পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / bharat

শস্য ভান্ডার থেকে ক্যানসার রোগের আখড়া ওড়িশার বরগড়

বিশেষজ্ঞদের মতে পরিবেশে দূষণ ও বায়ু দূষণের মাত্রা বাড়াই এই জেলায় এই ক্যানসার ও টিউমারের আধিক্যের প্রধান কারণ ৷ এছাড়া তাঁরা উল্লেখ করেছেন, দূষিত জল ও অতিরিক্ত রাসায়নিক মিশ্রিত খাবারও এই রোগ বাড়াতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে ৷

image
ক্যানসার রোগের আখরা

By

Published : Jul 10, 2020, 1:43 PM IST

একসময় ওড়িশার শস্য ভান্ডার বলা হত বরগড় জেলাকে ৷ বর্তমানে সেই জেলাই শিরোনামে এসেছে ক্যানসার রোগীর আধিক্যের জন্য ৷ রাজ্যের অন্যান্য জেলার সঙ্গে তুলনা করলে সংখ্যা বেশ খানিকটা বেশি ৷ কিন্তু কেন ? রিপোর্ট অনুয়ায়ী রাজ্য সরকারের কাছেও এর কোনও উত্তর ছিল না ৷ তবে এটা মনে করা হচ্ছে, চাষে অতিরিক্ত পরিমাণে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার এর অন্যতম প্রধান কারণ হতে পারে ৷

বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবেশে দূষণ ও বায়ু দূষণের মাত্রা বাড়াই এই জেলায় এই ক্যানসার ও টিউমারের আধিক্যের প্রধান কারণ ৷ এছাড়া তাঁরা উল্লেখ করেছেন, দূষিত জল ও অতিরিক্ত রাসায়নিক মিশ্রিত খাবারও এই রোগ বাড়াতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে ৷

1950 সালে হিরাকুদ জলাশয়ের জল খালের মাধ্যমে জমিতে সেচের জন্য ব্যবহার করার পর থেকেই এই জেলায় ধান ও সবজি চাষের প্রাচুর্য লক্ষ্য করা যায় ৷ সেচের সুবিধা থাকার জন্য অন্যান্য রাজ্য থেকে, যেমন অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে অনেক কৃষক এই জেলায় পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করে ও চাষাবাদ শুরু করে ৷

ভালো ফসল পাওয়ার জন্য কৃষকরা অতিরিক্ত পরিমাণে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যাবহার করতে থাকে ৷ যদিও এই রাসায়নিক কীটনাশক ও সারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তারা অবগত ছিল না ৷ ফলে বছরের পর বছর ধরে জেলার মাটির নিচের জল ধীরে ধীরে দূষিত হতে থাকে ৷

কমপক্ষে 64 শতাংশ কৃষক কৃষি জমিতে এই সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করার সময় সুরক্ষা আবরণ ব্যবহার করে না ৷ গ্লাভস, চশমা, বুট তো দূরের কথা, এমনকী এই রাসায়নিক প্রয়োগের সময় তারা হাতঢাকা জামাও ব্যবহার করে না ৷

কৃষিজমিতে 2016 সালে যেখানে 440.702 টন কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছিল 2017 সালে সেটাই পৌঁছায় 713.867 টনে ৷

এছাড়াও বরগড় জেলা এত বেশি সেচের জল পায় যে, কৃষকরা বছরে দুবার করে ধানের চাষ করে ৷ 2018 সালের খারিপ মরশুমে 0.34 মিলিয়ন হেক্টর কৃষিজমির মধ্যে ধানের চাষ হয় 0.24 মিলিয়ন হেক্টর জমিতে ৷

এককালীন শস্য ভান্ডার বর্তমানে ক্যানসার রোগের আখড়া

যদিও এখন কিছু কৃষক জৈব চাষের দিকে ঝুঁকেছে, কিন্তু যা ক্ষতি হওয়ার তা আগেই হয়ে গেছে ৷ চাষিরা বিশ্বাস করে, সরকার যতদিন না পুরোপুরিভাবে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বন্ধ করছে ততদিন এই রাসয়ানিকের ব্যবহার হতেই থাকবে ৷

ETV ভারতকে পশ্চিম ওড়িশার কৃষক ইউনিয়নের এক নেতা লিঙ্গারাজ প্রধান বলেন, বরগড়ে রাসয়ানিকের ব্যবহার অনেক ৷ এবং এই রাসায়নিকের সঙ্গে ক্যানসারের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে ৷ তিনি বলেন, ‘‘ দেশের সবুজ বিপ্লবের পর কৃষি ক্ষেত্রে যে গতি পেয়েছে তা আমাদের সাবলম্বী করেছে ৷ তবে একইসঙ্গে ফলন বাড়াতে মারাত্মক কীটনাশকের ব্যবহার উপর আমাদের নির্ভরতাও বাড়িয়েছে ৷ বর্তমানে আমাদের বিকল্প কৃষি পদ্ধতি চাই ৷ আমরা কৃষকরা কীটনাশকের ব্যবহারে ক্যানসার বৃদ্ধির বিষয়ে উদ্বিগ্ন ৷ তাই সরকারের অবশ্যই নতুন নীতি আনতে হবে এবং আমাদের বিকল্প চাষ পদ্ধতি দিতে হবে ৷’’

একবার কৃষিক্ষেত্র সমৃদ্ধ হতে শুরু করলে, বহু সহায়ক শিল্প উঠে আসে ৷ 100-র বেশি রাইস মিল থেকে কালো ধোঁয়া নির্গত হয় ৷ এগুলি বায়ু দূষণ করে ও স্থানীয় বাসিন্দাদের দূরাবস্থা বাড়ায় ৷ সূত্র অনুযায়ী বরগড়ে 130 টিরও বেশি রাইস মিল আছে ৷

রিপোর্ট অনুযায়ী 2014-15 সালে 1017 জনের ক্যানসার ধরা পড়ে ৷ 2015-16 সালে সেটাই বেড়ে দাঁড়ায় 1065 জনে ও 2016 -17 সালে এই পরিসংখ্যানটি পৌঁছায় 1100 তে ৷

বরগড়ের ক্যানসার রোগীদের মধ্যে পেপটিক ক্যানসার ও স্তন ক্যানসারের সংখ্যা সবথেকে বেশি ৷ এর থেকে খাবারের সঙ্গে ক্যানসারের যোগাযোগটা পরিষ্কার বোঝা যায় ৷

ETV ভারতকে রোশান আরা খান নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, তাঁর দুই হাতে একাধিক মেলোমা রোগ হয় ৷ যখন ক্যানসার হয় তখন প্রথমেই মাথায় মৃত্যুর কথা আসে ৷

তিনি বলেন, ‘‘ আমার দুই হাত হারানোর অনুভূতি হয়েছিল ৷ ভুবনেশ্বরের AIIMS -এ অস্ত্রোপচারের পর ও তিন মাসের সম্পূর্ণ বিশ্রামের পর, বর্তমানে আমি সুস্থ ৷’’ রেডিয়েশন থেরাপি দেওয়ার পর রোশন আরা খানকে অন্যান্য অনেক রোগের সম্মুখীন হতে হয় ৷ হাঁটুতে ব্যথা, কথা বলতে সমস্যা ও দাঁতের ক্ষয়ও আছে ৷

গুটখা বা অন্য তামাকজাত দ্রব্য সেবন না করলেও মিনাতি পাতিরও 2014 সালে ক্যানসার ধরা পড়ে ৷ তিনিও এখন সম্পূর্ণ সুস্থ ৷ পেশায় সাংবাদিক প্রসন্ন মিশ্রর ব্লাড ক্যানসার ধরা পড়ে ৷ প্রথম দিকেই ক্যানসার ধরা পড়ায় মুম্বইয়ের টাটা মেমোরিয়াল হসপিটালে তাঁর চিকিৎসা চলে ৷ এবং তিনি বর্তমান সম্পূর্ণ সুস্থ ৷ যদিও তাঁরা সেই সংখ্যালঘু সৌভাগ্যবান যাঁরা ক্যানসার থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৷

2017 সালে তখনকার বিজিপুরের বিধায়ক সুবল সাহু ক্যানসারের কাছে হার স্বীকার করেন ৷ পশ্চিম ওড়িশা উন্নয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুভাস চৌহানের ক্যানসার ধরা পড়ে ৷ রোগ নির্ণয়ের পর তাঁর চিকিৎসা শুরু হয় ৷ কিন্তু চার মাস পর তাঁর মৃত্যু হয় ৷

বরগড়ের ক্যানসারজয়ীরা একত্রিত হয়ে একটি সংস্থা তৈরি করেছেন ৷ এর নাম ‘‘ফাইটার গ্রুপ’’ ৷ তাঁরা ক্যানসারে আক্রান্তদের সাহায্য করেন ৷ এই সংস্থা 2017 সাল থেকে বরগড়ে একটি ক্যানসার হাসপাতাল গড়ার দাবি জানিয়ে আসছেন ৷

ক্যানসার হাসপাতাল তৈরির দাবি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে পরিণত হয় ৷ এরপর রাজ্য সরকার ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চ(ICMR) কটককে দায়িত্ব দেয় ৷ ICMR এর একটি দল ওই এলাকাটি পরিদর্শন করে ৷ এবং খেদাপালির নব নির্মিত জেলা হেডকোয়ার্টার হাসপাতালে কেমোথেরাপি ও রেডিয়োথেরাপির ব্যবস্থা করা হয় ৷

জাতীয় ক্যানসার রেজিস্ট্রির অংশও নয় ওড়িশা ৷ জাতীয় ক্যানসার রেজিস্ট্রি নিয়মিতভাবে ক্যানসারের তথ্য সংগ্রহ করে ৷ যদিও মুখ্যমন্ত্রী নবীন পটনায়েক সম্প্রতি ঘোষণা করেন খুব দ্রুত কাজ শুরু হবে ৷ কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনও কাজ এগোয়নি ৷ তবে এখন রাসয়ানিক কীটনাশক ও সারের বাজারে ব্যাপক পরিবর্তন করতে হবে ৷ যার ফলে কৃষকরা জৈব চাষে উৎসাহ পাবে ৷

ABOUT THE AUTHOR

...view details