পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / bharat

কূটনীতিক নিয়োগে নজর চিনের সম্প্রসারণবাদ-তালিবান সমস্যা

পাশের দেশ চিন-বাংলাদেশ । তালিকায় রয়েছে পাকিস্তান-আফগানিস্তান-শ্রীলঙ্কার মতো দেশও । কূটনৈতিক ভাবে প্রতিটি দেশের সঙ্গেই দিল্লির আলাদা-আলাদা সম্পর্ক । স্বাভাবিক ভাবেই সংশ্লিষ্ট দেশে কূটনীতিক নিয়োগের ক্ষেত্রটিও গুরুত্বপূর্ণ । বেশ কয়েকটি দেশে নিয়োগ করা হচ্ছে নয়া কূটনীতিক । এক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলি গুরুত্ব পাচ্ছে ? আলোচনায় অরুণিম ভুইয়াঁ ৷

By

Published : Jul 25, 2020, 6:35 AM IST

Countering China’s
Countering China’s

দিল্লি, 25 জুলাই : এই মাসে ভারতের তরফে তিনটি নতুন কূটনৈতিক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ৷ এই অঞ্চলে ও পূর্বদিকের প্রতিবেশীদের মধ্যে চিনের সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে কৌশলগত মোকাবিলা করার জন্য এবং আফগানিস্তানে তালিবানের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে দিল্লি পরিকল্পনা করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে ৷ বিদেশমন্ত্রকের (MEA) অতিরিক্ত সচিব (আন্তর্জাতিক সংস্থা ও শীর্ষ সম্মেলন) বিক্রম দোরাইস্বামীকে বাংলাদেশে ভারতের হাই কমিশনার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে ৷ রুদ্রেন্দ্র ট্যান্ডনকে আফগানিস্তানের নতুন রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে ৷ তিনি জাকার্তায় অ্যাসোসিয়েশন অফ সাউথ ইস্ট এশিয়ান নেশনস (ASEAN)-এ ভারতের রাষ্ট্রদূত হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন ৷ MEA-তে যুগ্ম সচিব (আমেরিকা) পদে কাজ করছিলেন গৌরাঙ্গালাল দাস ৷ তাঁকে তাইওয়ানে ভারত-তাইপেই অ্যাসোসিয়েশনের ডিরেক্টর জেনারেল হিসেবে পাঠানো হচ্ছে ৷ লাদাখে চিনের সঙ্গে যে রক্তক্ষয়ী লড়াই হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ চিন সাগর ও পূর্ব চিন সাগরে বেজিংয়ের আধিপত্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং আফগানিস্তানের শান্তি প্রক্রিয়ায় তালিবানদের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ার পর ভারতের তরফে করা এই তিনটি নতুন পদক্ষেপ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে ৷ দোরাইস্বামী ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিস (IFS)-এর 1999 ব্যাচের আধিকারিক ৷ তিনি এমন একটা সময় বাংলাদেশে যাচ্ছেন, যখন দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি করার জন্য বেজিং ঢাকাকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে ৷

পূর্বদিকে অবস্থিত ভারতের এই প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিরক্ষা প্রকল্পে চিন গতি বৃদ্ধি করছে ৷ এর মধ্যে রয়েছে কক্সবাজারের পেকুয়ায় বিএনএস শেখ হাসিনা সাবমেরিন বেসের উন্নতি ঘটানো এবং বাংলাদেশের নৌবাহিনীতে দুইটি সাবমেরিন সরবরাহ করা ৷ নয়াদিল্লির জন্য আরও একটা উদ্বেগের বিষয় হল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিসিয়েটিভ (BRI)-কে মেনে নিয়েছেন ৷ ভারতের তরফে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প BRI-তে অংশীদার হওয়ার প্রস্তাব খারিজ করে দেওয়া হয়েছে ৷ তার কারণ চিন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (CPEC) পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর (PoK) দিয়ে যাচ্ছে ৷ শি-এর BRI আসলে ছোট ছোট দেশগুলিকে ঋণের ফাঁদে ফেলার চক্রান্ত ৷ এমনই অভিযোগ তুলে বিশ্বের বিভিন্ন শক্তির তরফে সমালোচনা করা হচ্ছে ৷ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খুবই গভীর ৷ তা সত্ত্বেও ঢাকা বঙ্গোপসাগরে চিনের সামুদ্রিক পরিকল্পনায় সাহায্য করার বিষয় সহমত হয়েছে ৷ ভারতের জন্য আরও একটা উদ্বেগের কারণ হল বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা গবেষণা সংস্থা চিনের সিনোভ্যাক বায়োটেক লিমিটেডের তৈরি করা Covid19 ভ্যাকসিনের তৃতীয় দফার ট্রায়ালের অনুমতি দিয়েছে ৷

গত বছর অক্টোবর মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে এসেছিলেন ৷ সেই সময় নয়াদিল্লি ও ঢাকার মধ্যে সাতটি চুক্তি ও তিনটি প্রকল্প চূড়ান্ত হয় ৷ তার পরও এই ঘটনা ঘটেছে ৷ চুক্তিগুলির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এবং মংলা বন্দরগুলি থেকে ভারত থেকে যাওয়া ও ভারতে আসার ব্যবস্থা করা ৷ বিশেষ করে উত্তর পূর্ব ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা ৷ ভারতের ত্রিপুরা সোনামুরার সঙ্গে বাংলাদেশের দাউদকান্তির মধ্যে একটি জল বাণিজ্য পথকে সক্রিয় রাখা ৷ আর ঢাকাকে দিল্লি আট বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দেওয়ার পথ প্রশস্ত রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া ৷ উভয় দেশ জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ এবং বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধি করার জন্য রেল ও অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থার সংযোগ পুনরুদ্ধার করার কাজ করছে । তিনটি প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণ তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস (LPG) আমদানি করা, ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনে একটি বিবেকানন্দ ভবন (ছাত্রাবাস) এবং বাংলাদেশের খুলনায় অবস্থিত ইনস্টিটিউট অফ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়র্স বাংলাদেশ (IDEB)-এ বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া প্রফেশনাল স্কিল ডেভলপমেন্ট ইনস্টিটিউট (BIPSDI) তৈরি করা ৷

এই পরিস্থিতিতে দোরাইস্বামীকে বাংলাদেশে দূত হিসেবে নিয়োগ বেজিংয়ের প্রচেষ্টা থেকে ঢাকাকে বাঁচানোর জন্য কৌশলগত পদক্ষেপ বলেই মনে করা হচ্ছে ৷ দোরাইস্বামী ম্যান্ডারিন এবং ফরাসি ভাষায় কথা বলতে দক্ষ ৷ তিনি দিল্লির সদর দপ্তরে MEA-এর যুগ্ম সচিব (আমেরিকা) পদে কাজ করেছেন ৷ আর ইন্দো-প্যাসিফিকের প্রধানও ছিলেন ৷ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল, যা জাপানের পূর্ব উপকূল থেকে শুরু হয়ে আফ্রিকার পূর্ব উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত ৷ এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে চিন ৷ তাই এই অঞ্চলে শাস্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার চতুর্দেশীয় জোট রয়েছে ৷

1999 ব্যাচের IFS অফিসার দাসকে ভারতের তরফে তাইওয়ানে দূত হিসেবে পাঠানোও এই পরিস্থিতিতে দিল্লির কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবেই দেখা হচ্ছে ৷ দক্ষিণ চিন সাগরে চিন ক্রমশ গোলমাল বৃদ্ধি করছে ৷ একাধিক দেশের সঙ্গে ঝামেলায় জড়াচ্ছে ৷ পূর্ব চিন সাগরে জাপানের সীমান্তে অবস্থিত সেনকাকু দ্বীপের জলসীমায় ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং সাম্প্রতিক কালে বারবার ফাইটার জেট নিয়ে তাইওয়ানের আকাশসীমায় ঢুকে পড়ছে৷ ঠিক এই সময়ই এই নিয়োগ হল ৷ বুধবার তাইওয়ানের বিদেশমন্ত্রী জোসেফ উ বলেন, চিন যেভাবে সাম্প্রতিক মাসগুলিতে নৌবাহিনীর মহড়া দিয়েছে এবং আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে, তাতে মনে হচ্ছে তারা এই পূর্ব এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্রটিকে দখল করতে সেনা প্রস্তুত করছে ৷ "ওয়ান চায়না পলিসি"-এর অধীনে ভারত ও তাইওয়ানের মধ্যে কোনও সরকারি কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই ৷ কিন্তু ইন্ডিয়া-তাইপেই অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে নয়াদিল্লি তাইপেইতে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব বজায় রেখে ৷ ওই অ্যাসোসিয়েশনের ডিরেক্টর জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত হলেন দাস ৷ একই ভাবে ওই দ্বীপরাষ্ট্র তাইওয়ান ইকোনমিক অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারের মাধ্যমে দিল্লিতে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব বজায় রেখেছে ৷ তাইওয়ান, তাদের প্রেসিডেন্ট সাই ইন-ওয়েনের অধীনে একটি নতুন দক্ষিণমুখী নীতি গ্রহণ করেছে ৷ যেখানে ভারত-সহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া এবং অস্ট্রেলেশিয়ার 18 দেশের সঙ্গে সহযোগিতা ও আদানপ্রদান বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ৷

দাস, যিনি খুব ভালো ম্যান্ডারিন বলতে পারেনি ৷ তিনি দুই দফায় বেজিংয়ের দূতাবাসে কাজ করেছেন ৷ মনমোহন সিংয়ের সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী দপ্তরে সহকারি সচিবের পদেও কাজ করেছেন ৷ আর তিনি ওয়াশিংটনে ভারতীয় দূতাবাসে কাউন্সিলর হিসেবেও কর্মরত ছিলেন ৷ অন্যদিকে ট্যান্ডনের নাম আফগানিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে আসায় এর মধ্যেও গুরুত্ব রয়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা দেখতে পাচ্ছেন ৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শান্তি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশ থেকে সেনা সরিয়ে নিতে যাচ্ছে ৷ এই পরিস্থিতি ক্ষমতার কেন্দ্রে ক্রমশ আফগান তালিবানরা চলে আসছে ৷ এই অবস্থাতেই এই নিয়োগ হল ৷ কিছু খবর অনুযায়ী, তালিবানের সর্বোচ্চ নেতা হিবাতুল্লা আখুন্দজাদা কোভিড ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৷ সম্ভবত তিনি মারা গিয়েছেন ৷ পাকিস্তান সমর্থিত হাক্কানি নেটওয়ার্ক এবং তালিবানের সহকারি নেতা সিরাজ্জুদ্দিন হাক্কানিও এই ভাইরাসের জেরে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ৷ এর জেরে অন্য একজন সহকারি নেতা মহমম্দ ইয়াকুব সংগঠন চালানোর দায়িত্ব পেয়েছেন ৷ এটা বিশ্বাস করা হয় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে ইয়াকুব ৷ আর ভারতের সঙ্গে পুনর্মিলনের পক্ষে রয়েছেন তিনি ৷ শান্তি প্রক্রিয়ায় তালিবানদের সঙ্গে জড়িয়ে না পড়াই ভারতের সরকারি নীতি ৷ দিল্লির অবস্থান হল, আফগান শান্তি প্রক্রিয়া ‘আফগানের নেতৃত্বে, আফগানের দ্বারা এবং আফগানের নিয়ন্ত্রণে’ হওয়া উচিত ৷

যদিও ভারত আঞ্চিলক ক্ষেত্রে আফগানিস্তানের সবচেয়ে বড় সাহায্যকারী ৷ তা সত্ত্বেও দিল্লি বহুপাক্ষিক শান্তি আলোচনা থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখেছিল ৷ যে আলোচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে ৷ একই সময়ে ওয়াশিংটন এই শান্তি প্রক্রিয়ায় ভারতের সমর্থন চেয়েছে ৷ আফগানিস্তান পুনর্গঠনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত জালমি খলিলজাদ নিয়মিত দিল্লির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন ৷ যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশের জন্য ভারতের তরফে রাষ্ট্রদূতের নাম ঘোষণা করা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ৷ ট্যান্ডন কাবুলে ভারতীয় দূতাবাসে কাজ করেছেন ৷ আর তিনি জালালাবাদের কাউন্সেল জেনারেল ছিলেন ৷ MEA-তে তাঁকে আফগান বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে দেখা হয় ৷ তিনি পাকিস্তান-আফগানিস্তান-ইরান ডেস্কের জয়েন্ট সেক্রেটারি ছিলেন ৷

ABOUT THE AUTHOR

...view details