেছিলেন লাখ লাখ মহিলা । একই রকম পরিস্থিতি দেখা গিয়েছিল 2000 সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে । সেখানে বন্দুক আইনের দাবিতে পথে নেমেছিলেন লাখ লাখ মহিলা । তাঁদের দাবি ছিল নিরাপত্তার। ভারতের দিকে নজর দেওয়া যাক । মণিপুরের মহিলারা এক তীব্র প্রতিবাদ-আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন । দাবি ছিল একটাই, নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা । শাহিনবাগে মহিলারা যে ভাবে আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন, তার ফলে পুলিশের পক্ষে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করাতে কঠোর থেকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হয় ।

শাহিনবাগে মহিলাদের এই ব্যাপক অংশগ্রহন আরও একটি দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ, তা হল আন্দোলন শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টির বিরুদ্ধে একটা বড় ধাক্কা । এমনিতেই ভারতের BJP এবং মুলিমদের মধ্যে আদর্শগত সংঘাত রয়েছে । আর এই প্রেক্ষিতে মুসলিমদের সমর্থন বিশেষভাবে জরুরি ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে । 2017 সালে তিন তালাক বিলের উত্থাপন এবং 2019 সালে 30 জুলাই বহু বিতর্কের পর সংসদের তিন তালাক বিল পাশ হওয়ার পর স্বাভাবিক ভাবেই ধারনা তৈরি হয়েছিল, BJP সরকার মুসলিম মহিলাদের পাশে রয়েছে, তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তার করে একাধিক পদক্ষেপ করছে । তিন তালাক বিল পাশ করিয়ে BJP তাদের মুসলিম সমর্থনের একটা ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করে । কিন্তু, এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, যেভাবে শাহিনবাগে মহিলারা সামনে থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি অনাস্থাই তীব্র হয় । এই আন্দোলন একই সঙ্গে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল আন্দোলনের তীব্রতা । পাশাপাশি নীতিনির্ধারক এবং সমাজের কাছে একটা বার্তাও পৌঁছে দিতে পারলেন আন্দোলনরত মহিলারা । এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে অনেকে শারীরিক অসুস্থতাতে পাথেয় করেই আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন । শাহিনবাগের মহিলাদের প্রতিবাদে অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন যেভাবে বলবৎ করার চেষ্টা হয়েছে তার বিরুদ্ধে ।

নবপ্রভাতের নতুন সূর্যোদয়ের আশায় পেরিয়ে চলেছিল একের পর এক কোজাগরি রাত্রিযাপন। দ্রোহের আগুনে তপ্ত শাহিনবাগ যেন শীতের প্রাবল্যকেও ম্লান করে দিয়েছে । কেউ ধর্মীয় স্লোগান দিলে তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে বারণ করা হয়েছে, তিনিও তৎক্ষণাৎ নিজেকে সংশোধন করে নিয়েছেন । CAA-বিরোধী আন্দোলন শুধুমাত্র মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আবদ্ধ থাকলে ধর্মীয় মেরুকরণ আরও তীব্রতর হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আন্দোলনকারীরা এ-ও জানেন, অমুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা যোগ না দিলে, এই আন্দোলন অচিরেই নিষ্প্রভ হয়ে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা ছিল । শাহিনবাগের শান্তিপূর্ণ ধরনা-অবস্থানের এই আন্দোলন এইখানেই অন্য আন্দোলনের চেয়ে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। এখানে মুসলিম-অমুসলিম বিবিধ মানুষের একত্র সহাবস্থানই আন্দোলনের ভিত্তিকে আরও সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছে ।

ABOUT THE AUTHOR

...view details