ভারতীয় রেল কি যাত্রী সুরক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে ? নতুন লাইন পাতার সময়, ন্যারোগেজ বা মিটারগেজ থেকে ব্রডগেজে পরিবর্তনের সময় বা সার্বিক কাজকর্মে খরচ কমানোর সময় কি কোনও উন্নতির কথা মাথায় রাখা হয়েছিল ? সংসদীয় স্থায়ী কমিটি কিন্তু এই প্রত্যেকটা প্রশ্নের একটাই উত্তর দিয়েছে— না । তিন বছর আগে বাজেট পেশ করার সময় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ২০১৭-'১৮ অর্থবর্ষ থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য প্রতি অর্থবর্ষে রাষ্ট্রীয় রেল সুরক্ষা কোষ প্রকল্পে ২০ হাজার কোটি টাকা করে বরাদ্দ করার । সেই বছর , এই প্রকল্পের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা রাখতে পেরেছিলেন অর্থমন্ত্রী । কিন্তু পরিস্থিতির দ্রুত বদল হয় । কমিটি অভিযোগ করে, এই খাতে বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ কমিয়ে এক চতুর্থাংশ করা হয়েছে এবং তারা এই অর্থের মাত্র অর্ধেক খরচ করতে পারছে । পুরো প্রকল্পের উদ্দেশ্য বিনষ্ট হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন কমিটির সদস্যরা । চিন্তা বাড়িয়েছে নতুন রেলপথ তৈরিতে ধীর গতি এবং রেলের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব । ২০১৮-'১৯ সালের মধ্যে যেখানে হাজার কিলোমিটার রেলপথ তৈরির কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার কথা ছিল, সেখানে সম্পূর্ণ হয়েছে মাত্র ৪৭৯ কিলোমিটার । ২০১৯-'২০ সালের জন্য এই লক্ষ্যমাত্রা অর্ধেকে নামিয়ে আনা হলেও কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ২৭৮ কিলোমিটারের । অর্থের যোগান কমতে থাকলে নিরাপত্তার গুরুত্ব যে কমতে থাকবে তা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে । রেলের হতশ্রী দশার আরও একটি সূচক অবশ্যই অপারেটিং রেশিও (OR)। সংসদীয় স্থায়ী কমিটি অভিযোগ করে , রেলবোর্ড প্রতি 100 টাকা আয়ে ৯৭ টাকাই খরচ করে। এবং রেলবোর্ডকে কমিটি পরামর্শ দেয় বাড়তি খরচ ছেঁটে ফেলে আয় বাড়াতে । কমিটির এই রিপোর্ট থেকেই স্পষ্ট ভারতীয় রেলে বহু ফাঁক রয়েছে ।
"লাইনচ্যুত" যাত্রী সুরক্ষা! - Safety derailed of Indian Rail
ভারতীয় রেল যাত্রী সুরক্ষার দিকে নজর দিচ্ছে না । অন্যদিকে অ্যামেরিকা আর চিন দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে উপগ্রহচালিত সিগন্যাল ব্যবস্থার দিকে । এর ফলে ট্র্যাকের বিপদ সম্বন্ধে আগাম সতর্ক থাকা যায় । এদের তুলনায় আমাদের রেল পরিষেবাকে খুবই ম্লান দেখতে লাগে যেখানে যাত্রী সুরক্ষার বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয় না, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় না এবং খুবই খারাপভাবে পণ্য পরিষেবা দেওয়া হয় । এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সরকারকে দায়িত্ব নিতেই হবে । আর ভারতীয় রেল শক্তিশালী হলে তাতে দেশের অর্থনীতিই উপকৃত হবে ।
তিন মাস আগে, রেলের আর্থিক ব্যবস্থায় গরমিল রয়েছে বলে একটি রিপোর্টে জানায় CAG । রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৭-'১৮ সালে রেলের আয় ও খরচের অনুপাত গত ১০ বছরের তুলনায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় ছিল । যদি NTPC এবং IRCON সঠিক সময়ে রেলকে বকেয়া সাত হাজার তিনশো কোটি টাকা দিয়ে দিত, তা হলে রেলের OR হয়ে যেত ১০২.৬৬ শতাংশ । এক বছর আগে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কমিটি জানিয়েছিল যে , ভারতীয় রেল যারা কি না সেই সময় টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল, তারা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মেরামতির কাজে ঢিলেমি দিচ্ছিল। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, যে দেশে ৬০ শতাংশ শ্রমিক কম রয়েছে, সেখানে ৩৭ হাজারেরও বেশি ব্রিজ রয়েছে যেগুলি একশো বছরেরও বেশি পুরানো । ২০১৬-'১৭ সাল পর্যন্ত রেল অভ্যন্তরীণ সংস্থান থেকেই মোট আয়ের ১১ শতাংশ আয় করতে পারত । পরবর্তী তিন বছরে সেই পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৩.৫ শতাংশে । সর্বশেষ বাজেট অনুযায়ী এই পরিমাণ বাড়িয়ে ৪.৬ শতাংশ হওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে এই বছরে । যদিও এই লক্ষ্যমাত্রা কী করে পূরণ করা সম্ভব, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে । এমনকী যাত্রাপথকে রেল কীভাবে আরও আরামপ্রদ ও নিরাপদ করতে পারবে, সে বিষয়েও সংশয় রয়েছে । রেলের আধুনিকীকরণের জন্য ৮.২২ লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ করার সুপারিশ করেছিল স্যাম পিত্রোদা কমিটি । এমন সময়ে, যখন রেল তার সম্পদ থেকে বার্ষিক সাত থেকে আট হাজার কোটি টাকা আয় করতেই ব্যর্থ হচ্ছে, তখন সময়ের পরীক্ষায় রেল আদৌ জয়ী হতে পারবে কি না সেটাই বড় প্রশ্ন ।
২০ হাজারের বেশি ট্রেন যা আটশো কোটি যাত্রী বহন করে প্রত্যেক বছরে, সেই ভারতীয় রেল দেশের অন্যতম লাইফলাইন । বহু সমীক্ষা বার বার রেলে পরিবর্তনের সুপারিশ করলেও তার প্রয়োগ সেভাবে বাস্তবায়িত হয়নি । গত সাড়ে ছয় দশকে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে মাত্র ৩০ শতাংশ বৃদ্ধিই প্রমাণ করে যে, পরিকাঠামোগত উন্নতিতে রেল কতটা অবহেলার শিকার । দক্ষিণ-মধ্য রেলে খাবার নিয়ে অভিযোগের সংখ্যা দেখেই বাকি জ়োনগুলির অবস্থা সম্বন্ধে একটা আন্দাজ করা যায় । খারাপ মান, ভর্তুকির অপব্যবহার, যাত্রী সুরক্ষার সঙ্গে আপস... রেলের এই অত্যন্ত খারাপ অবস্থার জন্য নিঃসন্দেহে দায়ি দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা । দেশ গঠনে রেলের ভূমিকার সঠিক আন্দাজ করে মোদি সরকার রেলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে । বর্তমান সিগন্যালিং ব্যবস্থায় পুরোপুরি বদল আনতে ইতিমধ্যেই কাজ শুরু হয়েছে । ২০২৩ সালের মধ্যে দেশের সব রেলপথ বৈদ্যুতিকীকরণ করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে । কিন্তু সব সংস্কারের এখানেই শেষ হচ্ছে না । পাঁচ বছর আগে ইউরোপিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের একটি তুলনামূলক রিপোর্টে দেখা গেছে যে, সবচেয়ে নিরাপদ রেল পরিষেবা দেয় ডেনমার্ক । অন্যদিকে জাপান প্রসিদ্ধ নিয়মানুবর্তিতা এবং রেলপথে উন্নত প্রযুক্তির জন্য । অ্যামেরিকা আর চিন দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে উপগ্রহচালিত সিগন্যাল ব্যবস্থার দিকে । এর ফলে ট্র্যাকের বিপদ সম্বন্ধে আগাম সতর্ক থাকা যায় । এদের তুলনায় আমাদের রেল পরিষেবাকে খুবই ম্লান দেখতে লাগে যেখানে যাত্রী সুরক্ষার বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয় না, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় না এবং খুবই খারাপভাবে পণ্য পরিষেবা দেওয়া হয় । এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সরকারকে দায়িত্ব নিতেই হবে । আর ভারতীয় রেল শক্তিশালী হলে তাতে দেশের অর্থনীতিই উপকৃত হবে ।