ভারতে কৃষকদের কাছে জীবন ধারণের একমাত্র উপায় হল কৃষিকাজ । কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত ইদানিংকালে কৃষিকাজ চাষিদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে । হতাশায় ভরে উঠেছে কৃষকদের জীবন । খুবই আশ্চর্যের বিষয় হল, বাকিরা সবাই, অর্থাৎ দালাল থেকে কৃষিপণ্য বিক্রেতা সবাই বিপুল লাভ করলেও তার কানাকড়িও মিলছে না কৃষকদের । বীজ বপন থেকে ফসল তোলা পর্যন্ত গোটা প্রক্রিয়ায় কৃষকদের নিরাপত্তা দেবে, এমন কোনও শক্তিশালী আইন আমাদের দেশে নেই । এর অন্যতম উদাহরণ বীজ আইন । এই আইন সেই সময় তৈরি করা হয়েছিল, যখন বীজ কেবল সরকারের ঘর থেকেই মিলত । অথচ এখন বেসরকারি সংস্থার রমরমা । এই অবস্থায় এই আইন এই সব বেসকরকারি সংস্থাগুলির কাছে আশীর্বাদের মতো হয়ে দেখা দিয়েছে। মুদ্রার অন্য পিঠে এই আইনই এখন কৃষকদের কাছে অভিশাপের অপর নাম । এই ধরনের আইন কৃষকদের অধিকারকে খর্ব করেছে । দশকের পর দশক ধরে এই সমস্যার দিকে ফিরেও তাকায়নি সরকার । এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষকের ভবিষ্যৎ । সময় এসেছে প্রাচীন এই বীজ আইনে পরিবর্তন করার । এর জন্য কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার একটি খসরা বিল আনার বিষয় চিন্তাভাবনা শুরু করেছে। কৃষি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে কৃষকদের মুখে হাসি ফেরানোর সেরা সময় এটাই ।
বর্তমান বীজ আইন অনুযায়ী, কৃত্রিম ও ভেজাল বীজের বিষয়ে কৃষকরা কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানাতে পারেন । অভিযোগ খতিয়ে দেখে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয় কেন্দ্রীয় বীজ কমিটি। কিন্তু আইন একেবারেই শক্তিশালী না হওয়ায় দালালরা এই আইনের ফাঁক কাজে লাগিয়ে এবং কিছু পরিচিত সরকারি সর্মীর সাহায্যে সহজেই রেহাই পেয়ে যায় । খুব কম সংখ্যক ক্ষেত্রে, যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যাটা বিশাল, তখনই এই আইনের মাধ্যমে অপরাধীরা শাস্তি পেয়েছে । কিছু ক্ষেত্রে বেসরকারি লাইসেন্সও বাতিল হয়েছে । লাইসেন্স কেড়ে নেওয়ার পরেও এই সব সংস্থা অন্য নামে কৃত্রিম বীজের কারবার করে চলেছে । প্রশাসনের দুর্বল অংশগুলিকে কাজে লাগিয়ে এই সব সংস্থা ফের লাইসেন্সও আদায় করে নিতে সক্ষম হচ্ছে। আর এই সব বিষয়গুলি প্রতিদিন একটু একটু করে সহায় সম্বলহীন কৃষকদের আরও দারিদ্রের দিকে ঠেলে দিচ্ছে ।
অনেক প্রতারক সংস্থা আবার কোনও জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের প্যাকেটে নিজেদের জাল বীজের কারবার চালিয়ে যাচ্ছে । আর এই ভাবে তাদের পণ্য বিক্রি হচ্ছে খোলা বাজারে । এই সব জাল কারবার ঠেকানোর একমাত্র উপায় সতর্ক নজরদারি ।
২০০৪ সালে সংসদের স্ট্যান্ডিং কমিটি বীজ আইনের বিষয়ে বেশ কিছু প্রস্তাব রেখেছিল । মোদি সরকার যে খসরা বিলটি আনার পরিকল্পনা করছে, তার মধ্যে অবশ্য এই সব প্রস্তাবের উল্লেখ নেই । সরকার এই বিলের বিষয়ে দেশের নাগরিকদের থেকে মতামত চাইছে । নভেন্বরের শেষের মধ্যে পরামর্শ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে । ২০১৯ সালের খসরা বিলের ২১ নম্বর ধারা অনুযায়ী, এই ধরনের প্রতারণার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে ওই বিক্রেতা সংস্থাকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং তা দিতে হবে ১৯৮৬ সালের কনজিউমার অ্যাক্ট অনুযায়ী । যদিও এর ফলে কৃষক এমন কিছু উপকৃত হবেন না কারণ, এর ফলে প্রতারক সংস্থাকে শুধুমাত্র বীজের দাম এবং তার উপর যদি কোনও সুদ হয় তা দিতে হবে । কিন্তু সেই খারাপ বীজ কিনে কৃষকের শুধুমাত্র ফসলের ক্ষতি হচ্ছে না । এর ফলে নষ্ট হচ্ছে তাঁর সময়, পরিশ্রম এবং চাষের কাজের জন্য আনুষাঙ্গিক অর্থ । এর আরেকটি বড় সমস্য হল, এই অর্থটুকুও হাতে পেতে সমস্ত কাজ ফেলে তাঁকে আদালতে পড়ে থাকতে হবে । তাই এই বিষয়টি আগে নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কৃষককে তাঁর ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দিতে সংস্থা বাধ্য থাকে এবং কৃষককে তা পেতে হয়রান না হতে হয় । খসরা বিলে এই বিশেষ পরিবর্তনটি দেখতে চাইছেন কৃষকরা । এই ধরনের বিষয়গুলি দেখার জন্য গঠিত কমিটিতে নিজেদের প্রতিনিধিত্বও চাইছেন কৃষকরা, যাতে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ ও মানবিক হয় ।
বর্তমান আইন অনুযায়ী সংস্থাগুলি নিজেদের পণ্যের মানের বিষয়ে নিজেরাই শংসাপত্র দিতে পারে। খসরা বিলে এই বিষয়টিকে বেআইনি বলে চিহ্নিত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যা সমগ্র কৃষক সমাজের কাছে অত্যন্ত আশার বিষয়।
তবে বিলে এটারও উল্লেখ রয়েছে যে, বাণিজ্যিক ফসলের বীজের দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকবে কমিটির হাতে এবং খুব সুনির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্র ছাড়া দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না । এই বিষয়টি কিন্তু কৃষকদের একেবারেই সাহায্য করবে না । ফসলের ধরন বা সময়ের উপর নির্ভর না করে রাজ্য সরকারগুলির উচিত দাম নিয়ন্ত্রণ করা । এই বিষয়টি বিলে রাখা উচিত । খসরা বিলের ৪০ নম্বর ধারা অনুযায়ী, পরিবেশ সুরক্ষা আইনের নিরিখে বিদেশ থেকে আমদানি করা বীজের কথা মাথায় রাখা হয়েছে । কৃষকদের দাবি, এই বীজগুলিকে দেশীয় পরিবেশে ২১ দিন রেখে আলাদা করে পরীক্ষা করে তবেই বাজারে বিক্রির জন্য ছাড়া হোক । এই বিষয়টির সংস্থান বিলে রাখার দাবি জানিয়েছেন কৃষকরা ।
সাধারণত বীজের মান মাপা হয় ১০০ শতাংশ এবং ফসলের মান মাপা হয় ৮০ শতাংশের ভিত্তিতে । এর নিচে থাকা যে কোনও কিছুকেই অতি খারাপ মানের বলে ধরা হয় । বীজ আইনের ২৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী বীজ বিক্রির অনুমতি শুধুমাত্র কৃষিতে ডিগ্রিধারীরাই পেতে পারেন । বীজ তৈরির ক্ষেত্রে জিনের গুণমান, কৃষকদের নিম্নমানের বীজ বিক্রির মতো অসাধু বিষয়গুলিকে নজরে রাখতে হবে এবং এই জাতীয় কাজের সঙ্গে যুক্তদের ন্যূনতম এক বছর জেল এবং অথবা ২৫ হাজার টাকা থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার ব্যবস্থা থাকতে হবে । সংসদের স্ট্যান্ডিং কমিটির সুপারিশে এই ধরনের অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ এক বছর জেল এবং/অথবা ২ থেকে ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানার সুপারিশ ছিল । তবে ২০১৯ সালের খসরা বিলে এই শাস্তির পরিমাণ অনেকটাই কমিয়ে দেওয়া হয়েছে । এই বিষয়টি সংশোধন করে স্ট্যান্ডিং কমিটির সুপারিশ মেনে নিতে হবে । দেখতে হবে, এই জাতীয় অপরাধের সঙ্গে যুক্ত সংস্থাগুলির লাইসেন্স যেন চিরতরে বাতিল করা হয় । পাশাপাশি এই সংস্থাগুলিকে PD অ্যাক্টের আওতায় আনতে হবে, যাতে আর কোনও দিনই তারা এই জাতীয় কাজ করার সাহস না পায় ।
আশা কর্মী, রুথু স্বরাজ্য বেদিকা এবং অখিল ভারতীয় রুথু সঙ্ঘমের তরফ থেকে কৃষি মন্ত্রককে এই বিষয়ে একাধিক সুপারিশ করা হয়েছে । খসরা বিলটি চূড়ান্ত রূপ পাওয়ার আগে এই সুপারিশগুলো বিলে জায়গা পেলে কৃষকরা অত্যন্ত লাভবান হবেন ।
কৃষকের অধিকার
সবার আগে এটা দেখা উচিত, ১৯৬৬ সালের প্রাচীন বীজ আইন আজকের দিনে আর আদৌ কার্যকর কি না। এই বীজ আইনের ফাঁক গলেই বিভিন্ন অসাধু সংস্থা বীজ প্রস্তুতি এবং বণ্টনে স্বচ্ছতা রাখে না। তারা অনেক ক্ষেত্রে এটাও জানাতে রাজি হয় না, কোন প্রক্রিয়ায়, কী ধরনের গবেষণায় নতুন ধরনের বীজ তারা তৈরি করছে। এমনকি বীজের গুণমান নিয়ে তারা কৃষি দপ্তরের সঙ্গেও বিশেষ আলোচনা করে না । ফলশ্রুতি, বাজারে বিক্রি হওয়া বীজের গুণমান সংক্রান্ত কোনও তথ্যই সরকারের কাছে থাকে না। এই ধরনের সংস্থাগুলির সঙ্গে যোগাযোগ থাকে দালালদের, যাদের কাজ কৃষকদের বুঝিয়ে এই খারাপ বীজ কিনতে বাধ্য করা। এর ফলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সময় সংস্থাগুলি যুক্তি দেয়, কৃষকরা তাদের কাছ থেকে সরাসরি বীজ কেনেননি, ফলে এই বীজের দায়ও তাদের নয় । এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন কৃষকরা । এই অবস্থা যাতে না হয়, তার জন্য সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে, পাশে দাঁড়াতে হবে ক্ষতিগ্রস্ত ও অসহায় কৃষকদের।