কঠিন পথ অপেক্ষা করছে দুই রুগ্ন টেলিকম সংস্থা, BSNL ও MTNL-র । নরেন্দ্র মোদির সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত এই দুই সংস্থা, ভারত সঞ্চার নিগম লিমিটেড (BSNL) ও মহানগর টেলিফোন নিগম লিমিটেড (MTNL)-কে মিশিয়ে দেওয়ার ঘোষণা করলেও দুই সংস্থার পুনরুজ্জীবনের জন্য সম্ভবত এই ঘোষণা অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে । বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংযুক্তির ফলে বেসরকারি টেলিকম সংস্থাগুলি একটু চাপে পড়বে ঠিকই, কিন্তু এই দুই সংস্থার বিশাল কিছু সুবিধা হবে না । তাঁদের মতে, রুগ্ন এই দুই সংস্থাকে চাঙ্গা করতে সরকারের বহু আগেই পদক্ষেপ করা উচিত ছিল । কার্যক্ষেত্রে এই দুই সংস্থার রক্তক্ষরণ অব্যাহত । দুই সংস্থার সংযুক্তি এবং কর্মীদের জন্য স্বেচ্ছাবসর প্রকল্প (VRS)-র ফলে সংস্থার দৈনন্দিন খরচ হয়ত কিছুটা কমবে, কিন্তু এই পদক্ষেপ সংস্থা দু’টির পুনরুজ্জীবনের পক্ষে যথেষ্ট নয় ।
দেশের নবরত্ন সংস্থাগুলির অন্যতম BSNL রুগ্ন হতে হতে এমন অবস্থা পৌঁছোয়, যখন তাদের বছরে লোকসানের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯০ হাজার কোটি টাকায় । এর জন্য দায়ী রিলায়্যান্স জিয়ো বা ভারতী এয়ারটেলের মতো বেসরকারি সংস্থাগুলির সঙ্গে BSNL-র লড়াইয়ে না পেরে ওঠা। এর অন্যতম কারণ, BSNL-র কর্মীসংখ্যা । এক লাখ ৭৬ হাজার কর্মীর বিপুল ব্যয়ভার সামলাতেই হিমশিম অবস্থা এককালের সেরা এই টেলিকম সংস্থাটির । টেলিকম বিশেষজ্ঞদের মতে, সংস্থাটির এই অবস্থার জন্য এই সব কর্মীদের মানসিকতা অনেকাংশে দায়ী । তাঁরা এখনও BSNL-র একাধিপত্যের যুগেই যেন পড়ে রয়েছেন । আজকের প্রতিযোগী পরিবেশের সঙ্গে কর্মীদের মানিয়ে নিতে না পারার ফলে সংস্থার উন্নতির গ্রাফ ক্রমেই নিচের দিকে নেমেছে । বাজারের মারাত্মক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য ট্যারিফ কমানো, বিপুল সংখ্যক কর্মীর খরচ, সামান্য কয়েকটি ক্ষেত্র বাদ দিয়ে ৪জি পরিষেবার সুবিধা না থাকা, এগুলিই এই সংস্থার পতনের প্রধান কারণ । এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রিলায়্যান্স জিয়োর বাজারে প্রবেশ । 2016 সালে জিয়ো লঞ্চ করার পর থেকে এই সংস্থার আক্রমণাত্মক স্ট্র্যাটেজির কাছে পর্যুদস্ত হয়েছে BSNL । দেশের প্রায় সর্বত্র ৪জি পরিষেবা এবং অত্যন্ত কম টাকায় পরিষেবা দিয়ে টেলিকম শিল্পকে নাড়িয়ে দিয়েছিল রিলায়্যান্স জিয়ো । বাজারে জিয়ো আসার পর থেকেই দেশে ডেটার ব্যবহার অত্যাধিক হারে বেড়ে যায় । তবে ডেটার ব্যবহার বাড়লেও এর ফলে বাজারের বাকি টেলিকম সংস্থাগুলির লাভের অঙ্কে মন্দা আসে । তবে একথা না মেনে উপায় নেই যে, রিলায়্যান্স জিয়ো আসার পর টেলিকম শিল্পে বিপ্লব এসেছে । জিয়ো ছাড়া বাজারে এখন আর মাত্র দু’টি বেসরকারি টেলিকম সংস্থা রয়েছে- এয়ারটেল এবং ভোডাফোন আইডিয়া ।
বিপুল প্রতিযোগিতার এই বাজারে টিকে থাকতে দুই সংস্থার সংযুক্তির পাশাপাশি আরও এক গুচ্ছ পরিকল্পনা করেছে কেন্দ্র । এর মধ্যে রয়েছে বন্ডের মাধ্যমে ১৫ হাজার কোটি টাকা তোলা, সংস্থার ৩৮ হাজার কোটির সম্পদ বিক্রি, এবং কর্মীদের স্বেচ্ছাবসর । স্বেচ্ছাবসরের এই প্রকল্পটি আগামী চার বছর ধরে চলবে বলে জানা গিয়েছে ।
বৃহত্তর আঙ্গিকে দেখতে গেলে, এই দুই সংস্থার সংযুক্তি খুবই যুক্তিগ্রাহ্য, যেহেতু এরা আলাদা ক্ষেত্রে কাজ করে । বাকি সমস্ত টেলিকম সংস্থার দেশ জুড়ে পরিষেবা থাকায় এই দুই সংস্থার সংযুক্তি আরও সঠিক বলেই মনে হয় । এর ফলে বাজারে কিছুটা হলেও প্রতিযোগিতা বাড়বে । লোকসানের বহর বাড়ায় দেশের কোণায় কোণায় আরও শক্তিশালী ডেটা নেটওয়ার্ক তৈরির ক্ষেত্রে টেলিকম সংস্থাগুলো এখন ধীরে চলো নীতি নিচ্ছে । সংস্থা সংযুক্তির ফলে তৈরি হওয়া শক্তিশালী রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এই সব বেসরকারি সংস্থাগুলির ট্যারিফ বৃদ্ধির আগে দু’বার ভাবাবে । দেশের গ্রামীণ এলাকায় পরিষেবা পৌঁছে দিতেও সাহায্য করবে এই সংযুক্তি ।
দেশের স্বার্থেই BSNL-র টিকে থাকাটা বিশেষ জরুরি । দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কৌশলগত সংযোগ রক্ষার জন্য এবং দেশের একেবারে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত পরিষেবা পৌঁছে দিতেও প্রয়োজন BSNL-র । জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যোগাযোগ স্থাপন এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । এই বিষয়টা কখনও বেসরকারি হাতে দেওয়া যায় না । দেশের টেলিকম মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদও স্বীকার করেছেন যে, যখনই কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় হয়েছে, BSNL সবার আগে পরিষেবা ফিরিয়ে আনতে পেরেছে । এমনকি, কঠিন পরিস্থিতিতে BSNL একমাত্র অবলম্বন হিসাবেও কাজ করেছে ।