এমন খবর এসেছিল যে, তালিবানের তরফে মুখ্য সংযোগকর্তা শের মহম্মদ আব্বাস আফগানিস্তান প্রসঙ্গে ভারতের ভূমিকার সমালোচনা করে নেতিবাচক আখ্যা দিয়েছিলেন । এমনও শোনা গেছিল যে, কিছু টুইটে তালিবান মুখপাত্র দাবি করেছেন, তাঁদের সঙ্গে নয়াদিল্লির বন্ধুত্ব ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব নয়, যতক্ষণ না কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হচ্ছে । এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই আলোড়ন তৈরি হয়েছিল । যদিও তা কেটে গেল উচ্চপদস্থ এক ভারতীয় আধিকারিকের আশ্বাসে । তিনি বললেন, আফগানিস্তান প্রসঙ্গে ভারতের অবস্থানে কোনও বদল আসেনি এবং তালিবানরা কাশ্মির বিবাদ নিয়ে একেবারেই আগ্রহী নয় । সাংবাদিক স্মিতা শর্মাকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে কাবুলে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত এবং বর্তমানে NSAB–এর (ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজ়রি বোর্ড) সদস্য অমর সিনহা জানিয়েছেন, " আমি মনে করি না তালিবান কখনও এ কথা বলেছে যে, তারা কাশ্মীর কিংবা একে নিয়ে হওয়া বিবাদে মনোযোগী ছিল। এই দুই বিষয়কে একসূত্রে বাঁধার চেষ্টা পাকিস্তানের একাংশ করেছে । খুব সহজ একটি কারণের জন্য তারা এটা করছে কারণ তারা মনে করে, এভাবেই তারা আমেরিকাকে এই বিবাদে জড়াতে পারবে । কারণ আমেরিকার কাছে আফগান সমীকরণের দিকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ । আর পাকিস্তানের কাছে সমীকরণের উভয় দিকই খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং তারা এই দুইয়ের মধে্য যোগসূত্র টানতে বা সামঞ্জস্য খুঁজে পেতে চায়।"
যুদ্ধবিদীর্ণ আফগানিস্তানে জাতীয় স্তরে শান্তি ফিরিয়ে আনা ও পুনর্মিলনের পক্ষে সওয়ালকারী আঞ্চলিক অংশীদারভুক্ত দেশগুলির তালিকায় অন্যতম হল ভারত। দোহায় তালিবানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের মুখপাত্র পরে টুইট করে সেই বিতর্কিত টুইট খারিজ করেছিলেন এবং গুরুত্ব সহকারে জানিয়েছিলেন যে, এই ইসলামিক শক্তি অন্যান্য পড়শি দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে কখনও হস্তক্ষেপ করে না। অমর সিনহা জোর দিয়ে বলেছেন, " শুধুমাত্র দু’দিন আগে নয়। যখন সংবিধানের 370 ধারা রদবদল হল, তখনও তালিবান এই কথা বলেছিল । পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, এর ফলে দোহায় শান্তি প্রক্রিয়ায় প্রভাব পড়বে। সেবারও সঙ্গে সঙ্গে তালিবান মুখপাত্র প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে এই দু’টি বিষয়ের মধে্য কোনও যোগসূত্র নেই । সংবিধানের 370 ধারা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়, আমরা তাকে শ্রদ্ধা করি এবং কাশ্মীর ইশু ও তালিবানের মধে্য আমরা কোনও যোগসূত্র পাইনি । গত সপ্তাহে আমরা দেখেছিলাম কীভাবে সোশাল মিডিয়ায় কিছু তালিবান মন্তব্য নিয়ে ঝড় উঠেছিল, যেখানে তারা কীভাবে তারা কাশ্মীর ছিনিয়ে নেবে ইত্যাদির মতো একাধিক দাবি করেছি । কিন্তু আমি মনে করি যে গোটাটাই করা হয়েছিল অনিষ্ট করার উদ্দেশে্য আর তালিবান মুখপাত্র স্ট্যানিকজাই এবং সুহেল শাহিন নিজেদের মন্তবে্য তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এখানেই এই অপ্রয়োজনীয় বিতর্কে ইতি টানা উচিত ।" 2018 সালে মস্কো আলোচনায় অ-সরকারি স্তরে যে দুই অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় কূটনীতিক নয়াদিল্লির প্রতিনিধি হিসাবে অংশ নিয়েছিলেন এবং যঁরা অন্যদের পাশাপাশি সর্বপ্রথম তালিবান প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক ঘরে থেকেছিলেন, সিনহা তাঁদের মধে্য অন্যতম। বিগত 18 বছরে ভারত আফগান-নেতৃত্বাধীন, আফগান-অধীন এবং আফগান-নিয়ন্ত্রিত শান্তি প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে, তালিবানের সঙ্গে কোনও আলোচনায় বসার প্রস্তাবে সম্মত হয়নি। আমেরিকায় আফগানিস্তানের বিশেষ রাষ্ট্রদূত জালমে খলিলজাদ, তাঁর সাম্প্রতিক দিল্লি সফরে মন্তব্য করেছিলেন যে, ভারতের উচিত তালিবানের সঙ্গে আলোচনায় বসা এবং আফগান রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বৃহত্তর ভূমিকা পালন করা । তা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সিনহা বলেন, ভারত তালিবান-সহ সকলের সঙ্গেই আলোচনায় বসতে চায় কিন্তু তার আগে তাদের জানাতে হবে, তারা ঠিক কী চায়।
অমর সিনহা বলেছেন, “আফগানিস্তানের সকল গোষ্ঠীর সঙ্গে ভারত আলোচনায় বসতে চায়। এটা খুবই স্পষ্ট। তারা আমাদের অন্যতম কাছের পড়শি দেশ। তাই দেশটির সমস্ত রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করতে চাই। কিন্তু তার আগে অন্তত তালিবানকে এটা প্রমাণ করতে হবে যে তারা একটি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে, তারা হিংসার সঙ্গ ছেড়ে দিয়েছে এবং আফগানদের খুন করা বন্ধ করে দিয়েছে।” প্রাক্তন রাষ্ট্রদূতের কথায়, “ আমি এই মতে বিশ্বাসী নই যে পড়শি দেশগুলির ক্ষেত্রে কোনও ব্যান্ডওয়াগনে যোগ দেওয়ার দরকার ভারতের আছে। আমি মনে করি, প্রতি ক্ষেত্রে ভারতের নিজস্ব নীতি থাকা উচিত এবং আমাদের এলাকার মধে্য সেই সব নীতির বাস্তবায়নের ফলে কী কী প্রভাব পড়তে পারে, তা নিয়ে এর যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী থাকা উচিত। না হলে আমাদের মুখের কথা এবং কাজে শক্তি প্রদর্শন করার দৃষ্টিভঙ্গীকে গুরুতর অবমাননা হিসাবেই দেখা হবে। তাই এই এলাকা নিয়ে অন্যরা যে বর্ণনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি রেখেছে, আমাদেরও উচিত সেই তালিকায় যোগদান করা। ”
যদিও তাঁর ইঙ্গিত, ভারত পিছনের দরজা দিয়ে আলাপ-আলোচনা বজায় রেখে চলেছে এবং এটা বলা ভুল যে নয়াদিল্লি দূর থেকে দেখছে, কাবুলে কী হচ্ছে। সিনহার জবাব, “ আমরা যে কিছুই করছি না, সেটা বলাটা ভুল। যোগাযোগ বজায় রাখা এবং পুনর্মিলন ঘটানো সংক্রান্ত অনেক কিছু প্রকাশে্য করা যায় না । কিন্তু আমি নিশ্চিত, পর্দার আড়ালে আমাদের দূতাবাস, রাষ্ট্রদূত এবং অন্যান্য আধিকারিকরা এ বিষয়ে সক্রিয়। তারা অন্তত আফগান সরকারের সঙ্গে পরামর্শ দেওয়া-নেওয়া চালিয়ে যাচ্ছে।” তাঁর আরও সংযোজন, “ আমি এর অংশ নই (পর্দার আড়ালে আলোচনা) কিন্তু আমি নিশ্চিত, ভারত সরকার সারাক্ষণ পিঠে হেলান দিয়ে বসে নেই। অনেক কিছু ঘটে চলেছে। কিছু কিছু জিনিস চুপিসাড়েই করা উচিত, বিশেষ করে তা যখন আপনি আপনার পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে শুরু করতে চলেছেন। আমাদের সমস্যা হল এই যে, আমাদের (ভারত) বন্ধুর সংখ্যা অনেক বেশি। তাই আমরা কারও পক্ষ নিতে পারি না, একজনকে ছাপিয়ে অন্যজনকে বাছতে পারি না। তাই চুপিসাড়ে নিজের উদ্বেগের কথা জানাই, তাদের কাছে আবেদন করি এবং সেরা পথে হেঁটে, অগ্রগতির দিকে এগিয়ে চলি। " COVID-19 সংকটের আবহে জালালাবাদ এবং হেরাটে ভারতীয় কনসু্লেট বন্ধ হওয়ার খবর নিয়ে প্রশ্ন করলে অমর সিনহা বলেছেন, প্যানডেমিকের জন্যই আপাতত কনসু্লেট বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে । তাঁর কথায়, “হেরাট এবং জালালাবাদের অবস্থান দেখে বুঝতে পারছি, ভাইরাস সংক্রমণের ভয়েই এই পদক্ষেপ । হেরাট সংক্রমণের জেরে বিপর্যস্ত আর ইরান থেকে ভাইরাস সংক্রমণ যেখানে যেখানে হয়েছে, হেরাট তাদের মধে্য অন্যতম । তাই আমি বুঝতে পারছি, COVID -র জন্যই এই পদক্ষেপ আর এগুলো সাময়িক । আমরা অপেক্ষা করছি, নজর রাখছি । লকডাউনের এই সময়ে জালালাবাদ এবং হেরাটের মানুষের পাশে দাঁড়ানো কঠিন। তাই সম্ভবত, এটি চিকিৎসাজনিত একটি সতর্কতামূলক পদক্ষেপ।”
স্মিতা শর্মা অমর সিনহার সঙ্গে কথা বলেছেন আমেরিকা-তালিবান শান্তি চুক্তি, আন্তঃআফগান আলোচনা, তালিবানের ক্ষমতা আসার অর্থ ১৯৯৬ সালের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি কি না, IC-814 হাইজ্যাকের ঘটনায় ভারতের বিশ্বাসভঙ্গ এবং আরও নানা বিষয়ে ।
প্রশ্ন: এত ঘটা করে ফেব্রুয়ারি মাসে দোহায় যে আমেরিকা-তালিবান শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হল, আদপে তা কতটা ভঙ্গুর? এটা কী ইতিমধে্যই ভাঙতে বসেছে?
অমর সিনহা- এটা বাস্তবিক অর্থে কোনও শান্তি চুক্তি ছিল না। এটা ছিল আমেরিকা সরকার এবং তালিবানের মধে্য স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি যা আফগানিস্তানে শান্তি ফেরাতেই করা হয়েছিল। শান্তি হল আন্তঃআফগান আলোচনার অন্তিম ফলাফল। 29 ফেব্রুয়ারি হওয়া চুক্তি আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের কথা জানায়। সঙ্গে কিছু সময়সীমার হদিস দেয় এবং কিছু প্রতিশ্রুতির কথা জানায়, যে তালিকায় রয়েছে, কত বন্দীদের ছেড়ে দেওয়া হবে, কখন সেই প্রক্রিয়া শুরু হবে, কোন কোন নির্দিষ্ট তারিখে আমেরিকার তালিবানদের উপর জারি করা বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা উচিত প্রভৃতি। গোটা বিষয়টা নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছে কারণ চুক্তিতে যে সময়সীমার কথা বলা হয়েছে, তা ধরনে-ধারণে প্রবল উচ্চাকাঙ্খী ছিল। তা সরকার গঠন এবং আফগানিস্তানে নির্বাচনের ফল ঘোষণার সময়ের সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল। এই দুই প্রক্রিয়াই সেখানে সমান্তরালভাবে চলছিল। আন্তঃআফগান আলোচনা শুরুর তারিখ ছিল 10 মার্চ, সেখানেই আবার প্রেসিডেন্ট ঘনি এবং আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ শপথ নিলেন 9 মার্চ। দু’জন প্রেসিডেন্টের জন্য দু’টো পৃথক পৃথক শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হয়েছিল। সৌভাগ্যবশত, সেই সমস্যা এখন মিটে গেছে । আফগান রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের তরফে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল যে তাঁরা শেষ পর্যন্ত অন্তত ঐক্যমতে্যর নিরিখে একটি সর্বসম্মত অবস্থানে আসতে পেরেছিলেন, যেখান থেকে তাঁরা বর্তমানে আন্তঃআফগান আলোচনায় তালিবানকে গুরুত্ব সহকারে যোগদান করতে বাধ্য করতে পেরেছেন ।
প্রশ্ন- গত দশকে আফগানিস্তান রাজনৈতিক স্তরে যে লাভ করেছে, তাতে কতটা ঝঁুকি মিশে আছে? আর আমেরিকা- তালিবান চুক্তির ক্ষেত্রেই বা তা কতটা?
অমর সিনহা- যেভাবে লেখা হয়েছিল, যদি ঠিক সেভাবেই সব কিছু এগোয়, তাহলে আমি মনে করি না, আমাদের কোনও সমস্যা হতে পারে । ওই চুক্তিতে সতি্যই তালিবানকে মূলধারার রাজনীতিতে ফিরে আসা এবং আফগান সরকার ও সমাজের সঙ্গে যুক্ত হতে সচেষ্ট করে । যদি তাকে বিশ্বাস করে তালিবানরা তা কার্যকর করে, তাহলে আমি মনে করি, ভাল ফল আসবে । প্রতে্যকে চায়, হিংসা শেষ হোক, বিশেষ করে আফগানরা তাই চান । এই চুক্তিকে তালিবানকে এই মর্মেও প্রতিশ্রুতি দিতে বলা হয়েছে যে তারা সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলির সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করবে, বিশেষ করে তখন, যখন তারা কাবুলে ফিরে আসবে। আর সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি ছাড়াও তাদের সন্ত্রাসের মদতদাতাদের থেকেও সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। গত 18 বছর ধরে ওরা এর সুবিধাভোগী ছিল।
প্রশ্ন- ক্ষমতা বণ্টনের চুক্তি নিয়ে যে রফা হয়েছিল, তা অনুযায়ী আফগানিস্তানে হিংসা অন্তত 80 শতাংশ হ্রাস করবে তালিবান–আমেরিকার আধিকারিকদের এই বোঝাপড়া তালিবান এড়িয়ে গেছে । গত 24 থেকে 48 ঘণ্টার ব্যবধানে সেখানকার 34 টি প্রদেশের কুড়িটিতে সংঘর্ষের খবর মিলেছে । প্রেসিডেন্ট ঘনিকে নিজের অবস্থান প্রতিরোধমূলক থেকে পরিবর্তন করে প্রতিঘাতমূলক করতে হয়েছে । এই চক্র কোথায় গিয়ে থামবে ?
অমর সিনহা- দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে, এই চুক্তি আফগান এবং আফগান নিরাপত্তারক্ষীদের বিরুদ্ধে হিংসার হার কমানোর ক্ষেত্রে কোনও শর্ত আরোপ করে না । চুক্তিতে বলা আছে যে, সাত দিন ধরে হিংসা কম হবে । প্রতিশ্রুতি এটাই যে তালিবান আমেরিকা এবং তার মিত্র দেশগুলির উপর আক্রমণ করবে না । আফগান সরকার কিংবা আফগান প্রদেশগুলিতে হিংসা বন্ধের কোনও প্রতিশ্রুতি সেখানে দেওয়া হয়নি। তালিবানের তরফে তাদের লাগাতার আক্রমণ তথা ‘স্প্রিং অফেনসিভ’ এখনও ঘোষণা করা না হলেও আমরা তাদের সংঘর্ষের সংখ্যা বৃদ্ধি হতে দেখছি । কিন্তু তালিবানরা তা না ঘোষণা করলেও (সচরাচর মার্চ বা এপ্রিলে তারা তা করে থাকে) সংঘর্ষের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে...এমন রিপোর্ট এসেছে, যাতে বলা হয়েছে তালিবান আন্তঃআফগান আলোচনায় বসার আগে বেশ কিছু প্রদেশ দখলের চেষ্টা করবে। কারণ তারা চাইবে শক্তি বাড়িয়ে আলোচনার টেবিলে বসতে। আমি মনে করি, তালিবানকে অনেক বেশি বৈধতা দেওয়া হয়েছে যা তাদের সম্ভবত আলোচনায় বসার আগে যতটা দরকার, তার থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এটাই তাদের সেনাবাহিনীর কৌশল।
প্রশ্ন- শিখ সংখ্যালঘুদের উপর, শিশু-প্রসূতি হাসপাতালে পর পর হামলা থেকে শুরু করে কুন্দুজে অন্তত 17 টি গোয়েন্দা পোস্ট- বিশেষ মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলছেন নেপথে্য ইসলামিক স্টেট খোরাসান আর প্রেসিডেন্ট ঘনি বলছেন, এটা তালিবানের কাজ। ভারত কী মনে করে?
অমর সিনহা- সতি্যটা হল এই যে, এই সব সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি পরস্পর যুক্ত। একের থেকে অন্যকে আলাদা করা খুবই কঠিন। এরা নিজেদের সম্পদ, সদস্য, কৌশল, মতাদর্শ–সবকিছুই লেনদেন করে । এবার কে ভাল আর কে মন্দ সন্ত্রাসবাদী, সেই বিভেদ করা সঠিক নীতি নয়। এই সব আক্রমণের একটা নির্দিষ্ট অর্থ আছে। এরা মৌলিকভাবে এমন একটা জরুরি অবস্থা জারি করতে চাইছে যেখানে সংঘর্ষদীর্ণ আফগানদের মানসিক অবস্থা নিয়ে তারা খেলতে পারে এবং আফগান সরকারকে চরম চাপের মধে্য রাখতে পারে এই বলে যে, আন্তঃআফগান আলোচনা শুরু করার আগে যতক্ষণ না তোমরা আমাদের দেওয়া সব শর্ত মানছো, ততক্ষণ অগুনতি নিরীহ সাধারণ মানুষের প্রাণহানি হবে। এটা সেই সব সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলির কাছে সুবিধাজনক হয়েছে, যাদের উত্থান হয়েছে গত কয়েক বছরের মধে্য। যে সব হামলায় দায় তালিবানের পক্ষে নেওয়া কঠিন হত, এই সংগঠনগুলি তার দায় স্বীকার করে নিচ্ছে । এগুলো সবই এক ধরনের খেলা আর তাই আমাদের এটা বিচার করা উচিত নয় যে, কোন সংগঠন এ সব করছে। সতি্যটা হল আফগানিস্তানে যে হিংসা চলছে, তার একটি ইতিহাস আছে, প্রেক্ষাপট আছে এবং আফগানরা তা জানে। আমি নিশ্চিত, মি. খলিলজাদও তা জানেন। কিন্তু এই মুহূর্তে এটাই সমীচিন হবে যে আমরা এই ধরনের সব দায় থেকে তালিবানকে মুক্ত করি কারণ তালিবানকে বর্তমানে তুলে ধরা হচ্ছে এমন একটি শক্তি হিসাবে, যারা বদলে গিয়েছে। বর্তমানে তারা একটি রাজনৈতিক শক্তি এবং হিংসাজনক কোনও শক্তি নয়। তবে তা হাতেকলমে প্রমাণ করা এখনও বাকি।
প্রশ্ন- দীর্ঘ সময়ের জন্য ভারত লাল সতর্কতা জারি করেছে। যে দুই রাষ্ট্রদূত দৃষ্টিভঙ্গী বদলের পর অসরকারিভাবে ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন মস্কোয় তালিবানের সঙ্গে একই ঘরে থেকে, আপনি তঁাদের অন্যতম। গত বছর রাইসিনা আলোচনায় তত্কালীন সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত বলেছিলেন, তালিবানের সঙ্গে আলোচনায় ভারতের উচিত, ব্যান্ডওয়াগনে ঝাঁপিয়ে পড়া। সরাসরিভাবে তালিবানের সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্রে ভারতের সুযোগ কোথায়?
অমর সিনহা- আফগানিস্তানে সব গোষ্ঠীর সঙ্গে ভারত কথা বলবে। এটা খুবই স্পষ্ট, এটি আমাদের নিকট পড়শি দেশ। আমরা প্রতিটি রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে কথা বলতে চাই। কিন্তু আগে তালিবান প্রমাণ করুক যে তারা একটি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে, হিংসা ছেড়ে দিয়েছে এবং আফগানদের হত্যা বন্ধ করে দিয়েছে। বাকিরা কে কী বলেছে আমি শুনেছি। আমি বিশ্বাস করি না, পড়শি দেশ এলাকায় ভারতকে কোনও ব্যান্ডওয়াগনে যোগ দিতে হবে। আমি মনে করি, ভারতের উচিত নিজস্ব নীতি নির্ধারণ করা এবং এই এলাকায় যে কোনও ফলাফলকে রূপ দেওয়ার জন্য যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী থাকা। নচেৎ, আঞ্চলিক হওয়া নিয়ে আমাদের মুখের কথা এবং কাজে শক্তি প্রদর্শন করার দৃষ্টিভঙ্গীকে গুরুতর অবমাননা হিসাবেই দেখা হবে। তাই এই এলাকা নিয়ে অন্যরা যে বর্ণনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি রেখেছে, আমাদেরও উচিত সেই তালিকায় যোগদান করা।অসরকারিভাবে মস্কোয় গিয়ে এই প্রথম তালিবান আঞ্চলিক দেশের সঙ্গে কথা বলেছিল। রাশিয়াও এ নিয়ে এগিয়েছিল। আন্তঃ আফগান আলোচনা ঐতিহাসিক ছিল। কারণ এটি প্রথম গোটা যোগাযোগকে গণতান্ত্রিক রূপ দিয়েছিল। তার আগে এই সব যোগাযোগের দরুণ, মার্কিন-তালিবান চুক্তিই হয়েছিল। আদপে যা ছিল আমেরিকা সরকার এবং তালিবানের মধে্য দ্বিপাক্ষিক আলোচনা। অতিথি দেশ কাতার ছাড়া সেই সময় ওই ঘরে কেউ ছিল না, NATO বা আফগানিস্তানের মতো প্রধান দলও নয়, যদিও না আবার তালিবানের ছদ্মবেশে সেখানে কোনও ISI-এর চর থেকে থাকে। তাই দোহা চুক্তিতে ভারতের যোগ দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
বর্তমানে আমরা আগের থেকে আরও ভাল জায়গায় আছি। আর এখানে ভারতের পক্ষে বৃহত্তর গঠনাত্মক ভূমিকা পালন করারও সুযোগ আছে। যা আমাদের নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী, আফগান প্রজাতন্ত্র এবং গণতন্ত্রকে নিরন্তর সমর্থন করে যাওয়ার আমাদের নীতি, গোটা রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে আমাদের যোগসূত্র প্রভৃতি থেকে এই সত্য প্রকাশিত হয়। সুতরাং, যে বার্তা আমাদের পাঠাতে হবে তা হল, এটাই যথার্থ সময় যখন তালিবান-সহ সমস্ত আফগানদের একসঙ্গে বসে কথা বলে সেই যুদ্ধে ইতি টানতে হবে যা পরস্পরকে হত্যা করে চলেছে। তালিবানের জন্য আমি শুধু একটি পরীক্ষাই রাখতে চাই যে কেন তালিবানরা (যদি সতি্যই তারা সন্ত্রাস থেকে নিজেদের দূরে রাখতে চায়, কারণ তারা প্রকাশে্য বলেছে যে ISIS তাদের শত্রু–সতি্য ISIS আফগানদের মারছে, তারা আমেরিকার শত্রু এবং তারা আফগানদেরও শত্রু এবং তালিবান দাবি করেছে আফগানিস্তানের ৩০ শতাংশ তাদের দখলে) ISIS এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে আফগান সেনার সঙ্গে দিচ্ছে না? এটাই সেই পরীক্ষা যা স্পষ্ট করে দেবে যে তালিবানরা সতি্যই জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসাবে নিজেদের তুলে ধরছে না কি নিজের নাগরিকদের প্রাণরক্ষায় ভূমিকাও নিচ্ছে না কি তাদের শুধু হত্যা করছে।
প্রশ্ন- সতি্যই কি ভারতে বসে বসে কী হচ্ছে, তা দেখার বিলাসিতা আছে? নভেম্বরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে মরিয়া হয়ে DC চেষ্টা করছে আফগানিস্তানে থাকা বাকি মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করতে। জালমে খলিলজাদ তাঁর সাম্প্রতিক দিল্লি সফরে জানিয়েছিলেন, ভারতের উচিত সরাসরি তালিবানের সঙ্গে শীঘ্রই আলোচনায় বসা।