ভারতীয় সংবিধানের প্রথম অনুচ্ছেদ ঘোষণা করে যে, ভারত একটি যুক্তরাষ্ট্র । সংবিধান প্রণেতারা মনে করেছিলেন যে, সুসংগঠিত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সংসদীয় গণতন্ত্র এগিয়ে যাবে । কিন্তু দেশের বর্তমান পরিস্থিতি অন্য কথা বলছে । দিল্লির লেফটেনন্ট গভর্নর যখন প্রকাশ্যেই বলেন যে, ‘‘আমিই সরকার’’, তখন তা শুনে সাধারণ মানুষ অবাক হয় । সম্প্রতি কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গেও রাজ্যপাল ও রাজ্য সরকারের মধ্যে বিভিন্ন ইশুতে সংঘাত বারবার সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছে । এমন ঘটনা সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে মোটেই সুখকর নয়, বরং এই ঘটনাগুলি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় একাধিক ফাটল তৈরি করতে পারে ।
যেমন, ধরা যাক কেরালার রাজ্যপাল অরিফ মহম্মদ খানের কথা । নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (২০১৯) – এর সমর্থনে তিনি সম্প্রতি যে বক্তব্য রেখেছেন, তাতে বিভিন্ন মহলের একাংশের এমন ধারণা হয়েছে যে, কেন্দ্রের তরফে পাশ করা আইনটি সমর্থনের দায়িত্ব বুঝি তিনি নিজেই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন । CAA-র সমর্থনে আরিফ মহম্মদ খানের বক্তব্য তাই যথেষ্ট আশ্চর্যজনক । আরিফ মহম্মদ খান স্পষ্টই জানিয়েছেন যে, তিনি (রাজ্য সরকারের) সিলমোহর নন । কেরালার লেফ্ট ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট সরকার CAA-র বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে । সেই বিষয়ে কেরালা সরকারের কাছ থেকে রিপোর্ট চেয়েছেন রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খান । এই বিষয়টি নিয়ে তাই এখন কেরালার রাজনৈতিক পরিস্থিতি যথেষ্ট উত্তপ্ত ।
অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় এখন সেই রাজ্যে একাধিক বিতর্ক ও সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু । তিনি বিভিন্ন ইশুতে প্রকাশ্যেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের সমালোচনা করছেন । সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পড়েন রাজ্যপাল । ‘BJP ওয়ার্কার ধনকর, গো ব্যাক’ প্ল্যাকার্ড হাতে সেখানে বিক্ষোভ দেখানো হয় । সাংবিধানিক দায়িত্ব ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে রাজ্যপালের ক্ষমতা খুবই সীমিত ও নগণ্য । রাজ্যে সাংবিধানিক সংকট দেখা দিলে তবেই রাজ্যপাল সক্রিয় হন এবং নিজের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করেন । কিন্তু অভিযোগ উঠেছে যে, কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালরা তাঁদের সাম্প্রতিক কাজকর্মে সেই সাংবিধানিক গণ্ডি লঙ্ঘন করেছেন ।
‘‘নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য রাজনৈতিক নেতারা আরও বেশি ক্ষমতা চায় । কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রের যে শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা রয়েছেন, তাঁরা সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করেন ।’’ রাজভবনে রাজ্যপাল পদে কাদের নিয়োগ করা হবে সেই বিষয়ে সংবিধান অধিবেশনে পণ্ডিত নেহরু এই কথা বলেছিলেন । সেই সময় আদর্শ যতই মহান হোক না কেন, পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রের শাসনে, বিশেষ করে কংগ্রেসের সরকার যখন কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল, তখন রাজ্যপাল, যিনি সংশ্লিষ্ট রাজ্যের প্রথম নাগরিক, তাঁর পদের গুরুত্ব নীতিহীন রাজনীতির জন্য অনেকটাই খর্ব হয়েছে । বিহারের বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার জন্য এবং সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার ভূমিকায় ক্ষুব্ধ হয়ে সুপ্রিম কোর্ট একবার বুটা সিংকে তীব্র তিরস্কার করেছিল । তবে একথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে, আমাদের দেশের ইতিহাসে রাজ্যপালের পদটিকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব অলঙ্কৃত করেছেন । তাঁরা সুষ্ঠুভাবে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করে সেই পদের গরিমা বৃদ্ধি করেছেন । এক্ষেত্রে জাকির হোসেন, সরোজিনী নায়ডু, সুরজিত সিং বার্নালা প্রমুখের নাম নেওয়া যেতে পারে । তাঁরা রাজ্যপালের পদে থাকাকালীন উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন । কিন্তু তাঁদের সংখ্যা নগণ্য । সেই তুলনায় যে সমস্ত বিতর্কিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রাজ্যপালের পদে বিভিন্ন সময় আসীন হয়েছেন তাঁদের সংখ্যা অনেক বেশি । এক্ষেত্রে রাম লাল, শিবতে রাজ়ি, রমেশ ভান্ডারি, সুন্দর সিং ভান্ডারি প্রমুখের নাম নেওয়া যেতে পারে । রাজ্যপালকে দিয়ে বকলমে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কাজ করিয়ে নেওয়া এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের দিয়ে কার্যত রাজ্যপালের ভূমিকা পালন করানোর ক্ষেত্রে ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স (UPA) সরকার সিদ্ধহস্ত ছিল বলে রাজনৈতিক মহলের একাংশের দাবি । তবে পিছিয়ে নেই ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (NDA) সরকারও । রাজভবনের মাধ্যমে BJP ক্ষমতায় নেই এমন রাজ্যগুলিতে সরকারকে সমস্যায় ফেলতে NDA সরকারও বিশেষ ‘প্রতিভাধর’ বলে দাবি ওয়াকিবহাল মহলের একাংশের । এর অন্যতম উদাহরণ হল কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন ইশুতে রাজ্যপাল ও রাজ্য সরকারের সাম্প্রতিক সংঘাত । কেরালার রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খান স্থানীয় সংস্থাগুলিতে সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য রাজ্য সরকারের আনা অধ্যাদেশ স্থগিত করে দিয়েছিলেন । রাজ্যপালকে না জানিয়ে কেরালা সরকার নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (২০১৯) সংক্রান্ত বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে কেন চিঠি লিখেছে, সেই বিষয়ে আরিফ মহম্মদ খান প্রশ্ন তুলেছেন ।