বৃষ্টির জল সংরক্ষণের নিরিখে বিশ্বের মধ্যে ভারতের স্থান সবার নিচে ৷ মাত্র 8 শতাংশ জল সংরক্ষণ করা হয় এই দেশে । অন্যদিকে, মাটির নিচের জল ব্যবহার করা হয় বিন্দুমাত্র কোনও পরিকল্পনা ছাড়াই ৷ আর এর অবশ্যম্ভাবী ফল হল ভারতের ভূগর্ভস্থ জলের পরিমাণ প্রায় শেষের দিকে । ছয়-সাত সপ্তাহ আগে, কেন্দ্রীয় সরকার 'জল শক্তি অভিযান' নামে একটি অভিনব প্রকল্পের সূচনা করেছে । দেশের বেশ কয়েকটি রাজ্যের 156টি জেলার 1592টি ব্লকে প্রাথমিকভাবে এই প্রকল্পের সূচনা করা হয়েছে । একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, প্রতিটি এলাকায় বিশুদ্ধ এবং স্বচ্ছ পানীয় জল পৌঁছে দেওয়া হবে ।
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়িকে তাঁর জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার শুরু করেছে 'অটল ভূ-জল যোজনা' । প্রাথমিকভাবে এই প্রকল্পের জন্য মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, রাজস্থান, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, কর্নটকের 78টি জেলার 8300টি এলাকাকে বেছে নেওয়া হয়েছে । প্রাথমিকভাবে, এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে 6000 কোটি টাকা । পাঁচ বছরের এই প্রকল্পের জন্য বিশ্ব ব্যাঙ্ক থেকে অর্ধেক ধার নেওয়া হচ্ছে । রাজ্যগুলির স্বার্থের কথা বিবেচনা করে এ-বিষয়ে অর্থ বরাদ্দ করা হবে বলে জানানো হয়েছে । তথ্য-পরিসংখ্যানের নিরিখে এই প্রকল্পে নিজেদের নাম নথিভুক্ত করানোর জন্য পঞ্জাব সরকারের তরফে আবেদন জানানো হয়েছে । পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং প্রশ্ন তুলেছেন, কেন প্রাথমিক তালিকায় পঞ্জাব থাকবে না, তা নিয়ে । তাঁর প্রশ্ন, পাঠানকোট এবং মুখতাসার ছাড়া বাকি প্রতিটি জেলায় জলের স্তর অনেকটা কমে গিয়েছে, তাও কেন সাহায্য পাবে না পঞ্জাব । দাবি করেছেন, 'অটল ভূ-জল যোজনা' প্রকল্পে নিজ রাজ্যের নাম অবিলম্বে নথিভুক্ত করানোর জন্য । আসলে প্রথমেই অনেক বেশি এলাকা নথিভুক্ত করা হলে, এই প্রকল্প কার্যকর করতে সমস্যা তৈরি হতে পারে এই ভেবেই কেন্দ্রীয় সরকার 'ধীরে চলো' নীতি নিয়েছে । এমনকী, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আশ্বাস দিয়েছেন, দেশের যে সব গ্রামে ভূ-গর্ভস্থ জলস্তর অনেকটাই নেমে গিয়েছে, এবং ঠিক মতো প্রয়োজনীয় মাত্রায় পানীয় জল পাওয়া যাচ্ছে না, তেমন প্রতিটি গ্রামেই এই প্রকল্প চালু করা হবে । দেশের প্রতিটি মানুষ যাতে প্রয়োজনীয় পানীয় জল পেতে পারেন, সেটা সুনিশ্চিত করাই যে কেন্দ্রীয় সরকারের একমাত্র লক্ষ্য, সে কথাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ।
'ভারতের জল মানব' নামে পরিচিত রাজেন্দ্র সিং আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন 72 শতাংশ ভূ-গর্ভস্থ জল নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছে, এর ফল খুবই ভয়াবহ । চার বছর আগে NASA আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল, ভারতে মাটির তলার জল অতি দ্রুত হারে শেষ হয়ে যাচ্ছে । প্রয়োজনের থেকে অর্ধেক পরিমাণ জল রয়েছে মাটির তলায় । সব থেকে বেশি জল মজুত রয়েছে আমেরিকায় । ভারতের ভূ-গর্ভস্থ জলস্তরের এই ভয়ঙ্কর অবস্থার জন্য দায়ি করা হয়েছে বেহিসেবি-পরিকল্পনা ছাড়া ব্যবহার, মাত্রাতিরিক্তভাবে জলের অপচয়কে ।
স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময় দেশে মাথাপিছু 6042 কিউবিক মিটার ভূ-গর্ভস্থ জল মজুত ছিল, এখন এই পরিমাণটা কমে দাঁড়িয়ে অর্ধেকের অর্ধেক । প্রতিনিয়ত এই পরিমাণ কমছে । স্বাভাবিকভাবেই পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করছে । বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে দ্রুত-সঠিক-কার্যকর পদক্ষেপ করার ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছার অভাব দেখা যাচ্ছে । দেশের জনসংখ্যা হু হু করে বেড়ে চলেছে, তা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে সরকারের কোনও পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না, জনসংখ্যার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি কয়েক দশক আগেই সীমারেখাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে । এই বিপুল জনসংখ্যার চাপ সমস্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ । রিপোর্টে বলা হয়েছে, যে পরিমাণ জল অপচয় হচ্ছে-ব্যবহৃত হচ্ছে, তার অতি সামান্যতমই মজুত হচ্ছে । সংগ্রহ-সঞ্চয় এবং ব্যবহারের মধ্যে একটা বড় ব্যবধান দেখা যাচ্ছে । অপরিকল্পিতভাবে ব্যবহারের ফল হাতেনাতে টের পাচ্ছে দেশের বহু জেলা । ইতিমধ্যেই 160টি জেলায় জল প্রায় শুকিয়ে গিয়েছে । ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে 230টি জেলা, বলা ভালো ওই সব জেলাগুলি কার্যত খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে । পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে বিভিন্ন রাজ্যে একাধিক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে ৷ যেমন, মিশন কাকাটিয়া ( তেলাঙ্গানা), নেরু চেত্তু (অন্ধ্রপ্রদেশ), মুখ্যমন্ত্রী জল স্বাভিমান অভিযান (রাজস্থান), এবং সুজলম সুফলম যোজনা (গুজরাত)-এর নাম উল্লেখ করা যায় । তবে এক্ষেত্রেও একটা সমস্যা দেখা গিয়েছে । এই সব প্রকল্প কেন্দ্র-রাজ্যে সমন্বয়ের অভাবে অনেক ক্ষেত্রেই ধাক্কা খাচ্ছে । তাই বলা যায়, কেন্দ্র-রাজ্য সঠিক সমন্বয়ের মাধ্যমেই একমাত্র সবক'টি প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়ণ করা সম্ভব । এক্ষেত্রে রাজ্যের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারের সদিচ্ছাও একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক ।
সঠিক মাত্রায় জল সংরক্ষণ এবং জনসাধারণের কাছে তা পৌঁছে দেওয়া কোনওভাবেই সহজ কাজ নয় । সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার স্বচ্ছ জলের চাহিদা এবং জোগানের মধ্যে একটি তুল্যমূল্য যাচাই করে, তাতে দেখা গিয়েছে এই ব্যবধানটা 43 শতাংশেরও বেশি । এই পরিসংখ্যানের উপর নির্ভর করে 'জল জীবন' প্রকল্পের সূচনা করা হয়েছে, পাঁচ বছরের জন্য এই প্রকল্পে বরাদ্দ করা হয়েছে 3600 কোটি টাকা । প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে মিহির শাহ কমিটি প্রস্তাব রেখেছিল, কেন্দ্রীয় জল মন্ত্রক এবং কেন্দ্রীয় ভূ-গর্ভস্থ জল সংরক্ষণ দপ্তর যেন যৌথভাবে বিষয়টির পর্যবেক্ষণ করে । একমাত্র এভাবেই প্রকৃত সমস্যার সমাধান সূত্র বের হওয়া সম্ভব বলে মত প্রকাশ করেছিল কমিটি । এর পরই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জল সংরক্ষণের বিষয়ে কৃষকদের এগিয়ে আসতে অনুরোধ করেন । পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে কেন্দ্রীয় সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ ঘোষণা করে । সঠিক প্রশিক্ষণ, কীভাবে জল সংরক্ষণ করা হবে, কীভাবে চাষের কাজ জল ব্যবহার করা উচিত (কোনওরকম অপচয় না করে), সেই সব বিষয়গুলি কৃষকের সামনে তুলে ধরার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয় । ভূ-গর্ভস্থ জল সংরক্ষণের জন্য অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ব্রিটেন ইতিমধ্যেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করেছে । সদর্থক পদক্ষেপ করতে দেখা গিয়েছে চিনকেও । বেশ কিছু দেশ বর্তমানে বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে পদক্ষেপ করছে । জাতীয় সড়ক, রাস্তাঘাটের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যাতে জল অপচয় না হয়, সেজন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে । যদি দেশের প্রতিটি মানুষকে জলের একটি বিন্দুর সর্বোচ্চ ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন করা যায়, তাহলে শুধু কৃষিক্ষেত্রই নয়, উপকৃত হবেন দেশের প্রতিটি মানুষ । কথিত আছে, বিন্দু বিন্দু জলই সিন্ধুতে পরিণত হয় । এই ধারণাকে সামনে রেখে আমরা যদি জলের প্রতিটি বিন্দুকে সংরক্ষণ করতে পারি, তাহলেই একমাত্র বছরের শেষে আমাদের জল সংকটের সম্মুখীন হতে হবে না । একটা বড়সড় সংকটের হাত থেকে রেহাই পাবে গোটা দেশ । মাস পাঁচেক আগেই কেন্দ্রীয় সরকার একটি রূপরেখা প্রকাশ করেছিল দেশের প্রতিটি পৌরসভা এলাকার জন্য । ইতিমধ্যেই সেই রূপরেখা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে সর্বত্র । কীভাবে জল সংরক্ষণ করা উচিত, এ বিষয়ে পৌরসভাগুলির ভূমিকা কেমন হবে, সে সবই বলা হয়েছে । সেই রূপরেখা মতো কাজ করতে পারলে আশা করা যায় জল সংকটের মতো সমস্যার হাত থেকে আমাদের রেহাই মিলবে ।