শিনজ়ো আবের জাপানের প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগের কথা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই সেই দেশ পুনরায় রাজনৈতিক অচলাবস্থার মুখে পড়তে চলেছে । আর অন্যদিকে ভারত হারাতে চলেছে তাদের হয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে সওয়ালকারী অন্যতম সহযোগী দেশটিকে । জাপানের কর্মসূচিগত নিয়ম-নীতিতে ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে কেন্দ্রবিন্দুতে আনার ক্ষেত্রে আবে ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগী হয়েছিলেন ।
2001 সালে ‘গ্লোবাল পার্টনারশিপ বিটউইন জাপান অ্যান্ড ইন্ডিয়া’-এর উন্নতিকল্পে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল । আর তারপর 2005 সাল থেকে বার্ষিক স্তরে দ্বিপাক্ষিক সম্মেলনও আয়োজিত হয়েছে । আবে তারও গতিতে জোর এনেছিলেন । প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী পদে তাঁর কার্যকালের সময় আবে ভারত সফরে এসেছিলেন এবং 2007 সালের অগাস্টে ভারতীয় সংসদে বক্তৃতা দিয়েছিলেন । তাঁর ‘কনফ্লুয়েন্স অফ দি টু সিজ়’ শীর্ষক ভাষণে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছিল তাঁর দূরদর্শী পরিকল্পনার কথা । আবে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ অঞ্চল সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিলেন । বর্তমানে যা ভারত-জাপান সম্পর্কের অন্যতম অপরিহার্য অঙ্গ । 2012 সালে দ্বিতীয় বার জাপানের প্রধানমন্ত্রীত্ব লাভের পর থেকে তিনি তিন বার ভারতে এসেছেন । এর মধ্যে একবার সাধারণতন্ত্র দিবস উদযাপনে ভারতের প্রধান অতিথি হিসাবে এসেছিলেন । আর প্রতি সফরেই তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগত স্তরে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনে সচেষ্ট হয়েছিলেন ।
আবে এবং নরেন্দ্র মোদি, দু’জনের জন্যই এই বন্ধুত্ব অনেকের চোখে খানিকটা অপ্রত্যাশিত ঠেকতে পারে । কারণ আবে জাপানে রাজনৈতিক বংশ পরম্পরার নিকটতম উত্তরাধিকারী (যা তাঁর সঙ্গে জাপানের প্রাচীন ক্রিসানথামাম রাজতন্ত্রের যোগসূত্র থেকেই স্পষ্ট ) । তাছাড়া , আবের ঠাকুরদা নবুসুকে কিশি ছিলেন দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী (1957-60) । তাঁর বাবা শিনতারো আবে ছিলেন দেশের বিদেশমন্ত্রী আর শিনজ়ো আবে নিজে , দেশের সবচেয়ে বেশি মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাঁর ‘গ্রেট আঙ্কল’ এইসাকু সাতোকে টপকে গিয়েছেন । অন্যদিকে , মোদি উঠে এসেছেন অস্বচ্ছল পরিবার থেকে । তবে এই দু’জনেরই কঠোর জাতীয়তাবাদী মানসিকতা, একজোট হয়ে ‘মজবুত’ রাষ্ট্রজোট গড়ে তোলার পরিকল্পনা এবং জাপানের রাজধানী শহরকে ধীরে ধীরে চিনের প্রভাব থেকে সরিয়ে নিয়ে আসার আবের পদক্ষেপ শুধুমাত্র যে জাতীয় স্বার্থের নিরিখে তাঁদের আরও বেশি করে কাছাকাছি নিয়ে এসেছে তা-ই নয় । বরং , ব্যক্তিগত স্তরেও তাঁদের বন্ধুত্বকে গভীর করেছে । যা স্পষ্টভাবে বোঝা গিয়েছিল আবে-র মোদিকে তাঁদের ইয়ামানশির প্রাচীর বাসভবনে আপ্যায়িত করার ঘটনায় । মোদিই ছিলেন বিদেশের প্রথম রাষ্ট্রনেতা, যিনি এই সম্মান পেয়েছিলেন ।
অন্যদিকে , বিদেশনীতির দিক থেকে বিচার করলে , আবে তাদের প্রধান সহযোগী দেশ ,অ্যামেরিকার ‘গুড বুকে’ নিজেদের নাম স্থায়ী করতেও সফল হয়েছিলেন । আর তাও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো পারদের মতো ওঠানামা করা মেজাজসম্পন্ন রাষ্ট্রনেতা থাকা সত্ত্বেও । আবে ক্রমবর্ধমান ক্ষমতাশালী এবং জেদি চিনের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থানে অনড় থেকে ভারতে ‘এশিয়া আফ্রিকা গ্রোথ করিডর’ চালু করতে উদে্যাগী হয়েছিলেন । যা ছিল ‘চাইনিজ় বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর বিকল্প মডেল । তাছাড়া , তিনি ‘কোয়াড’ তথা ‘কোয়াড্রিল্যাটেরাল অফ ডেমোক্রেসিস’-এর সদস্য দেশ অর্থাৎ ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং অ্যামেরিকাকে একত্রিত করার ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন । যা থেকে চিনকে নীরবে অথচ স্পষ্টভাবে এই ইঙ্গিত দেওয়া গিয়েছিল যে ওই এলাকায় তাদের জেদপূর্ণ কার্যকলাপে সকলে ক্ষুব্ধ ।
বিশ্বব্যাপী স্তরে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আবে কিন্তু জাপানে খুব বেশি গণসমর্থন পাননি । এর কারণ তাঁর জাতীয়তাবাদী কর্মসূচি এবং দেশের সংবিধান সংস্কার করে ইতিহাস পুর্নরচনা করার (বিশেষ করে জাপানের ঔপনিবেশিক ইতিহাস এবং যুদ্ধকালীন নিগ্রহ তথা হিংসায় জাপানি সশস্ত্র সেনার ভূমিকা সংক্রান্ত) উদ্যোগের জন্য এবং কোরিয়ায় ‘কমফর্ট ওম্যান’দের দাসত্বের ঘটনার জন্য । সম্প্রতি প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত যে শ্বেতপত্র সরকার প্রকাশ করেছে । তাতে আবে জাপানের আত্মরক্ষা বাহিনীকে সর্বোচ্চ স্তরে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছেন ।