দিল্লি, ২০ জানুয়ারি: ন্যাশনাল ক্রাইম রিসার্চ বিউরোর (NCRB) রিপোর্ট সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে । কিন্তু তাতে গত কয়েক বছর ধরে দেশে ঘটে চলা বিভিন্ন ভয়াবহ অপরাধের ঘটনা স্থান পায়নি । এক্ষেত্রে কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলটির আদর্শ ঠিক করে দিয়েছে ন্যাশনাল ক্রাইম রিসার্চ বিউরোর রিপোর্টে কোন অপরাধমূলক ঘটনাগুলি স্থান পাবে এবং কোন ধরনের অপরাধকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে ।
২০১৮ সালে দেশের বিভিন্ন জায়গায় নানা অপরাধমূলক ঘটনার প্রেক্ষিতে ন্যাশনাল ক্রাইম রিসার্চ বিউরোর তরফে ‘ক্রাইম ইন ইন্ডিয়া’ শীর্ষক রিপোর্টটি চলতি বছর প্রকাশ করা হয়েছে । এক্ষেত্রে ২০১৮ সালে দেশে বিভিন্ন ধরনের যে ‘হেট ক্রাইম’ বা বিদ্বেষমূলক অপরাধের ঘটনা ঘটেছে, সেগুলির কথা রিপোর্টে উল্লেখ করা উচিত ছিল । বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে গোমাংসের ব্যবসা বা গো-হত্যার অভিযোগ তুলে যে সমস্ত অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সেগুলির অবশ্যই উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল । এই সমস্ত বিদ্বেষমূলক অপরাধের পেছনে জনপ্রিয় মেসেজিং সার্ভিস হোয়াটসঅ্যাপের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে । কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে এই ধরনের বিদ্বেষ ছড়ানো হয় । উত্তর ভারতের বিভিন্ন গ্রামে গো-হত্যা নিষিদ্ধকরণের জেরে যে উত্তেজনা ও হিংসা ছড়ায় সেই বিষয়েও ন্যাশনাল ক্রাইম রিসার্চ বিউরোর রিপোর্ট নীরব । মালিকানাহীন গবাদি পশু - যেগুলিকে আগে কশাইখানায় পাঠানো হত - সেগুলি এখন গ্রামীণ এলাকায় লোকের বাড়িতে বা খেতে ঢুকে পড়ে নানা সমস্যা তৈরি করছে । কিন্তু ধর্মীয় নজরদারি ও আইনের জেরে সাধারণ মানুষ এই সমস্ত অকাজের গবাদিপশুর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিতে পারছে না । আর তার জেরে উত্তর ভারতের কৃষিপ্রধান অঞ্চলে সমস্যা বাড়ছে ।
ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীদের মধ্যে এর জেরে যে সংঘর্ষের ঘটনাগুলি ঘটেছে, সেগুলিকে ন্যাশনাল ক্রাইম রিসার্চ বিউরোর রিপোর্টে ‘গ্রামীণ দাঙ্গা’-র শ্রেণিতে রাখা উচিত ছিল । কিন্তু যারা রিপোর্ট তৈরি করেছেন, তাঁরা তা সেটা করেননি । তার বদলে রিপোর্ট প্রস্তুতকারীরা একটি নতুন সাব ক্যাটেগরি বা উপ-শ্রেণি তৈরি করেছেন, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘কৃষি-সংঘর্ষ’ (agrarian riots) । এই ‘কৃষি-সংঘর্ষ’-র ঘটনা ২০১৪ থেকে ২০১৫ সাল - এই এক বছরের মধ্যে প্রায় ৩২৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে । ২০১৪ সালে সারা দেশে এই ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল ৬২৮টি । কিন্তু এক বছরের মধ্যেই অর্থাৎ ২০১৫ সালে তা বেড়ে হয় ২৬৮৩ । মাত্র এক বছরের মধ্যে গ্রামীণ এলাকায় এই ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা এতটা বেড়ে গেল কী করে ? ওয়াকিবহাল মহল বলছে, জমির মালিকানা নিয়ে বিবাদ ও ১০০ দিনের কাজ প্রকল্প ঠিকমতো বাস্তবায়িত না হওয়ার জেরেই এই ধরনের ঘটনা বেড়েছে । পরবর্তীতে ন্যাশনাল ক্রাইম রিসার্চ বিউরোর রিপোর্ট থেকে ‘কৃষি সংঘর্ষ’-র ক্যাটেগরিকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয় । যখন রিপোর্ট থেকে কোনও ক্যাটেগরিকে বাদ দেওয়া হয়, তখন কারণ হিসেবে সাধারণত বলা হয় যে, ওই ক্যাটেগরিতে ফেলা যায় এমন ধরনের ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে না ঘটায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে । কিন্তু দেশের অনেক জায়গাতেই বিভিন্ন ইশুতে কৃষক অসন্তোষ ক্রমশ বাড়ছে আর তার জেরে গ্রামীণ এলাকায় এমন সংঘর্ষের ঘটনাও বেড়ে চলেছে । এই পরিস্থিতিতে রিপোর্ট থেকে ওই নির্দিষ্ট ক্যাটেগরিকে কেন বাদ দেওয়া হল, তা বোধগম্য নয় ।
আমাদের দেশে কৃষি একটি উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্র । তাই দেশে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনাগুলি নিয়ে সরকার যথেষ্ট বিব্রত । এই ধরনের ঘটনা বেড়েছে ১৯৯১ সালে দেশে ‘উদার অর্থনীতি’-র সূচনা এবং সরকারি নীতিতে ‘ক্যাশ কালটিভেশন’-এ জোর দেওয়ার পর থেকে । ‘ক্যাশ কালটিভেশন’ অর্থাৎ মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে চাষ করা এবং চাষের লাভ্যাংশ থেকে মহাজনকে সেই ঋণ সুদে আসলে শোধ করা । কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে যে, গ্রামের মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে চাষি ঋণ নিয়ে চাষ করার পরেও বাজারে ফসলের সঠিক দাম পাচ্ছে না আর তার জেরে ঋণ শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে । তা ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে অনাবৃষ্টি, সেচের অভাব ও পোকার উপদ্রবেও ক্ষতির মুখে পড়ে চাষি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয় । তবে ২০১৮ সালের রিপোর্ট বলছে দেশে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা সাম্প্রতিক অতীতে অন্যান্য বছরগুলির তুলনায় কিছুটা কম । কিন্তু অন্যদিকে, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে দেশে বেকারদের আত্মহত্যার সংখ্যা একলাফে বেড়ে হয়েছে ১২,৯৩৬ । কোনও সরকারের কাছেই এই সংখ্যাটা অভিপ্রেত নয়, কিন্তু যদি এই তথ্যটা আমরা মাথায় রাখি যে, স্বাধীনতার পর গত ৪২ বছরের মধ্যে দেশে বেকারের সংখ্যা চলতি অর্থবর্ষে রেকর্ড ছুঁয়েছে, তাহলে আত্মহত্যার এই সংখ্যাটা আমাদের কাছে অস্বাভাবিক মনে না-ও হতে পারে । এখন দেখার এই তথ্য ন্যাশনাল ক্রাইম রিসার্চ বিউরোর আগামী রিপোর্টে কীভাবে পেশ করা হবে ।
ন্যাশনাল ক্রাইম রিসার্চ বিউরোর রিপোর্টে আর একটি উল্লেখযোগ্য পরিসংখ্যান হল দেশে ঘটে চলা মহিলাদের উপর বিভিন্ন অপরাধ । ২০১৮ সালের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে রিপোর্ট বলছে, আমাদের দেশে গড়ে প্রতি ১৫ মিনিটে একজন করে মহিলা ধর্ষিত হয়েছেন এবং ৯৪ শতাংশ ক্ষেত্রেই দুষ্কৃতী বা দুষ্কৃতীরা নির্যাতিতার পূর্ব পরিচিত ছিল । ওই বছরে দেশের বিভিন্ন থানায় মোট ৩৩,৩৫৬টি ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হয়েছে । তবে ওয়াকিবহাল মহলের দাবি, বাস্তবে সংখ্যাটি আরও বেশি । যেহেতু অনেক মহিলাই ধর্ষিত হলেও লোকলজ্জায় পুলিশে অভিযোগ দায়ের করতে চান না, তাই ন্যাশনাল ক্রাইম রিসার্চ বিউরোর রিপোর্টের ওই পরিসংখ্যান আদতে হিমশৈলের চূড়া মাত্র ।