পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / bharat

ভারতের পরিযায়ী শ্রমিকরা অবহেলার শিকার, প্রকাশ্যে এনেছে লকডাউন - National Institute of Advanced Studies

লকডাউনে সবচেয়ে বড় সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন ভারতের পরিযায়ী শ্রমিকরা । তাঁদের অনেকের চাকরি গিয়েছে । অনেকের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মৃত্যু হয়েছে । তাঁদের দুর্দশা এবং এই বৈষম্যের কারণ নিয়ে লিখছেন ড. অংশুমান বেহরা । তিনি বেঙ্গালুরুর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডিজ়ের (NIAS) অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ।

migrants
migrants

By

Published : Jun 5, 2020, 9:59 PM IST

ভারতে Covid-19 সংকটে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন পরিযায়ী শ্রমিকরা ৷ এই নিয়ে অবশ্য বিতর্ক থাকতে পারে ৷ তবে তাঁদের নিজেদের বাড়ি ফিরে আসার দৃশ্যটা খুবই যন্ত্রণাদায়ক ৷ যেভাবে বিপুল সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিকরা দলে দলে শহর ছেড়ে বাড়ির পথ ধরেছিলেন, তাতে সামনে চলে এসেছে তাঁদের সম্পর্কে গত কয়েক দশকে তৈরি হওয়া সামাজিক-রাজনৈতিক উদাসীনতা ৷ সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি যে সহানুভূতির বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার মাধ্যমে স্পেশাল ট্রেন চালিয়ে যেভাবে তাঁদের বাড়ি ফেরানোর ব্যবস্থা হয়েছে, তাতে পরিযায়ী শ্রমিকরা গত কয়েক দশক ধরে কীভাবে অবহেলার শিকার হচ্ছিলেন, সেটাই প্রকাশ্যে চলে এসেছে ৷ নিম্নলিখিত বিভাগগুলির মাধ্যমে তিনটি প্রধান বৈষম্য তুলে ধরা হয়েছে, যা অভিবাসী শ্রমিকদের দুর্দশার জন্য দায়ি ৷

যে বড় বৈষম্যের সঙ্গে পরিযায়ী শ্রমিকদের লড়াই করতে হয়, তা হল বিচ্ছিন্নতার একটি নতুন রূপ এবং বাস্তবিক বঞ্চনা ৷ কারখানার মালিক এবং শ্রমিকের মধ্যে এক বৈপরীত্য সম্পর্ক তৈরির ঐতিহ্য রয়েছে ৷ উদারপন্থী বাজার অর্থনীতিতে পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে মূলধন বিনিয়োগকারীর সম্পর্ক একেবারে নেই বললেই চলে ৷ মালিকের সঙ্গে এই শ্রমিকদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করেন শ্রম-ঠিকাদার ৷ তাঁরাই এই শ্রমিকদের দুর্বল করে তোলেন এবং তাঁদের উপর ভরসা করতে বাধ্য করেন ৷ একেবারে নিচের স্তরে যে সমস্ত শ্রমিকরা থাকেন, তাঁরা সাধারণত একটা বড় অংশের হন ৷ তাঁরা মূলত ঠিকাদারের দয়ার উপর বেঁচে থাকেন ৷ তাঁরা নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে অবগত নন ৷ তাঁরা জানেনই না তাঁরা যে ক্ষেত্রে কাজ করেন, তা অসংগঠিত ৷ একজন অসংগঠিত শ্রমিক নিজের স্বার্থ ছাড়াই শিল্পের ভালোর জন্য এবং ঠিকাদারের উপকারের জন্য কাজ করেন ৷ আর এই পদ্ধতিতে শিল্পক্ষেত্র থেকে শ্রমিকরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং ব্যবসার মাঝামাঝি সময়ে ঠিকাদারের সঙ্গে তাঁদের উৎপাদন প্রক্রিয়াই ভারতের বিকাশের এবং দ্রুত নগরায়ণের বৈশিষ্ট্য ৷ এই নজিরবিহীন লকডাউন চাপানোর সময় শিল্পক্ষেত্র এবং ঠিকাদার উভয়েই দায় ঝেড়ে ফেলল আর শ্রমিকদের অর্থনৈতিক দুর্বলতার দিকে ঠেলে দিল ৷ শ্রমিকদের উপর লকডাউনের প্রভাব বিবেচনা না করার ক্ষেত্রে সরকারগুলির উদাসীনতাকে রাজনৈতিক অসাম্যের দিক দিয়ে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে ।

পরিযায়ী শ্রমিকরা যে রাজনৈতিক বৈষম্য নিয়ে বেঁচে থাকেন , তার মধ্যে দু’টি সমালোচনামূলক কারণ জড়িয়ে থাকতে পারে ৷ রাজনৈতিক বোধের অভাব এবং নির্বাচনী রাজনীতিতে খুব কম প্রতিনিধিত্ব ৷ শ্রমিকরা বাড়ি ছেড়ে শহরে চলে যাওয়ার ফলে তাঁরা রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন ৷ কারণ, তখন তাঁদের নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষিত করার জন্য রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে দর কষাকষির সুযোগ কমে যায় ৷ বিশেষ করে একেবারে নিচুস্তরের শ্রমিকরা, যাঁরা সারাক্ষণ কাজের জন্য এক শহর থেকে অন্য শহর কিংবা একই শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান, তাঁদের রাজনৈতিক দলগুলি সম্ভাব্য ভোটার হিসেবে ধরেই না ৷ যখন এই পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজনৈতিক দলগুলি ভোটার হিসেবে বুঝতে পারে, তখনই তাঁদের কাছে পৌঁছানোর একাধিক প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে ৷ 2018 সালের ডিসেম্বরে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পটনায়েক গুজরাতের সুরাতে গিয়েছিলেন ৷ তাঁর রাজ্যের বিধানসভা ভোট ও 2019-এর লোকসভা নির্বাচনের আগের ওই সফরের উদ্দেশ্যে ছিল সেখানে ওড়িয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের সন্তুষ্ট করার চেষ্টা ৷ তাছাড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের বড় অংশ যেহেতু নির্বাচনী রাজনীতি অংশগ্রহণ করে না, তাই অবহেলার কারণে Covid-19 সংকটের তাঁদের নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় ৷

একই সঙ্গে পরিযায়ী শ্রমিকদের শ্রমিক হিসেবে একটি পরিচয়ও রাজনৈতিক ভাবে দুর্বলতার দিকে ঠেলে দেয় ৷ পরিযায়ী শ্রমিকদের সৌভাগ্যবশত (দুর্ভাগ্যজনকও হতে পারে) কোনও ধর্ম বা জাতির ভিত্তিতে দেখা হয় না ৷ যদি তা হত, তাহলে পরিযায়ী শ্রমিকরা যে সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তাকে কোনও ধর্ম বা জাতির সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়া হত ৷ তখন রাজনৈতিক শক্তিগুলির তরফ থেকে প্রতিক্রিয়া একেবারে অন্যরকমের হত ৷ আরও বলা যায় যে ভারতীয় রাজনীতিতে বামপন্থী দলগুলির কোণঠাসা অবস্থা এবং শ্রমিক সংগঠনে তাদের খুব কম ভূমিকা পরিযায়ী শ্রমিকদের এই রাজনৈতিক সংকটজনক পরিচয় গড়ে তুলছে ৷ এই সংকটের সময় আমরা সরকারের সামনে এই ইশুতে বামপন্থী দলগুলিকে খুব বেশি সরব হতে দেখিনি ৷ কিংবা পরিযায়ী শ্রমিকদের সাহায্যের জন্যও তারা খুব বেশি এগিয়ে যায়নি ৷ শ্রমিক সংগঠনের তরফেও পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি একই রকম উদাসীনতা দেখানোর কথা যে কেউ বলতেই পারেন ৷

পরিযায়ী শ্রমিকরা যে বৈষম্যগুলির মুখোমুখি হন, তার তৃতীয় কারণ হল তাঁদের নিম্নস্তরের সামাজিক অবস্থান ৷ যার জন্য তাঁদের বড় ধরনের অবহেলার মুখে পড়তে হয় ৷ বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, চাষবাস থেকে বেরিয়ে অনেকেই শহরে কাজ করতে চলে যাচ্ছেন ৷ চাষবাস ছেড়ে চলে যাওয়ার এই পদ্ধতিতেই পরিযায়ী শ্রমিকের সামাজিক পরিচয় নষ্ট করছে ৷ এই কর্মীরা যখন নিজেদের এলাকায় চাষবাসের কাজ করেন, তখন তাঁরা যে ধরনের সামাজিক পরিচিতি পান, শহরে গিয়ে কাজ করার সময় তা তাঁরা পান না ৷ তখন তাঁদের শুধু পরিযায়ী শ্রমিকের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয় ৷ এই প্রক্রিয়াটি তাঁদের সামাজিক মূলধনকেও যথেষ্ট পরিমাণে কমিয়ে দেয় ৷ চাষবাস থেকে পরিযায়ী শ্রমিকে পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়া তাঁদের প্রতি সামাজিক বঞ্চনা আরও বৃদ্ধি করে ৷ Covid-19 সংকটের সময় পরিযায়ী শ্রমিকদের সামাজিক পরিচয় এবং ব্যক্তিগত সম্মান যেভাবে কমে গেল, এভাবে তা আগে কখনও কমেনি ৷

এই প্যানডেমিক ছড়িয়ে পড়ার কারণে পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা এবং নজিরবিহীনভাবে ঘোষণা করা লকডাউনের ফলে কাজ হারানোর জন্য বছরের পর বছর ধরে তাঁরা যে বৈষম্য ও দুর্বলতার শিকার হচ্ছেন, তা সামনে চলে এসেছে ৷ পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি অমানবিকতা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে একটা বড় ঝাঁকুনি দিয়েছে এবং মনোভাব ও নীতি নির্ধারণে একটা তাৎক্ষণিক পরিবর্তনও লক্ষ্য করা গিয়েছে ৷ দুর্বলদের প্রতি সংহতি প্রকাশের ক্ষেত্রে নাগরিকদের সংবেদনশীলতা প্রকাশ পেতে পারে ৷ তবে পরিযায়ী শ্রমিকদের অধিকার সুনিশ্চিত করার দাবিই একমাত্র তাঁদের ভবিষ্যতের কোনও সংকট থেকে উদ্ধার করতে পারবে ৷

ড. অংশুমান বেহরা, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর , বেঙ্গালুরুর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডিজ় (NIAS)

ABOUT THE AUTHOR

...view details