আজ, ভারতের জন্য একটা অস্বাভাবিক স্বাধীনতা দিবস ৷ কোরোনা ভাইরাস এখনও দেশের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে ৷ একই ভাবে বাকি বিশ্বেও এই প্যানডেমিক জীবন ও জীবনযাত্রার উপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলছে ৷ দুইটি কারণে অর্থনৈতিক আঘাত ভারতে অনেকটাই বেশি ৷ প্রথমত, Covid-19-র পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগে থেকেই ভারতের অর্থনীতির গতি কমতে শুরু করেছিল ৷ এটা 2017-18 অর্থবর্ষের Q4-এ ছিল 8.1 শতাংশ ৷ আর 2019-20 অর্থবর্ষের Q4-এ তা নেমে দাঁড়ায় 3.1 শতাংশে ৷ এর সঙ্গে ছিল বেকারত্ব, কম রোজগার, গ্রামীণ যন্ত্রণা এবং বহু বিস্তৃত অসাম্যের সমস্যা ৷ দ্বিতীয়ত, ভারতের বড় অসংগঠিত ক্ষেত্র বিশেষ ভাবে দুর্বল ৷
প্যানডেমিকের জন্য শ্রমিকদের বাজারে একটা নজিরবিহীন সংকট নেমে এসেছিল ৷ লকডাউনের জন্য কার্যত সমস্ত অর্থনৈতিক কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ৷ তবে যাঁরা পিরামিডের একেবারে নিচের স্তরে ছিলেন, বিশেষ করে পরিযায়ী শ্রমিকরা, তাঁরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৷ প্যানডেমিকের জন্য অসংগঠিত ক্ষেত্রের একটা বড় অংশের মানুষ কাজ হারিয়েছেন এবং রোজগারহীন হয়ে পড়েছেন ৷ বেকারত্ব চলতি বছরের মার্চে ছিল 8.4 শতাংশ ৷ সেখান থেকে 2020 সালের এপ্রিল-মে মাসে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে 27 শতাংশ ৷ 122 মিলিয়ন লোক চাকরি খুইয়েছেন ৷ এর মধ্যে ছোটো ব্যবসায়ী ও চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করা শ্রমিকরা (যাঁরা দৈনিক মজুরি পান) রয়েছেন, যাঁদের 91 মিলিয়ন কর্মহীন হয়েছেন ৷
জুন মাস থেকে আনলকডাউন করার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর কিছুটা হলেও দেশের অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে ৷ কিন্তু ভারতের কিছু অংশ এখনও লকডাউনের আওতার মধ্যে রয়েছে ৷ এই প্যানডেমিক কতদিন স্থায়ী হবে এবং এটা কতটা ছড়িয়ে পড়বে, তা এখনও নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না ৷ গ্রামীণ অর্থনীতির কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ ৷ কারণ, মোট জনসংখ্যা ও কর্মী সংখ্যার 70 শতাংশই গ্রামে থাকেন ৷ তাঁদের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়া খুবই জরুরি ৷ কারণ, তাহলেই পুরো অর্থনীতির পণ্য ও পরিষেবার চাহিদা বৃদ্ধি পাবে ৷
Covid-19-র খারাপ প্রভাব শহরে এলাকায় যতটা পড়েছে, গ্রামীণ এলাকায় তা অনেকটাই কম ৷ লকডাউনের পর গ্রামীণ অর্থনীতি ক্রমশ ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলেও তথ্য পাওয়া যাচ্ছে ৷ এখন ভারতীয় অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে শুধুমাত্র কৃষিক্ষেত্রের কাজ ৷ FY 21-এ কৃষিজ GDP 2.5 থেকে 3 শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে ৷ সেখানে সামগ্রিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে GDP 5 থেকে 8 শতাংশ কমে যেত পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে ৷ এই বছর স্বাভাবিক বর্ষা হওয়ায় ভারতে খরিফ ও রবিশস্যের ফলন দারুণ হবে ৷ যদিও দারুণ ফলন কৃষিক্ষেত্রে দাম কমিয়ে দিতে পারে ৷ কৃষকরা যাতে আরও বেশি দাম পান, তার জন্য সরবরাহের ব্যবস্থা সংক্রান্ত সমস্যাগুলি দ্রুত মিটিয়ে ফেলতে হবে ৷
গ্রামীণ এলাকার একমাত্র অংশ হল কৃষিক্ষেত্র ৷ কৃষিজ নয়, এমন ক্ষেত্রগুলি বছরের পর বছর ধরে বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ গ্রামীণ এলাকায় FMCG, ট্র্যাক্টর, দুই চাকার গাড়ির চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ যদি গ্রামীণ এলাকার এই ভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর বিষয়টি লকডাউনের পরই আচমকা গতি পেয়েছে ৷ কম টাকা, কম গ্রামীণ মজুরি ও রোজগারের জেরে এই চাহিদা বেশি দিন স্থায়ী নাও হতে পারে ৷
40 থেকে 50 মিলিয়ন পরিযায়ী শ্রমিক উলটো পথে ঘরের ফেরার মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকায় ফিরে এসেছেন ৷ এই পরিযায়ী শ্রমিক ও অন্যান্য গ্রামীণ কর্মীদের অবশ্যই কাজ দিতে হবে ৷ সরকারি কাজকে কর্মীদের সুরক্ষা-জাল হিসেবে ব্যবহার করতে হবে ৷ ভারতে সেই চতুর্দশ শতক BC-তে যখন কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্র লিখেছিলেন, তখন থেকেই মানুষকে সুরাহা দেওয়ার কাজের উপর জোর দেওয়া হয়েছে৷ মহাত্মা গান্ধি জাতীয় কর্মসংস্থান সুনিশ্চিতকরণ যোজনা (MGNREGA)-এর মাধ্যমে Covid 19-এর সময়কালে এই কর্মীদের জন্য রক্ষাকবচ হয়ে উঠতে পারে ৷ NREGA-এর দ্বিতীয় একটি সুবিধা রয়েছে ৷ এর মধ্যে রয়েছে কৃষিজ সম্পদ তৈরি ও গ্রামীণ উন্নয়ন, মহিলাদের আরও অংশগ্রহণ, প্রান্তিক অংশকে সাহায্য করা, পরিযায়ী হওয়া থেকে এলাকার মানুষকে ঠেকানো, পঞ্চায়েতকে অন্তর্ভুক্ত করা ইত্যাদি৷ ইন্দিরা গান্ধি ইনস্টিটিউট অফ ডেভলপমেন্ট রিসার্চের (IGIDR) তরফে একটি সমীক্ষা করা হয়৷ তাতে দেখা গিয়েছে যে মহারাষ্ট্রে যতটা কাজ হয়েছে, তার 87 শতাংশ ক্ষেত্রে সম্পদ তৈরি হয়েছে৷ আর NREGA-এর মাধ্যমে মোট কাজের 75 শতাংশ ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে কৃষি সংক্রান্ত ক্ষেত্রে সুবিধা হয়েছে ৷ যাঁদের প্রতিক্রিয়া নেওয়া হয়, তাঁদের মধ্যে 90 শতাংশই জানিয়েছেন যে এই প্রকল্পে কার্যকরী কাজ হয়েছে ৷
গত কয়েকমাসে লকডাউন ও কাজ চলে যাওয়ার কারণে MGNREGA প্রকল্পে কাজ করার চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ এপ্রিল থেকে অগাস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত প্রায় 170 টি কর্মদিবস সৃষ্টি করা গিয়েছে ৷ এর সঙ্গে 2019-20 আর্থিক বছরের তুলনা করলে দেখা যাবে যে সব মিলিয়ে 265টি কর্মদিবস তৈরি করা গিয়েছিল ৷ অন্যভাবেও এটাকে ব্যাখ্যা করা যায় ৷ আর তা হল, চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে চলতি বছরের এই কয়েক মাসেই গত বছরের মোট কর্মদিবসের মধ্যে 64 শতাংশ তৈরি করা হয়ে গিয়েছে ৷ তেলাঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশে 2019-20 আর্থিক বছরে 365 দিনের কর্মদিবস তৈরি করা হয়েছিল ৷ সেই তুলনায় ওই দুই রাজ্যে এবার যথাক্রমে 106 শতাংশ ও 96 শতাংশ কর্মদিবস তৈরি হয়েছে ৷ NGREA-এর এই অগ্রগতি প্রমাণ করছে যে কাজের সুযোগের অভাবেই গ্রামের বাসিন্দারা এই কাজ আরও অনেক বেশি করার চেষ্টা করছে৷ এখনও পর্যন্ত এই যোজনার অধীনে 4.8 লাখ পরিবার তাঁদের 100 দিনের কাজ শেষ করে ফেলেছে ৷ FY21-এ MGNREGA প্রকল্পে বরাদ্দ করা হয়েছে মোট ১ লাখ কোটি টাকা ৷ এর মধ্যে এখনও পর্যন্ত খরচ হয়ে গিয়েছে 48 হাজার কোটি টাকা ৷
কিন্তু MGNREGA প্রকল্প নিয়ে কিছু সমস্যাও রয়েছে ৷ সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে রিপোর্ট দেওয়ার সময় গ্রামীণ উন্নয়ন মন্ত্রকের একজন আধিকারিক বলেন যে চলতি আর্থিক বছরে আমাদের কাছে NREGA প্রকল্পে খুব কম টাকাই পড়ে রয়েছে ৷ এই নিয়ে আজিম প্রেমজি ফাউন্ডেশনের তরফে একটি সমীক্ষা করা হয় ৷ তাতে দেখা গিয়েছে যে দেশের বড় অংশের গ্রাম পঞ্চায়েতে NREGA প্রকল্পের পুরো টাকা ইতিমধ্যেই খরচ করা হয়ে গিয়েছে ৷ পঞ্চায়েতগুলি 2020 সালের অগাস্টের মধ্যেই সমস্ত প্রকল্পের কাজ শেষ করে দেবে ৷ ওই ফাউন্ডেশনের সমীক্ষায় উঠে এসেছে যে MGNREGA প্রকল্পের চাহিদা FY21-এর শেষ পর্যন্ত অনেক থাকবে ৷ তবে খরিফ শস্যের মরসুমে তা কিছুটা হলেও কমতে পারে৷ তাদের তরফে এই প্রকল্পের বরাদ্দ ১ লাখ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি করে 2 লাখ কোটি টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ৷ একই সঙ্গে এও প্রস্তাব করা হয়েছে যে যাতে কর্মদিবসের সংখ্যা পরিবার পিছু বৃদ্ধি করে 200 দিন করা হয় ৷