সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক এবং স্পর্শকাতর অযোধ্যা রায়ের পর ভারতবর্ষে ধর্মনিরপেক্ষতা কি আরও শক্তিশালী হল ? তিন দশকের অবিশ্বাস আর ভুল বোঝাবুঝি কি আস্তে আস্তে কমে যাবে ? ভবিষ্যতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সংগঠনগুলি কি দেশের বিভিন্ন ধর্মস্থান ও পুরোনো বিবাদ-দ্বন্দ্বে নাক গলানো বন্ধ করবে ?
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আগে বা পরে কোনওরকম হিংসার ঘটনা সামনে না আসায় এখন এই প্রশ্নগুলিই সাধারণ মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে । তাদের ১১১০ পাতার রায়ে ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে একাধিক মন্তব্য করেছে শীর্ষ আদালত । ভবিষ্যতে ধর্মীয় স্থানগুলি নিয়ে যেন কোনওরকম বিতর্কের সৃষ্টি না হয়, সেদিকে বিশেষ নজর দিয়ে একাধিক প্রশ্নের বিশদ ব্যাখ্যা করেছে সুপ্রিম কোর্ট । মধ্যযুগে হওয়া অবিচারের অজুহাতে বিশেষ কোনও ধর্মের প্রতি কোনও রকম হিংসা বা অভিযানকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়েছে শীর্ষ আদালত ।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনাকে মুহূর্তের আবেগে হওয়া ঘটনা না বলে বেআইনি আখ্যা দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট । এই ঘটনাকে তারা সাড়ে চারশো বছর আগে তৈরি হওয়া উপাসনাস্থল থেকে মুসলিমদের বলপূর্বক বিতাড়ন হিসাবে ব্যাখ্যা করেছে । তাদের মতে, ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, যেখানে আইন সবার জন্য একই, সেখানে এই ধরনের ঘটনা কোনওভাবেই মেনে নেওয়া যায় না । এই একই কারণে শীর্ষ আদালত জানিয়েছে, বিচার সমান হবে না, যদি মুসলিমদের জন্য বিকল্প জমির ব্যবস্থা না করা হয় ।
দেশের জনসাধারণের একটা অংশ, যাদের দাবি, ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি পশ্চিমের দেশ থেকে এ দেশে আমদানি করা হয়েছে, তারা ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টিকে একেবারেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে । সেই ১৯২০ সাল থেকে চলে আসা একটি অদ্ভুত বিতর্কের বিষয় হল, যারা নিজেদের দেশকে কর্ম ও উপাসনাস্থল হিসাবে দেখতে পারে না, তারা কখনই এ দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের মেলাতে পারবে না ।
শেষ তিন দশকে এই ধারণা আরও মজবুত হয়েছে । কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, সংবিধান মেনে চলাই যথেষ্ট নয় । এই রকম বুদ্ধিজীবীদেরও অভাব নেই, যাঁরা মনে করেন, শতাব্দী প্রাচীন সংস্কৃতি থেকে অনুপ্রাণীত না হলে জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠে না ।
রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ বিতর্কের পর ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে । রাজনীতিতে প্রবল জনপ্রিয় হয়েছে ছদ্ম-ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দবন্ধটি ।
কেবলমাত্র বিশ্বাস ও আস্থার উপর নির্ভর করে যে বিতর্কিত ১৫০০ গজ জমির ফয়সালা করা সম্ভব নয়, তা রায়ের ছত্রে ছত্রে বুঝিয়ে দিয়েছে শীর্ষ আদালত । সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষতা, ন্যায়বিচার এবং প্রমাণের উপর ভিত্তি করেই এই মামলার রায় দেওয়া হয়েছে । মন্দির-মসজিদের এই দ্বন্দ্ব যে শুধুমাত্র দেশকে রাজনৈতিকভাবে কাঁপিয়ে দিয়েছিল তা-ই নয়, দেশের ধর্মনিরপেক্ষতাকেও প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল ।
এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার অন্তর্নিহিত ব্যাখ্যা দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট । ধর্মনিরপেক্ষতাকে ব্যক্তিগত পছন্দ বা মতাদর্শ হিসাবে না দেখে একে ধর্মীয় সহনশীলতার অংশ হিসাবে ব্যাখ্যা করেছে শীর্ষ আদালত । ধর্মনিরপেক্ষতাকে সাংবিধানিক কাঠামোর অংশ হিসাবে ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি একে সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশও বলেছে সুপ্রিম কোর্ট । শীর্ষ আদালত এটা স্পষ্ট করে জানিয়েছে যে, সরকার, দেশের নাগরিক এবং বিচারব্যবস্থাকে ধর্মনিরপেক্ষতা মেনে চলতেই হবে ।
বোম্মাই মামলার শুনানির সময়ে বিচারপতিদের নয় সদস্যের প্যানেলের অন্যতম বিচারপতি জীবন রেড্ডি ধর্মনিরপেক্ষতার স্পষ্ট সংজ্ঞা দিয়েছিলেন । তিনি বলেছিলেন, ধর্মীয় সংঘর্ষের সময় নিরপেক্ষ থাকা ধর্মনিরপেক্ষতা নয় । অযোধ্যা মামলার রায়ের সময় বিচারপতি জীবন রেড্ডির সেই বক্তব্য মনে করিয়ে দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বলে, ধর্মনিরপেক্ষতাকে আমাদের পাখির চোখ করা উচিত, আর তাই এটি ভারতীয় সংবিধানের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ।
ধর্মীয় উপাসনাস্থলগুলোতে যাতে এই ধরনের বিতর্ক ভবিষ্যতে আর না ঘটে, তার দিকে বিশেষ নজর দিতে সুপ্রিম কোর্ট বারবার 1991 সালের উপাসনা আইনের উল্লেখ করেছে । এই আইন অনুসারে, 1947 সালের 15 অগাস্ট অনুযায়ী যে ধর্মস্থান যেমন ছিল, তার পরিবর্তন করা যাবে না । কেউ যদি এর অন্যথা করে, তা হলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে ।