ভারতের সংসদে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) পাশ হয় 11 ডিসেম্বর, 2019 তে । তার পরই জনগণের একটা একটা অংশ এই আইনের প্রতিবাদে ক্ষোভে ফেটে পড়েন । দেশের নানা প্রান্তের মানুষ এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন । নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, ভারতের প্রতিবেশী বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে নির্যাতিত হয়ে যে অমুসলিম সংখ্যালঘুরা (হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, ক্রিশ্চিয়ান, জৈন ও পার্সি) 2014 সালের 31 ডিসেম্বরের আগে ভারতে শরণার্থী হিসেবে এসেছে তাদের এদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে । এই সংশোধিত আইনে মুসলিমদের এই সুবিধা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে । শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের ধর্মীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য এই আইনটির বিরুদ্ধে ভারতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ ও সমালোচনা শুরু হয়েছে । এই আইনটির বিরুদ্ধে মূল সমালোচনাটি হল, নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে শরণার্থীদের ধর্মীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিকে অপমান করা হয়েছে । সমালোচকরা বলছেন, সংবিধানের 14 নম্বর ধারায় ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে যে সমান অধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তা এই আইনের দ্বারা লঙ্ঘিত হয়েছে । একই মত পোষণ করেন রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার । হাইকমিশনারের মুখপাত্র বলেছেন, ‘‘নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, 2019 সকল মানুষের সমান অধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারত যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তার পরিপন্থী । এই আইন নাগরিকত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে বিভেদ তৈরি করবে।’’
এই আইনের প্রতিবাদে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের রাজ্যগুলিতে তুমুল বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ শুরু হয়েছে । কারণ ওই রাজ্যগুলির ভূমিপুত্রদের আশঙ্কা, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, 2019 – এর জেরে প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে আগত বহু সংখ্যক অনুপ্রবেশকারী বৈধ নাগরিকত্ব পেয়ে যাবে আর তার ফলে ওই রাজ্যগুলিতে জাতিগত ও ভাষাগত সমস্যা তৈরি হবে । আর তার জেরে আগামীদিনে ওই রাজ্যগুলির ভূমিপুত্ররা সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে । এই আইনের প্রতিবাদে মুসলিমদের একটা বড় অংশ সরব হয়েছে । তাদের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় সরকার মুসলিম বিদ্বেষী ও বিভেদকামী । কারণ এই আইন ভারতে শরণার্থী হিসেবে আগত মুসলিমদের নাগরিকত্ব প্রদান থেকে বঞ্চিত করবে । নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, 2019 প্রকারান্তরে যেটা বলতে চেয়েছে তা হল, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানে সেই দেশের অ-মুসলিম সংখ্যালঘুরা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার আর তার জেরে ওই দেশগুলিতে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা যথেষ্ট কমে গিয়েছে । তাই এটা নিশ্চিত ছিল যে, ওই দেশগুলি এবং তাদের সমর্থকরা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ জানাবে । যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এই আইনের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে । মন্ত্রকের তরফে নাগরিকত্ব আইনের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, প্রথমত, 1987 সালের 1 জুলাইয়ের আগে যাঁরা ভারতে জন্মেছেন, তাঁরা সকলেই এ দেশের নাগরিক। দ্বিতীয়ত, 1 জুলাই 1987 সাল থেকে 3 ডিসেম্বর 2004-এর মধ্যে যাঁরা জন্মেছেন এবং যাঁদের বাবা-মায়ের মধ্যে কোনও এক জন ভারতের নাগরিক, তিনিও ভারতীয়। তৃতীয়ত, 3 ডিসেম্বর 2004 সালের পরে যাঁরা জন্মেছেন এবং যাঁদের বাবা-মা দু’জনেই ভারতের নাগরিক কিংবা এক জন ভারতীয় নাগরিক এবং অন্য জন সেই সময়ে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নন, তাঁরাও ভারতের নাগরিক হিসেবে গণ্য হবেন ।
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের প্রতিবাদে সত্যাগ্রহের পথে হেঁটে প্রতিবাদ জানান সাধারণ মানুষ । নতুন নাগরিকত্ব আইন (CAA), প্রস্তাবিত জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (NRC) এবং জাতীয় জনগণনা পঞ্জির (NRP) বিরুদ্ধে রাস্তায় নাগাড়ে বসে আন্দোলন চলে প্রায় 40 দিন । প্রবল ঠান্ডা, পুলিশের আর্জি (অভিযোগ, হুমকিও) আর রাস্তা খালি করার চাপের মুখেও প্রতিবাদ প্রত্যাহারের প্রশ্ন ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেন শাহিনবাগের মহিলারা । শাহিনবাগের এই প্রতিবাদ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে । এই সত্যাগ্রহ আন্দোলন এতটাই জনপ্রিয় হয়ো ওঠে যে কংগ্রেস নেতা শশী থারুর, আম আদমি পার্টির বেশ কয়েকজন নেতা, সমাজকর্মী মেধা পাটকর-সহ অন্যান্যরা আন্দোলনে যোগ দেন এবং আন্দোলনকারীদের সমর্থন জানান । যখন বিরোধীরা শাহিনবাগের আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়ান, তাদের সমর্থন করেন, ঠিক তখনই BJP রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি মোকাবিলা করার চেষ্টা শুরু করে । গেরুয়া শিবির থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে, দৈনিক মজুরির বিনিময়ে আন্দোলনে বসেছেন শাহিনবাগের কিছু মহিলা । এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা এই আন্দোলেন থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আলোচনায় অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয় । হাজারো চেষ্টা-নির্দেশ-হুমকি দিয়েও আন্দোলনকারীদের তুলতে ব্যর্থ হয় পুলিশ । শাহিনবাগের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে একটি প্রশ্ন সামনে চলে আসে । কেন এই আন্দোলেন সামনের সারিতে মহিলারা ।