পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / bharat

আসুন, আমাদের ভাষাগত ঐতিহ্যকে রক্ষা করি : উপরাষ্ট্রপতি

আমাদের দেশে 19 হাজার 500-রও বেশি ভাষা মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয় ৷ ভারতের মতো এত ভাষাগত বৈচিত্র আর কোথাও নেই ৷ এই ভাষাগুলিকে লালন-পালনের দায়িত্ব আমাদের সকলের ৷ মনে করিয়ে দিলেন দেশের উপরাষ্ট্রপতি বেঙ্কাইয়া নাইডু ৷

By

Published : Nov 12, 2019, 5:07 PM IST

Updated : Nov 12, 2019, 5:25 PM IST

ভাষা

দিল্লি, 12 নভেম্বর : আমাদের দেশ ভাষাগত ঐতিহ্যের রত্ন ভাণ্ডার । ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের জন্য এদেশ বিশ্বজুড়ে সমাদৃত । বহুবিধ ভাষার রঙিন উপস্থিতি আমাদের দেশকে অনন্য করে রেখেছে ।

কিন্তু, আমরা আমাদের এই সমৃদ্ধ প্রাদেশিক ভাষার সংরক্ষণে যথেষ্ট তৎপর নই । আর এই বিষয়টা নিয়ে আমি খুবই বিচলিত । শিক্ষার মাধ্যম সংক্রান্ত কোনও নীতি, বিশেষ করে মাধ্যমিক ও সেকেন্ডারি স্তরে প্রয়োগের আগে অবশ্যই সরকারকে বাড়তি সতর্কতা নিতে হবে । সৃজনশীলতার প্রকাশের ক্ষেত্রে মাতৃভাষার কোনও বিকল্প নেই । তবে খেয়াল রাখতে হবে, সৃজনশীলতার প্রাথমিক লালন যেন একেবারে গঠনমূলক পর্যায়ে করা হয় । আমাদের বৌদ্ধিক ও মানসিক বিকাশের অন্যতম সেরা মাধ্যম হল ভাষা । একাধিক প্রজন্মের মধ্যে সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন, বিজ্ঞান চেতনার আদানপ্রদান ও বিশ্ব দর্শনের প্রধান যান হল ভাষা । অতীত ও বর্তমানের মধ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ অথচ অদৃশ্য সেতুর কাজ করে ভাষা । মানুষের বিবর্তনের সঙ্গে এরও বিবর্তন ঘটে এবং বহুল ব্যবহারের দ্বারা এটি লালিত হয় ।

ভাষা আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও কৃষ্টির এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ । সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রেও এর অবদান অনস্বীকার্য । এক কথায় বলতে গেলে, আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে সভ্যতার তৃণমূলস্তর পর্যন্ত অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে রয়েছে ভাষা । আমাদের নিজস্বতা ও আমরা সমাজের যে স্তরের প্রতিনিধিত্ব করি, ভাষা তারই পরিচয়বাহক । মানুষে মানুষে সম্পর্কের বাঁধনকে আরও সুদৃঢ় করতে বিশেষ ভূমিকা নেয় ভাষা ।


ভাষাসুমারি অনুযায়ী, ভারতে 19 হাজার 500-রও বেশি ভাষা ও উপভাষা মাতৃভাষা হিসাবে ব্যবহৃত হয় । মোট 121 ধরনের ভাষায় কথা বলেন দেশের 10 হাজার বা তার বেশি সংখ্যার মানুষ । ভাষা স্থিতিশীল নয়, বরং তা সতত পরিবর্তনশীল ৷ দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থার সঙ্গে যা নিজেকে সর্বদাই উন্নীত করে চলেছে । ভাষার জন্ম হয়, পরিবর্তন হয়, বিবর্তন হয়, কখনও অন্য ভাষার সঙ্গে মিশে যায় আবার কোনও ক্ষেত্রে মৃত্যুও হয় । বিখ্যাত কবি আচার্য দণ্ডীর মতে, ভাষার আলোয় আমরা যদি আলোকিত না হতাম, তা হলে আমরা এক অন্ধকার বিশ্বে বাস করতাম ।

অত্যন্ত দুঃখের তথ্য এটাই যে, আমাদের দেশের 196টি ভাষা আজ বিপন্ন । আমাদের এটা খেয়াল রাখতেই হবে, যেন এই সংখ্যা আর না বাড়ে । ভাষাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদেরই । আর তা রক্ষা করার সেরা অস্ত্র হল এর বহুল ব্যবহার । আমাদের সমৃদ্ধশালী ভাষার ঐতিহ্যকে রক্ষা করাকে আমি সবসময়ই অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে এসেছি । পরম্পরার মাধ্যমে এবং আমাদের প্রাণবন্ত সভ্যতার হাত ধরে আসা এই রত্ন ভাণ্ডারকে আমরা কোনও ভাবেই হারাতে পারি না । আমরা যদি ভাষাকে অবহেলা করি, তা হলে আমরা নিজেদের অস্তিত্বের একটা মূল্যবান অংশকে অবহেলা করব । একটা ভাষার যখন মৃত্যু ঘটে, তখন তার সঙ্গে জ্ঞানের এক বিশাল ভাণ্ডার এবং ব্রহ্মাণ্ডকে দেখার এক বিশেষ দৃষ্টিরও মৃত্যু হয় । বিলুপ্ত হয় বিশেষ কিছু দক্ষতা, শিল্প, খাদ্যেরও ।

ভাষা সংরক্ষণ ও উন্নতির জন্য প্রয়োজন এক বহুমাত্রিক পদ্ধতির । এর সূচনা করা উচিত প্রাথমিক স্কুলগুলি থেকে । প্রথমিক স্কুলে সাধারণ নির্দেশগুলি মাতৃভাষাতেই দেওয়া উচিত । বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বহু পরীক্ষায় এটা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যে, মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষাদানে শিশুর বিকাশ ঘটে দ্রুত হারে । UNESCO-র ডিরেক্টর জেনেরাল অদ্রে আজুলে চলতি বছরের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বলেছিলেন, “UNESCO মনে করে, প্রতিটি মাতৃভাষারই নিজস্ব পরিচয় থাকা উচিত । সাধারণ মানুষের জীবনে তার নিজস্বতা থাকা উচিত । মাতৃভাষা সবসময় জাতীয় ভাষা বা অফিশিয়াল ভাষার তকমা পায় না । এর ফলে অনেক সময় মাতৃভাষার অবমূল্যায়ন ঘটে এবং তা ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে ।”


আমাদের বেশির ভাগের মধ্যে একটা ধারণা রয়েছে যে, আধুনিক বিশ্বে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেতে শুধুমাত্র ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজন । এই ধারণা একেবারেই ঠিক নয় । বিশ্বে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি দেশ, যেমন অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, কানাডা, অ্যামেরিকা প্রভৃতিতে ইংরেজির বহুল ব্যবহার রয়েছে । কিন্তু জার্মানি, ফ্রান্স, চিন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশ ইংরেজি শিক্ষা ছাড়াও খুবই ভালো করছে । অন্য আন্তর্জাতিক ভাষা জানাটা যতটা কার্যকর, ইংরেজি শেখাটাও ঠিক ততটাই । মাতৃভাষা ভুলে গিয়ে ইংরেজি শিক্ষা একেবারেই কাজের কথা নয় । মাতৃভাষায় পারদর্শিতা থাকলে একটা সময়ের পরে সঠিক মঞ্চে ইংরেজি শিক্ষা একেবারেই কঠিন বিষয় নয় ।

দেশের ভাষাগত ঐতিহ্যকে রক্ষার বার্তা উপরাষ্ট্রপতির

শুধুমাত্র প্রাথমিক শিক্ষা বা স্কুলের নির্দেশের জন্য নয়, প্রশাসনিক, ব্যাংকিং এবং বিচার বিভাগের কাজও যাতে মাতৃভাষায় হয়, তা নিশ্চিত করতে দৃঢ় পদক্ষেপের প্রয়োজন । আমার মতে, শক্তিশালী গণতন্ত্রের এটা অন্যতম ভিত্তি । ভাষাগত বিভেদ মুছে ফেলে সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে চলতে হবে যা অন্তর্ভুক্তি সরকারের প্রাথমিক উদ্দেশ্য । যখনই সরকারের সঙ্গে সাধারণের কথা হবে, তা যেন এমনই ভাষায় হয়, যা সকলের বোধগম্য ।

আমি এটা একেবারেই বলছি না যে আমরা আমাদের সন্তানদের একাধিক ভাষা শেখাব না । সাহিত্য ও বিজ্ঞানের নতুন দিগন্তের সন্ধান পেতে একাধিক ভাষা জানা অত্যন্ত দরকার । উলটে ভারতের উচিত, দেশের বিপুল মানব সম্পদকে কাজে লাগিয়ে আগামী দিনে জ্ঞান অর্থনীতিতে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়া ।

1999 সালে UNESCO একাধিক ভাষায় শিক্ষার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত নেয় । সেই সিদ্ধান্ত অনুয়ায়ী, শিক্ষায় অন্তত তিনটি ভাষার ব্যবহার করার আর্জি জানানো হয়, মাতৃভাষা, একটি প্রাদেশিক বা জাতীয় ভাষা এবং একটি আন্তর্জাতিক ভাষা । সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল, মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের গুরুত্ব মেনে নিয়ে UNESCO বলেছে, মাতৃভাষা জ্ঞান ও উদ্ভাবনী শক্তির আধার । তাদের আরও দাবি, মাতৃভাষায় শিক্ষাদান শিক্ষাকে সহজতর করে তোলে । এটা উৎসাহবর্ধক যে, জাতীয় শিক্ষানীতির যে খসড়া তৈরি হয়েছে, তাতে মাতৃভাষা, বিভিন্ন আদি ভাষা এমনকি সাইন ল্যাঙ্গুয়েজকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে । চলতি বছরকে রাষ্ট্রসংঘ দেশীয় ভাষা সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবন ও প্রচারের বছর হিসাবে উল্লেখ করেছে । ভারতে এই রকম একাধিক ভাষা রয়েছে, যেগুলি অবলুপ্তির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ।

আমি আশা করি, আরও বেশি করে মানুষ বাড়িতে, সমাজে, প্রশাসনে তাদের নিজেদের ভাষার ব্যবহার শুরু করবেন । দেশের মানুষ আরও বেশি করে নিজেদের ভাষায় গল্প, কবিতা, নাটক, লেখা শুরু করবে । নিজেদের ভাষা ব্যবহার করে আমাদের গর্বিত হতে হবে । দেশীয় ভাষায় আরও বেশি করে বই, ম্যাগাজিন ছাপার উপর গুরুত্ব দিতে হবে । উপভাষা এবং লোকসাহিত্যের গুরুত্ব বাড়াতে হবে ।

ভাষাকে আমাদের উন্নতির অন্যতম অনুঘটক হতে হবে । ভাষার উন্নতিতে সরকারকে উপযুক্ত পদক্ষেপ করতে হবে । স্বামী বিবেকানন্দের কথায়, একটা জাতীয় উন্নতির প্রধান সূচক হল ভাষা । দেশের জনগণের ক্ষমতায়নে ভাষাকে ব্যবহার করতেই হবে । রাজ্যসভাতেও সদস্যরা 22টি ভাষার যে কোনও একটিতে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করতে পারেন । সুপ্রিম কোর্টও সম্প্রতি রায়ের প্রতিলিপি ছ’টি প্রাদেশিক ভাষায় দেওয়ার কথা জানিয়েছে । বিচার বিভাগে ভাষার ব্যবধান মুছে দিয়ে আইনকে সবার আওতায় আনতে এটা একটা সুদৃঢ় পদক্ষেপ । ইংরেজি, হিন্দি ছাড়া আরও 13টি প্রাদেশিক ভাষায় বিভিন্ন ব্যাংকে চাকরির পরীক্ষা নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে অর্থমন্ত্রকও । রেল ও পোস্ট অফিস চাকরির পরীক্ষাগুলি স্বীয় রাজ্যের সরকারি ভাষায় নেওয়া শুরু করেছে ।

যুব-সংখ্যার নিরিখে বিশ্বের বাকি দেশগুলির তুলনায় ভারত অনেকটাই এগিয়ে । দেশের 65 শতাংশের গড় বয়স 35 বছরের নিচে । মাতৃভাষা ও উপভাষাগুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে এই যুব সমাজকে উৎসাহ দিয়ে যেতে হবে । আমাদের সন্তানদের ভাষাকে ভালোবাসতে শেখাতে হবে । এগুলো দ্রুত না করলে আমরা আমাদের সভ্যতার পরিচয় ক্রমশ হারিয়ে ফেলব । পরে কিন্তু এটা নিয়ে আপশোস করার কোনও জায়গা থাকবে না । আসুন আমরা সবাই মিলে মাতৃভাষাকে লালন করি । মাতৃভাষাকে রক্ষার অঙ্গীকার নিই ।

Last Updated : Nov 12, 2019, 5:25 PM IST

ABOUT THE AUTHOR

...view details