চিকিৎসক, হাসপাতাল, ওষুধপত্র, অন্যান্য সুযোগ সুবিধা—স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সমস্যার যেন শেষ নেই। এই সব সমস্যার সমাধানে সরকার গতানুগতিক কিছু ব্যবস্থা নিলেও পাকাপাকি ভাবে তেমন কিছু করছে না। ফলশ্রুতি, স্বাস্থ্য পরিষেবার দৈনদশার জন্য ভুগতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এই সমস্যায় সবচেয়ে বেশি ভুগছে আমাদের গ্রামগুলো। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে প্রয়োজন ও প্রাপ্তির মধ্যে গ্রামে রয়েছে বিস্তর ফারাক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বলছে প্রতি এক হাজার জনে এক জন করে চিকিৎসকের প্রয়োজন। ভারতে সেখানে চিত্রটা ভয়ঙ্কর। এ দেশে প্রতি ১০ হাজার ১৮৯ জনের জন্য রয়েছেন এক জন করে চিকিৎসক। সমীক্ষা বলছে, দেশে এই মুহূর্তে ছয় লক্ষ চিকিৎসক এবং ২০ লক্ষ নার্সের ঘাটতি রয়েছে। দারিদ্র সীমার নীচে থাকা ৩০ কোটি মানুষের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার বিপুল খরচ দেশের পক্ষে মস্ত বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দুশ্চিন্তার আরও একটি বড় জায়গা হল, উন্নত মানের স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার নিরিখে বিশ্বের ১১৭টি দেশের মধ্যে ভারত রয়েছে ১০২ নম্বরে। চিন, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ভুটানের মতো ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলি এই তালিকায় রয়েছে ভারতের উপরে। যক্ষ্মা, হার্ট সংক্রান্ত বিভিন্ন রোগ, ক্যানসার, কিডনির সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের সুচিকিৎসা দিতে পারছে না ভারত। আশ্চর্যজনক ভাবে
খাদ্য সমস্যায় ভোগা বিশ্বের প্রথম ৪৫টি দেশের মধ্যে রয়েছে ভারত। সমীক্ষা বলছে, এই খাদ্য সমস্যার জন্য আমাদের শিশুদের গড় ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে ২১ শতাংশ কম হয়। আমাদের দেশে মাত্র ২৭ শতাংশ মানুষের স্বাস্থ্য বিমা রয়েছে। এর পিছনে অবশ্য রয়েছে একাধিক কারণ। তবে প্রধান কারণ হল, বিমা সংস্থাগুলির দরিদ্র ও গ্রামের মানুষদের কম প্রিমিয়ামে বিমার সুবিধা দিতে না চাওয়া। অন্য বড় কারণটি হল, স্বাস্থ্য বিমা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব। স্বাস্থ্য পরিষেবা সংক্রান্ত সরকারি বেশিরভাগ প্রকল্পই মানুষের প্রয়োজন সঠিক ভাবে মেটাতে পারে না। কোনও ক্ষেত্রে এর কারণ অর্থের অভাব, কোনও ক্ষেত্রে তৃণমূলস্তরে এই সব প্রকল্পের কাজ করার সমস্যা। ২০১৭ সালে কেন্দ্র দেশের প্রতিটা মানুষের জন্য জাতীয় স্বাস্থ্য প্রকল্প চালু করে। গত বছর ২৩ সেপ্টেম্বর সরকারি ভাবে চালু হয় আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্প। এই প্রকল্পের লক্ষ্য সবাইকে স্বাস্থ্য পরিষেবার আওতায় আনা এবং পরিবারপিছু পাঁচ লক্ষ টাকা বিমার ব্যবস্থা করা। দেশ জুড়ে প্রায় ৫০ কোটি মানুষ এই প্রকল্পের আওতায় রয়েছেন। তবে একটা বিপরীত মত হচ্ছে, এই প্রকল্প লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থ হয়েছে।
আয়ের ২০ থেকে ৬০ শতাংশ ওষুধের জন্য খরচ হওয়ায় বহু পরিবার সেই খরচ বহন করতে পারে না। এই কথা মাথায় রেখে কেন্দ্র প্রধানমন্ত্রী জন ঔষধী আউটলেট খুলেছে। এই প্রকল্পে ইতিমধ্যেই দেশে পাঁচ হাজার ওষুধের দোকান খোলা হয়েছে। এই দোকানগুলির লক্ষ্য, কম দামে উন্নত মানের ওষুধ সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। সরকারের লক্ষ্য, ২০২০ সালের মধ্যে দেশে আরও আড়াই হাজার জন ঔষধী দোকান খোলার।
২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে খরচ হয়েছে মোট GDP-এর মাত্র ০.৯৮ শতাংশ। এই পরিমাণ ২০১৪ সালে বেড়ে হয় ১.২ শতাংশ এবং ২০১৮ সালে ১.৪ শতাংশ। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ খরচ হয় শুধুমাত্র প্রাথমিক স্বাস্থ্যক্ষেত্রে। উল্লেখযোগ্য ভাবে, আমেরিকার মতো উন্নত দেশে স্বাস্থ্য খাতে খরচ হয় দেশের মোট GDP-এর ১৮ শতাংশ।
এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া একেবারেই সহজ নয় যে, ভারত কবে স্বাস্থ্য খাতে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করতে পারবে। তবে সবার আগে প্রয়োজন স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রাথমিক সুযোগ সুবিধা ও পরিকাঠামোর উন্নয়ন। দরিদ্র ও দারিদ্র সীমার নীচে থাকা মানুষদের চিহ্নিত করে সরকারকে স্বাস্থ্য বিমার আওতায় আনতে হবে। সরকার যদি বিমার সম্পূর্ণ বা আংশিক অংশ বহন করে, তা হলে দেশের দরিদ্র শ্রেণির খুবই উপকার হবে।
চিকিৎসক বা স্বাস্থ্য পরিষেবার সমস্যা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, যদি দেশের প্রতিটা জেলায় একটা করে মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন করা যায়। ২০১৩ সালে দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা ছিল আট শতাংশ। এই পরিমাণ ২০৫০ সালের মধ্যে ১৮.৩ শতাংশে পৌঁছবে বলে মনে করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষে এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে, কারণ এই বয়স্ক মানুষদের স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত সমস্যায় ভোগার আশঙ্কা সবসময়ই বেশি থাকে।
চিকিৎসকের অপ্রতুলতা-সহ একাধিক সমস্যার জন্য গ্রামীণ এলাকায় সঠিক স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয় না। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে দেশের বয়স্ক মানুষদের বিশেষ সুবিধা দিতে ১৯৯৯ সালে এক জাতীয় প্রকল্প নেয় কেন্দ্রীয় সরকার। ২০১১ সালে সরকারি ভাবে একটি স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রকল্পও চালু করা হয়। রোগের ছড়িয়ে পড়া আটকাতে প্রয়োজন প্রাথমিক স্তরে রোগ নির্ণয় ও সঠিক চিকিৎসা। এই ব্যাপারে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। জনগণের অধিকার হিসাবে কেবলমাত্র স্বাস্থ্যের পরিচয় জানা এই উদ্দেশ্য পূরণ করবে না। আরও উন্নত স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্য খাতে বাড়তি বরাদ্দ, তৃণমূলস্তরে সুযোগ সুবিধা ও স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নতি। সমস্যার সমাধানে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলিকে হাতে হাত রেখে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।