দিল্লি, 14 মার্চ : বিশ্বজুড়ে আতঙ্কের স্রোত বইয়ে দিচ্ছে নোভেল কোরোনা ভাইরাস । ক্ষুদ্রতম সংক্রমণকারী মানুষের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে । চিনের মতো শক্তিশালী দেশের সামনে এই ভাইরাস একটা গুরুতর চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে । বিশ্ব অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলছে এই সংক্রমণ । বর্তমান পরিস্থিতিতে, যেখানে অ্যামেরিকা বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো সুপার পাওয়াররাও ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া আটকাতে পারেনি, সেখানে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন রয়েছে । এই পরিস্থিতিতে 130 কোটির দেশের জন স্বাস্থ্য পরিস্থিতির পুনর্মূল্যায়ণ করা প্রয়োজন ।
প্রসূতির মৃত্যু এবং শিশুমৃত্যুর হার কমাতে ভারতের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি হলেও, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত অনেক বিষয়কেই পিছনের সারিতে ঠেলে রাখা হয়েছে । স্বাস্থ্যক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড থেকে এখনও বহু দূরে ভারত । বিভিন্ন রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এবং পরিষেবার লভ্যতার মধ্যে বিপুল ফারাক রয়েছে । দেশের আর্থিক উন্নতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল সুস্থ জনতা । এই জন্যই বহু দেশ তাদের GDP-র একটা বিরাট অংশ জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যয় করে । ওয়ার্ল্ড হেল্থ ইনডেক্স সমীক্ষায় 190টি দেশের মধ্য়ে 141তম স্থানে রয়েছে ভারত । কোভিড-19 আতঙ্কের প্রেক্ষিতে, বর্তমান ব্যবস্থার ফাঁকফোকরগুলো নিয়ে আলোচনা করার এবং সতর্কতামূলক পদক্ষেপগুলোর পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন আছে ।
সাম্প্রতিক কেন্দ্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ হয়েছে 69,000 কোটি টাকা, যা GDP-র 1 শতাংশ । বর্তমানে স্বাস্থ্যসম্পর্কিত সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করতে এই বরাদ্দ একেবারেই পর্যাপ্ত নয় । যোজনা কমিশনের 2011 সালের পরামর্শ মেনে, GDP-র 2.5 শতাংশ স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বরাদ্দ করা থেকে আমরা এখনও অনেক দূরে । জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত করতে, 2018 সালের ডিসেম্বর মাসে আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্প শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী মোদি । সরকার এই প্রকল্পকে বিশ্বের সবথেকে বড় স্বাস্থ্যপ্রকল্প বলে বর্ণনা দিয়েছিল । গরিব পরিবারগুলোকে 5 লাখ টাকার স্বাস্থ্যবিমা দেয় এই প্রকল্প । সামাজিক-অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রায় 10 কোটি গরিব পরিবার, যারা দেশের জনসংখ্যার 40 শতাংশ, এই প্রকল্পের আওতায় আসার যোগ্য । এখনও পর্যন্ত, 72 লাখ মানুষ এই প্রকল্পের মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন । কিন্তু এই প্রকল্প শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কয়েকটি রোগের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ।
2022 সালের মধ্যে 1.5 লাখ স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি করতে চায় সরকার । এখনও পর্যন্ত, লক্ষ্যমাত্রার এক-চতুর্থাংশেও পৌঁছনো যায়নি । আয়ুষ্মান ভারতের সর্বোচ্চ দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা, ন্যাশনাল হেলথ মিশনের রিপোর্টে বিমার টাকা মেটানোয় ব্যবধানের কথা উঠে এসেছে । বিহার, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশের মতো গরিব রাজ্যগুলোতে কম টাকা খরচ করা হচ্ছে । দেশের মধ্যে সবথেকে বেশি বিমা করিয়েছে কেরালা । যেখানে সবথেকে বেশি প্রয়োজন, সেখানেই বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ কম, যা প্রকল্পের ব্যর্থতার দিকেই ইঙ্গিত করছে । স্মার্ট সিটি মিশনের আওতায় থাকা দেশের 115টি জেলার কোনওটিই আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্প চালু করেনি । বেসরকারি হাসপাতালগুলো এই প্রকল্পের আওতায় আসতে আগ্রহী নয় । মহারাষ্ট্র ও উত্তরাখণ্ড ছাড়া, বিভিন্ন রাজ্যের শুধুমাত্র উন্নত জেলাগুলোর বেসরকারি স্বাস্থ্যপরিষেবা প্রদানকারীরা এই প্রকল্পে নিজেদের অন্তর্ভূক্ত করেছে । সরকারি জনগণনা অনুযায়ী, প্রতি 1456 জন মানুষ পিছু একজন চিকিৎসক রয়েছেন । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, প্রতি 1000 জনের জন্য একজন চিকিৎসক থাকা উচিত । এই অনুপাত এবং চিকিৎসকদের সংখ্যা বাড়াতে, সরকার ঘোষণা করেছে যে জেলা হাসপাতালসংলগ্ন মেডিকেল কলেজ তৈরি করা হবে । বর্তমানে, দেশজুড়ে 526টি সরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে । গত দু'বছরে, এই কলেজগুলিতে আসন সংখ্যা বেড়ে এক লাখে পৌঁছেছে ।
সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলির মধ্যে ব্যবধান সবসময় বেড়েই চলেছে । প্রায় 58 শতাংশ হাসপাতালই হল বেসরকারি । 81 শতাংশ চিকিৎসক বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করেন । ন্যাশনাল বোর্ড অফ এক্সামিনেশনের অধীনে স্নাতকোত্তর কোর্স চালু করতে চায় সরকার । মেডিকেল শিক্ষাকে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে । সরকার পরিচালিত হাসপাতালগুলিতে MBBS-র উপরে কোনও প্রশিক্ষণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সুযোগসুবিধার অভাব রয়েছে । প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের সংখ্যায় স্পষ্ট ঘাটতি রয়েছে । কর্পোরেট হাসপাতালগুলোকে সরকার কর ছাড় দেওয়ায়, তারা উচ্চমানের মেডিকেল উপকরণ কিনতে পারবে । বেসরকারি ক্ষেত্রের চিকিৎসকদের মধ্যে কয়েকজন বিদেশে গিয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতেও সক্ষম । ন্যাশনাল বোর্ড অফ এগজ়্যামিনেশনের মাধ্যমে স্নাতকোত্তর স্তরে পড়ুয়াদের ভরতি করতে পারবে কলেজগুলো । এটা একটা কঠিন সত্য, যে এই পড়ুয়াদের বেশিরভাগই ডিউটি ডক্টর হিসেবে কাজ করে, এবং এদের ন্যূনতম শংসাপত্রই দেওয়া হয় ।
PPP মডেলে জেলা হাসপাতালগুলোকে বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে নীতি আয়োগ । বহু বেসরকারি মেডিকেল কলেজের যথেষ্ট সংখ্যায় অনুমোদিত হাসপাতাল নেই । নীতি আয়োগ রাজ্য সরকারগুলোকে পরামর্শ দিয়েছে, যাতে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল গড়ে তুলতে সস্তায় জমি দেওয়া হয় । কয়েকটি রাজ্য এর সঙ্গে একমত নয় । যদি বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো জেলা হাসপাতালগুলোর সঙ্গে যুক্তও হয়, তাহলেও এই গ্যারান্টি নেই যে চিকিৎসা কর্মীর অভাব মিটবে । দেশের মেডিকেল পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে । দেশে জনস্বাস্থ্যের চাহিদা মেটাতে প্রয়োজন 5,38,305 কোটি টাকা । স্বাস্থ্যমন্ত্রক পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের কাছে এই দাবিও রেখেছে । তবুও, এই ক্ষেত্রে কোনও ভদ্রস্থ বরাদ্দ হয়নি । নূন্যতম স্বাস্থ্য পরিকাঠামো শক্তিশালী করার প্রয়োজন রয়েছে এখন ।
বিশ্বের স্বাস্থ্যবান দেশগুলোর মধ্যে ভারত 120তম স্থানে । তালিকায় প্রথম স্পেন, দ্বিতীয় স্থানে ইট্যালি । এটা উল্লেখ্য, যে করোনা ভাইরাস সংক্রমণে চিনের পরই সবথেকে বেশি মৃত্যু ঘটেছে ইট্যালিতে । দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা (66), বাংলাদেশ (91) আর নেপাল (110) ভারতের থেকে ভালো জায়গায় রয়েছে । করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রুখতে প্রাতিষ্ঠানিক ত্রুটি স্পষ্ট । এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, দেশে যথেষ্ট সংখ্যায় ভাইরোলজি ল্যাব নেই । 1952 সালে প্রতিষ্ঠিত ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি হচ্ছে দেশের সবথেকে বড় ভাইরোলজি ল্যাব । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এখানে ভাইরাস নিয়ে অসাধারণ সব গবেষণা হয়েছে । ভাইরাস ঘটিত মহামারীর সময় উদ্ধারে এগিয়ে আসতে পারে, এমন সংস্থা এই একটিমাত্রই । প্রত্যেক রাজ্যে এমন সংস্থা তৈরির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে । যেহেতু সমস্ত রাজ্য থেকে রক্তের নমুনা NIV-তেই পাঠানো হয়, সেজন্য সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া আটকাতে দেরি হয়ে যায় । এই ধরণের গবেষণাগার ভাইরাসকে চিহ্নিত করে তার উৎস বিশ্লেষণ করতে পারে ।
একমাত্র মহামারীর সময়েই সরকার যদি ঘুম ভেঙে উঠে জনস্বাস্থ্য নিয়ে তাদের দায়সারা উদ্যোগ নেয়, তাহলে COVID-19-এর মতো সংকট দেশকে বিপর্যস্ত করতেই থাকবে । নোটবন্দি এবং GST ইতিমধ্যেই দেশের ওষুধশিল্পকে ধাক্কা দিয়েছে । বর্তমান পরিস্থিতিতে, ওষুধশিল্পে বড়সড় ছাড় এবং বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে । আর অ্যান্ড ডি-র কাজও দ্রুত হওয়া প্রয়োজন । বর্তমানে, বহু ওষুধের কাঁচামাল সরবরাহ করে চিন । বর্তমান পরিস্থিতিতে এই আমদানির জন্য চিনের উপর ভরসা করা সমিচীন নয় । দেশের ওষুধশিল্পকে উৎপাদন বাড়াতে উৎসাহ দেওয়া দরকার । জনস্বাস্থ্য এবং উন্নয়ন হচ্ছে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ । তাই সঙ্কটের জন্য অপেক্ষা করার বদলে, নীতিনির্ধারকদের উচিত দেশের স্বাস্থ্যক্ষেত্রের সামনে সমস্যাগুলো মেটানো ।
ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অর্গানাইজ়েশনের সাম্প্রতিক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, অন্যান্য দেশের নাগরিকদের তুলনায় ভারতীয়দের সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি । এই সংক্রামক রোগগুলোর মধ্যে রয়েছে ম্যালেরিয়া, ভাইরাল হেপাটাইটিস, ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়া, হাম, মেনিনজাইটিস, টাইফয়েড, গোদ এবং যক্ষা । এইসব রোগের মোকাবিলায় সরকারকে বিপুল অর্থ বরাদ্দ করতে হবে । যে রোগগুলি রয়েছে তার মোকাবিলা করতে গিয়েই যদি বিপুল অর্থ সংকোচন হয়ে, তাহলে করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় কত অর্থ লাগতে পারে ? সরকার অন্তত এবার বুঝুক, যে ধুঁকতে থাকা জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বিপুল অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন রয়েছে ।