দিল্লি, 16 নভেম্বর : আমাদের দেশে সরকারি প্রকল্পগুলির বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সাধারণ সমস্যা হল অর্থাভাব । যদিও এটাও ঠিক যে, অনেক প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ হওয়ার পরেও উদ্যোগের অভাবে সেগুলি বাস্তবায়িত হয় না । সম্প্রতি নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রক রাজ্যগুলির কাছে আবেদন করেছে যে, পোষণ অভিযান প্রকল্পটি যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বাস্তবায়িত করা হোক এবং এজন্য যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে তা যেন যথাযথ খরচ করা হয় । বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে । কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, "রাজ্যগুলি প্রকল্পটির বাস্তবায়নে পিছিয়ে পড়েছে ।" পোষণ অভিযান প্রকল্পটি অনেক রাজ্যে নাম কে ওয়াস্তে রূপায়িত হচ্ছে এবং কিছু রাজ্য যেমন, পশ্চিমবঙ্গ, হরিয়ানা, পঞ্জাব, কেরল, গোয়া ও ওড়িশা এক্ষেত্রে অনেকটাই পিছনে । কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যে প্রকল্পটির জন্য 3769 কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে কিন্তু এখনও পর্যন্ত সেই টাকার মাত্র 33 শতাংশ অর্থাৎ 1058 কোটি টাকা খরচ করেছে রাজ্যগুলি । পঞ্জাব ও কর্নাটকে তো মোট বরাদ্দের মাত্র 1 শতাংশ খরচ হয়েছে । হরিয়ানা ও কেরলে মোট বরাদ্দের 10 শতাংশেরও কম খরচ হয়েছে ।
পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস, যাদের সঙ্গে কেন্দ্রের শাসক দল BJP-র আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক । পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকার পোষণ অভিযান প্রকল্পটিতে কোনও গুরুত্বই দেয়নি । এই বিষয়ে রাজ্যের মন্ত্রী শশী পাঁজা বলেন, ‘‘রাজ্যের নিজস্ব পুষ্টি প্রকল্পটি কেন্দ্রের পোষণ অভিযান প্রকল্পের তুলনায় অনেক বেশি কার্যকরী ও বাস্তবসম্মত । তাই কেন্দ্রের প্রকল্পটি রাজ্যে বাস্তবায়িত করা হয়নি ।" প্রায় একই অবস্থা BJP শাসিত গোয়ায় । সেখানে রাজ্য প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট আধিকারিক দীপালি নায়েক বলেন, ‘"প্রকল্পটি রূপায়ণে যে পরিমাণ কর্মী প্রয়োজন তা আমাদের হাতে নেই । তাই সেটি ঠিক মতো বাস্তবায়িত করা যাচ্ছে না ।’" তিনি আরও বলেছেন, ‘‘প্রকল্পটির জন্য বরাদ্দ অর্থ দিয়ে প্রয়োজনীয় স্মার্ট ফোন ও অন্যান্য সরঞ্জাম কিনতে দেরি হওয়ায় প্রকল্পটির রূপায়ণে সমস্যা হচ্ছে ।’’
পঞ্জাবের পরিস্থিতি এই রাজ্যগুলির তুলনায় কিছুটা ভালো । বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, যে গতিতে এখন প্রকল্পটির কাজ হচ্ছে, তা নির্ধারিত গতির চেয়ে অনেক কম । আন্তর্জাতিক মেডিকাল জার্নাল ল্যানসেট-এর সমীক্ষা জানিয়েছে, ভারত নারী ও শিশুদের মধ্যে সঠিক বৃদ্ধির অভাব, কম ওজন, রক্তাল্পতা ইত্যাদি সমস্যা দূর করতে পারবে না, যদি না 2022 সালের মধ্যে ‘পোষণ অভিযান’ প্রকল্পটি তার লক্ষ্যে পৌঁছায় । ইন্ডিয়ান মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলও একই মত ব্যক্ত করেছে । প্রায় প্রতিটি রাজ্যের নারী ও শিশু সঠিক পুষ্টির অভাবে নানা সমস্যায় ভুগছে যদিও গর্ভবতী, সদ্যোজাত ও ছয় বছরের কম শিশুদের পুষ্টির জন্য সরকার একাধিক প্রকল্প চালু করেছে ।
2018 সালে পোষণ অভিযান প্রকল্পটি চালু হয়েছে । লক্ষ্য নারী ও শিশুদের পুষ্টির জন্য যে সমস্ত প্রকল্প চালু রয়েছে সেগুলির উদ্দেশ্য পূরণ করা । বিভিন্ন মন্ত্রকের সেই সমস্ত প্রকল্পগুলিকে একসূত্রে বেঁধে যথাযথভাবে কার্যকর করাই ‘পোষণ অভিযান’ প্রকল্পটির উদ্দেশ্য । প্রকল্পটির মুখ্য উদ্দেশ্য হল অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির মাধ্যমে 2022 সালের মধ্যে দেশ থেকে অপুষ্টি সংক্রান্ত সমস্যাগুলিকে দূর করা । নীতি আয়োগ সব রাজ্যের জন্য একটি লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছে । এই লক্ষ্যমাত্রা হল ‘পোষণ অভিযান’ প্রকল্পটির মাধ্যমে প্রতি বছর অপুষ্টির জন্য শিশুদের উচ্চতা হ্রাসের সমস্যা 2 শতাংশ কমানো, শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধির হ্রাস সংক্রান্ত সমস্যা 2 শতাংশ কমানো, সদ্যোজাত, নারী ও বাড়ন্ত বয়সের শিশুদের রক্তাল্পতা 3 শতাংশ কমানো এবং কম ওজনের শিশু প্রসবের হার দুই শতাংশ কমানো । নীতি আয়োগ দেশের 27টি রাজ্যে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল । সেই সমীক্ষার ফল চমকে দেওয়ার মতো । দেখা গেছে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে 78 শতাংশ গর্ভবতী ও প্রসূতি নাম লিখিয়েছেন এবং তাঁদের মধ্যে মাত্র 46 শতাংশ পুষ্টিকর খাবার পান ।
প্রধানমন্ত্রীর মাতৃ বন্দনা প্রকল্প অনুসারে 25 দিন ধরে খাবার দেওয়া উচিত, কিন্তু বাস্তবে তা দেওয়া হয় তার অর্ধেক দিন । কেন্দ্রীয় সরকার 2021 সালের মধ্যে দেশের সমস্ত অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিকে ডিজ়িটাল পদ্ধতির আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে । পাশাপাশি ‘পোষণ অভিযান’-এর কাজকর্ম কেমন চলছে তার নজরদারির জন্য স্মার্ট ফোন ব্যবহার করার পরিকল্পনা নিয়েছে । পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে যে, দেশের 26 টি রাজ্যের 285টি জেলার মাত্র 4 লাখ 84 হাজার 901 টি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র ডিজ়িটাল টেকলনোলজি ব্যবহার করছে এবং সেখানে তাদের কাজকর্ম নিয়মিত রেকর্ড করা হচ্ছে ।
দেশে 14 লাখ অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র 27.6 শতাংশ কেন্দ্রে স্মার্ট ফোন রয়েছে এবং 35 টি কেন্দ্রে উচ্চতা মাপারও ওজন মাপার যন্ত্র রয়েছে । অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির জন্য প্রায় 6.28 লাখ স্মার্ট ফোন কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং আরও 4.95 লাখ স্মার্ট ফোন কেনার পরিকল্পনা রয়েছে । তবে পশ্চিমবঙ্গ, পঞ্জাব ও ওড়িশা সরকারের এখনও পর্যন্ত অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির জন্য স্মার্ট ফোন কেনার বিষয়টি নিয়ে কোনও হেলদোল নেই । নীতি আয়োগ লক্ষ্য করেছে যে, মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত রেকর্ডও ঠিক মতো রাখা হচ্ছে না । স্মার্ট ফোন থাকলেও তা পুরোপুরি কাজে লাগানো হচ্ছে না । এছাড়া বাস্তব ক্ষেত্রে যে তথ্যগুলি সংগ্রহ করা হচ্ছে তা ঠিকমতো পরীক্ষা করা হচ্ছে না । এই বিষয়টিতে বিশেষ করে গুরুত্ব দেওয়া উচিত কারণ কেন্দ্রের নজরদারিতে ধরা পড়েছে ‘পোষণ অভিযান’ প্রকল্পে প্রায় 14 লাখ ভুয়ো উপভোক্তার নাম রয়েছে । নীতি আয়োগ জানিয়েছে, অপর্যাপ্ত কর্মীর জন্য প্রকল্পটি ঠিক মতো রূপায়ণ করা যাচ্ছে না । প্রজেক্ট ডিরেক্টর ও মহিলা পরিদর্শকের 25 শতাংশ পদ এখনও ফাঁকা । ‘মাতৃ বন্দনা’ প্রকল্পে রাজ্য ও জেলা স্তরে এখনও প্রচুর পদ ফাঁকা ।
তাই এই প্রশ্নটা এখন নিজেদের করার সময় এসেছে যে, এত ত্রুটি নিয়ে কেমন করে প্রকল্পটি সার্থক ভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব ? প্রথমেই যেটা করা উচিত তা হল, খরচ না হওয়া বরাদ্দ টাকা কীভাবে সঠিক উপায়ে খরচ করা যায় তা দেখা । এনিয়ে জন সচেতনতাও বাড়ানো দরকার । "যদি আমরা ঠিক ভাবে কাজ করতে পারি, তাহলে পুষ্টিকর খাবার সেই সমস্ত উপভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে যাদের তা দরকার । যদি নির্দিষ্ট সময়ে লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে হয়, তা হলে পোষণ অভিযান প্রকল্পের বাস্তবায়নের গতি বাড়ানো উচিত । এটা মনে রাখতে হবে যে, অপুষ্ট আগামী প্রজন্মকে নিয়ে আমরা কোনওভাবেই একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন করতে পারব না ।"