তীব্র দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তুলে এবং ১৯৬০ সালের মর্মভেদী স্মৃতি ফিরিয়ে এনে, বাদল অধিবেশন চলাকালীন সংসদে স্বল্প পরিসরের আসন বিন্যাসের মধ্য থেকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী, রাজনাথ সিং, দেশকে LAC তথা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় চিনা PLA বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ভারতীয় সেনাবাহিনীর পরিস্থিতি জানিয়েছেন।
বাদল অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে, নিজের দেশাত্মবোধ উদ্রেককারী, আবেগঘন ভাষণে, ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন যে, লাদাখের শুষ্ক, ঊষর পাহাড়ি মাটিতে ঘাসের একটা চারা গজাক বা না গজাক, তবু সেই এলাকা ভারতের আঞ্চলিক সংহতির জন্য মূল্যবান।
১৯৬১ সালে জওহরলাল নেহরু সংসদে দাঁড়িয়ে মন্তব্য করেছিলেন যে, “লাদাখের বিতর্কিত এলাকায় একটা ঘাসের চারাও গজায় না।” অথচ সেখানেই রাজনাথ সিং সেনা বাহিনীকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়ে বলেছেন, “সেনা ওই এলাকায় ভারতের অঞ্চলভিত্তিক অধিকারের ক্ষেত্রে এক ইঞ্চি জমিতেও কোনও আপোস করবে না।”
নেহরুর কংগ্রেসের এক সহকর্মী, মহাবীর ত্যাগী, তাঁর সেই মন্তব্য নিয়ে ব্যঙ্গ করে পরে বলেছিলেন, “এখানে কিছুই যখন গজায় না...তাহলে কি এটা অন্য কাউকে দিয়ে দেওয়া উচিত?” সেই বয়ানে নেহরুর রাজনৈতিক ভাবমূর্তি অত্যন্ত ক্ষুণ্ণ হয়েছিল।
অথচ ঠিক তার বিপরীতে প্রধানমন্ত্রীর লাদাখ সফর নিয়ে প্রশংসা হয়েছিল এবং সিং নিজের ভাষণে এই বিষয়টির উল্লেখও করেছিলেন যে, প্রধানমন্ত্রীর সফরে ওই এলাকায় মোতায়েন থাকা সেনার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছে। LAC—তে সেনাবাহিনীর সামরিক প্রস্তুতি নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দিতে গিয়ে সিং বলেছিলেন, “ভারত দীর্ঘমেয়াদী অভিযানের জন্য প্রস্তুত।”প্রতিকূল আবহাওয়ার সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার অভিজ্ঞতাও বাহিনীর রয়েছে কারণ লাদাখের ওই এলাকায় যেখানে তাপমাত্রা কমে মাইনাস ৪০ ডিগ্রিরও নিচে নেমে যায়, সেখানে আবহাওয়ার এই বন্ধুরতাই হল সবচেয়ে বড় শত্রু।
সিংয়ের প্রতিটি কথা ছিল সাবধানী। তাঁর কথায় উঠে এসেছে অরুণাচল প্রদেশে ভারতের আওতাধীন ৯০,০০০ বর্গ কিমি এলাকার প্রসঙ্গ যা চিন নিজের বলে দাবি করছে এবং লাদাখে ভারতের আওতাধীন ৫১৮০ বর্গ কিমি এলাকার প্রসঙ্গ, যা চিনের মদতে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ করছে। এই প্রসঙ্গ উত্থাপনের মাধ্যমে সিং চিনকে মৃদুভাবে হলেও LAC এলাকায় স্থিতাবস্থা বজায় রাখার কথায় রাজি হতে এবং ভারতের অবস্থানকে সম্মান জানানোর ইঙ্গিত করেছেন, যাতে চিন গররাজি হয়েছে।
LAC এলাকার দুই প্রান্তেই বিপুল সেনা মোতায়েন করা হয়েছে, বিশেষ করে ১৫ জুন, গালওয়ান উপত্যকায় যখন চিনা সেনাবাহিনী হিংসার আশ্রয় নেয় এবং ভারতীয় সেনার রুটিন টহলদার বাহিনীর উপর হামলা চালায়, যাতে ২০ জন ভারতীয় সেনার মৃতু্য হয়। যদিও তার আগে ৬ জুন, দুই পক্ষের সেনাই এই বিষয়ে সম্মত হয়েছিল যে, এমন কোনও হিংসাত্মক ঘটনা, যা LAC—র স্থিতাবস্থা ভঙ্গ করে, তা যে কোনও মূলে্যই তারা এড়িয়ে চলবে। রাজনাথ লোকসভার ভাষণে চিনকে বার্তা দিতে গিয়ে আরও একটি প্রাণবন্ত বক্তব্য রেখেছেন। তিনি বলেছেন যে, কূটনীতিগত হোক বা সামরিক, যে কোনও রকম প্রচেষ্টা, যা একতরফাভাবে LAC—র স্থিতাবস্থা বিঘ্নিত করবে, ভারতীয় সেনা দাঁত—নখ উপড়ে দিয়ে তা প্রতিহত করবে।
অথচ ঠিক এর বিপরীতভাবে, ১৯৬২ সালের আগে ভারতের সামরিক প্রস্তুতিও কিন্তু কম মজবুত ছিল না। বরং কৌশলগত নিরিখে থেকে ভারত নানা দিকে সুবিধাজনক স্থানে ছিল। যেমন থাং লা পোস্ট, যার সামনেই ছিল তিব্বত ও খেনজেমানের কিছু গ্রাম, ঢোলা পোস্ট এবং ম্যাকমোহন লাইনের কাছে অবস্থিত আরও কিছু এলাকা। ১৯৫৯ সাল থেকে শুরু করে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত নেহরু সরকার টহলদারি সেনার ছাউনিগুলির মধ্যবর্তী সমস্ত ফাঁকা এলাকায় সেনা মোতায়েন করে ঢেকে দিয়েছিলেন। যথেষ্ট প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল কিন্তু এখনকার মতো রাজনৈতিক এবং কূটনীতিগত ভান সেই সময় ছিল না। রাজনৈতিক ভানের আগল ছিল শিথিল। সীমান্তে প্রহরারত বাহিনীর মধ্যে সংযোগরক্ষায় বড়সড় ব্যবধান তৈরি হয়েছিল।
অসম রাইফেলসের মতো বাহিনী, যারা পূর্বের সীমান্তে প্রহরার দায়িত্বে ছিল, তাদের সঙ্গে সেনার কোনও যোগাযোগ ছিল না কারণ অসম রাইফেলস, অসামরিক সরকারের কাছে রিপোর্ট করত, যাদের সীমান্তরক্ষার প্রোটোকল নিয়ে কোনও ধারণাই চিল না। ষাটের দশকে সীমান্ত সমস্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াও অপর্যাপ্ত এবং অযথার্থ ছিল। বরাবরের আগ্রাসী চিন, গোটা দুনিয়াকে বোঝাত, তারা বঞ্চনার শিকার, অথচ আজ তাদের সেই মুখোশ খুলে গিয়েছে। তৎকালীন নেহরু সরকারের তুলনায় এখন আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া অনেকটা বেশি তৎপর।
এমনকী, স্পেশ্যাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের প্রতিষ্ঠা, যা বর্তমানে ভারতের অভিজাত সেনাবাহিনী এবং যারা উচ্চ এলাকায়, চোরাগোপ্তা আক্রমণ প্রতিহত করতে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত, তা কিন্তু ছিল নেহরুরই মস্তিষ্কপ্রসূত। ১৯৫৯ সালের বিদ্রোহের পর তিব্বতীয়রা যখন ভারতে স্থানান্তরিত হয়েছিল, তখন নেহরু এই বাহিনী গড়ে তোলার ধারণা দেন। কিন্তু চলতি মাসের গোড়ায়, এরই এক সদসে্যর লাদাখে মৃতু্যর পর বর্তমান সরকারের তরফে SFF-কে প্রকাশ্যে আনার পদক্ষেপ ছিল চিনের জন্য বড়সড় আঘাত। দেশগঠনে নেহরুর অবদান কোনওভাবেই এড়ানো যাবে না কিন্তু LAC—র নিরিখে কীভাবে জনগণের কাছে ভান করতে হয়, তা রাজনৈতিকরাই সবচেয়ে ভালোভাবে জানেন।
জনতার জন্য ভান করা আর দেশগঠন : রাজনীতির দুই অবিচ্ছেদ্য অংশ - প্রতিরক্ষামন্ত্রী, রাজনাথ সিং
বাদল অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে, নিজের দেশাত্মবোধ উদ্রেককারী, আবেগঘন ভাষণে, ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন যে, লাদাখের শুষ্ক, ঊষর পাহাড়ি মাটিতে ঘাসের একটা চারা গজাক বা না গজাক, তবু সেই এলাকা ভারতের আঞ্চলিক সংহতির জন্য মূল্যবান।
বিলাল ভাট, ETV ভারত