পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / bharat

গঙ্গাকে পরিচ্ছন্ন করতে শুধু বিশ্বাসই কি যথেষ্ট? - ardh Kumbh Mela

যে নদীকে দেবীরূপে সম্মান করা হত, আজ তার মধ্যে উর্বর পলি আর খনিজ পদার্থ নেই, রয়েছে শুধু আবর্জনা, লক্ষ লক্ষ লিটার বিষ্ঠা, অপরিশোধিত বর্জ্য, ভারী ধাতু, ওষুধ প্রতিরোধী জীবাণুর মিশ্রণ । গঙ্গা বিশ্বের সবথেকে দূষিত নদীগুলির মধ্যে চতুর্থ, যা শুধু মানুষ নয়, মাছ ও উদ্ভিদদের জন্যও বিষাক্ত । প্রতিবেদনটি লিখেছেন ন্যাশনাল সিড অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ার পলিসি অ্যান্ড আউটরিচ অধিকর্তা ইন্দ্রশেখর সিং ৷

clean the Ganga
গঙ্গা

By

Published : Feb 26, 2020, 1:40 PM IST

"জল ঠিক মায়ের মতোই, এক মহান ধারক"-- তৈরিত্তীয় সংহিতা

পরিবেশ-হিংসা উদাসীনতার মতোই ছোঁয়াচে, যেটা আজ ভারতীয় সমাজের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে । এই হিংসা যেন পরিশুদ্ধ আফিম বা হেরোইন,যা উদাসীনতা নামের সূচ দিয়ে আমাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে । আর হ্যাঁ, আমরা এটা পছন্দও করছি । দুই যমজ -- হিংসা এবং উদাসীনতা গ্রহধ্বংসের পথে একটা দেশকে ঠেলে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট । এই ঘোরের মধ্যেই আমরা আমাদের পাহাড় ও বৃষ্টিবনকে ধ্বংস করেছি, আর ভারত শেষপর্যন্ত পরিবেশ বিপর্যয়ের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছেছে । ফলস্বরূপ, সাত লক্ষ মানুষের অকালমৃ্ত্যু হয়েছে জলদূষণের কবলে, আর লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত উদরাময় থেকে ভারী ধাতুর বিষক্রিয়ায় । আমাদের ভূপৃষ্ঠের জলের উৎস সঙ্কুচিত হচ্ছে এবং ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে যাচ্ছে আরও গভীরে । এটা আগামী দশকে জল নিয়ে যুদ্ধের ইঙ্গিত ।

তরুণ প্রজন্মের ভারতীয় "ঠিকাদাররা" উদ্ধতভাবে আমাদের নদীগুলি ও তার বালুতটে লুঠ চালাচ্ছে । তারা অবৈধভাবে নুড়িপাথর সংগ্রহ করছে ও পাথরের স্তরে খননকার্য চালাচ্ছে । সেই সময়ে দাড়িয়ে প্রবীণ প্রজন্ম দায়িত্বশীলতার বুলি আওড়াচ্ছে, কারণ তারা ভুলে গেছে যে তারাই এই উদাসীনতা আমাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিল । দূষণের জন্য সরকার দায়ী নয়; এটা মানুষের পাপ - লোভ, অপদার্থতা আর ভারতীয় চেতনার অবক্ষয় । আমাদের সমাজ হিংসা ও উদাসীনতাকে আপন করে নিয়েছে, বলি দিয়েছে আমাদের মা গঙ্গাকে।

যে নদীকে দেবীরূপে সম্মান করা হত, আজ তার মধ্যে উর্বর পলি আর খনিজ পদার্থ নেই, রয়েছে শুধু আবর্জনা, লক্ষ লক্ষ লিটার বিষ্ঠা, অপরিশোধিত বর্জ্য, ভারী ধাতু, ওষুধ প্রতিরোধী জীবাণুর মিশ্রণ । গঙ্গা বিশ্বের সবথেকে দূষিত নদীগুলির মধ্যে চতুর্থ, যা শুধু মানুষ নয়, মাছ ও উদ্ভিদদের জন্যও বিষাক্ত । নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট থেকে আমাদের সরকারের নিজস্ব মূল্যায়নে এটাই দেখা যায় যে, আমাদের মা গঙ্গা প্রায় একটা দুর্গন্ধযুক্ত নালায় পরিণত হয়েছে, যা এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে গাঙ্গেয় সমভূমির ওপর দিয়ে ।

গঙ্গা যাত্রা আর সচেতনতা অভিযান সমস্যা মেটাতে প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে, কিন্তু সমাধান থেকে তা বহুদূরে । গঙ্গাকে বাঁচাতে ইতিমধ্যেই হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে । তবে আজও এলাহাবাদে নদীর জল, যেটুকুই হোক না কেন, তা পানের অযোগ্য ।

আমার মনে পড়ছে ২০১৯ সালের অর্ধকুম্ভ মেলার পরবর্তী সময়ের কথা, যা হিন্দু ধর্মবিশ্বাসের অন্যতম বৃহৎ জমায়েত, সেখানে দেখা গিয়েছিল যে পুরো শহরে জীবাণু ছেয়ে গিয়েছে, আর নদীতীর জুড়ে শুধু আবর্জনা পচছে । লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থীর বিশ্বাস নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই, কিন্তু এটা কি সঠিক ভাবনার ওপর বিশ্বাস ?

অর্ধকুম্ভ মেলা

উত্তরটা দেওয়াটা জটিল, কিন্তু সত্যিটা সুস্পষ্ট । বিপথে চালিত বিশ্বাস অথবা শুধু মুখের কথায় বিশ্বাস, দশকের পর দশক ধরে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ নদীকে খুন করেছে । পাপী মনের কাছে গঙ্গায় ডুব দেওয়া সস্তায় ইচ্ছাপূরণ হতে পারে, কিন্তু নদীকে বাদ দিয়ে শুধু নিজের স্বার্থ পূরণ হিন্দুত্ব নয়, বরং হিন্দুত্ব অহংকারের বিকৃতি ।

সমাধানটা কঠিন,যেখানে আত্মত্যাগের প্রয়োজন আছে । আমাদের প্রথমেই নদীতে পুণ্যস্নানে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, বিশেষ করে উত্তরাখণ্ডের উপরদিকের এলাকায় । নিকাশী বর্জ্য, যা দূষণের ৮ শতাংশ, তাকে এখনই বন্ধ করতে হবে । জাতীয় গঙ্গা সংরক্ষণ পরিকল্পনায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত বর্জ্য ব্য়বস্থাপনায়, বিশেষ করে নদীর উত্তরদিকের প্রবাহপথগুলিতে । বর্তমানে, আমরা গঙ্গায় বর্জ্য ভেসে আসা বন্ধ করতে পারিনা । আমাদের উৎসে গিয়েই পরিশোধন ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে । বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ফলপ্রসূ না হলে, নদী কোনওদিন সুস্থ হয়ে উঠবে না ।

এমন একটা সক্রিয় পোর্টালের প্রযোজন রয়েছে, যারা গঙ্গার পুরো অংশ এবং তার উপনদীগুলির জলের স্বাস্থ্য নিয়ে রিপোর্ট দেবে । পরের ধাপে, গঙ্গার জলধারণের অঞ্চলগুলিকে পুনরুদ্ধার করতে হবে । গঙ্গার সমস্ত উপনদীকে জাতীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করার প্রয়োজন রয়েছে । নদীতীরে বালিখাদান, পাথর খাদান ও আবর্জনা বর্জন করাকে গুরুতর অপরাধ হিসাবে গণ্য করতে হবে এবং কঠোর শাস্তির প্রস্তাব রাখতে হবে । সমস্ত রাজ্যের গ্রামীণ এলাকার পুলিশকে এই বিষয়ে সংবেদনশীল করে তুলতে হবে, কারণ অদূর ভবিষ্যতে জল সোনার থেকেও বেশি দামি হয়ে দাঁড়াতে পারে ।

কিন্তু দূষণসৃষ্টিকারী সবথেকে বড় শিল্পগুলির জন্য চাই আরও কঠোর নিয়মকানুন এবং নতুন পরিচ্ছন্ন গঙ্গা কর । কঠোর নিয়ম তৈরির জন্য সরকার নরওয়ে, সুইডেনের নদীনীতির থেকে অনুপ্রাণিত হতে পারে ৷ দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্পকেন্দ্রগুলিতে তাদের জমিতেই বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং রাজ্যের দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের রিপোর্ট খতিয়ে দেখবে তৃতীয় কোনও সংস্থা, যাতে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ্বতা বজায় থাকে । গঙ্গা অববাহিকার সবথেকে দূষিত শহরগুলো থেকে যে CSR তহবিলের টাকা পাওয়া যাবে, তা নদীর পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে নতুন করে বন্টন করতে হবে । পরিবেশ-ভিত্তিক শিল্পকে আরও উৎসাহিত করতে হবে এবং পরিবেশভিত্তিক পরিষেবাকে গুরুত্ব দিতে হবে ও অর্থকরী করে তুলতে হবে । উদাহরণ স্বরূপ, যদি কোনও চামড়ার কারখানা নিজেরা বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা না করতে পারে, তখন তারা এইসকল সংস্থাগুলির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পরিষেবা নিতে পারে । নদী সলংগ্ন ছোট-ছোট এলাকায়, শিল্পতালুকের বদলে সবুজ শিল্প তালুক গড়ে তুলতে হবে । এখানে শুধু তেমন কাজই হবে, যা জল পরিশোধনের সঙ্গে যুক্ত এবং নদীর ধারে সবুজ অঞ্চল গড়ে তুলতে উৎসাহ দেয় ।

গঙ্গার দুধারের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং কৃষকদের জৈব-কৃষিতে উৎসাহিত করার প্রযোজন রয়েছে । জৈব চাষের এই রূপান্তরে ভর্তুকি দেওয়া উচিত সরকার পক্ষ থেকে । "গঙ্গা অর্গ্যানিক"কে ক্রেতাদের কাছে ব্র্যান্ড হিসেবেও তুলে ধরা যেতে পারে । বিহার সরকার এই ধরণেরই একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার নাম 'জৈবিক সেতু' । এই প্রকল্পকে গাঙ্গেয় সমভূমি বরাবর ছড়িয়ে দেওয়ার দরকার ।

পরিশেষে বলা যায়, গঙ্গা, যমুনা বা অন্য যে কোনও নদীরই সঙ্কট হোক না কেন, সঙ্কটটা আসলে বিশ্বাসের । আমরা সমাজ হিসেবে আমাদের সংস্কৃতি ধ্বংস করেছি আর এখন রোগ ও দূষণের ফসল ঘরে তুলছি । একটি মৃত নদী, মৃত বিশ্বাস এবং মৃত হিন্দুত্বের প্রতীক । আমাদের লোভ ও আমাদের ধর্ম একসঙ্গে থাকতে পারে না । হয় নদী তার সমস্ত পবিত্রতাকে ধারণ করে বেঁচে থাকবে, নয়তো লোভ আর পরিবেশ ধ্বংসের জয় হবে । টাকা আর সরকারি উদ্যোগই গঙ্গাকে পরিচ্ছন্ন করে তুলতে যথেষ্ট নয় । সমাজে দায়িত্ববোধের ভাবনাকে জাগিয়ে তুলতে আমাদের প্রয়োজন গঙ্গা সত্যাগ্রহের ।

আমাদের জীবনদায়ী মা আজ বিষ উগরে দিচ্ছে, এর দায় সম্পূর্ণ আমাদের । সময় হয়েছে যখন আমরা ভারতীয়রা, নদীমাতৃক সভ্যতার সন্তানরা, শুভবুদ্ধি ফিরিয়ে আনি মায়েদের জন্য - ভারতবর্ষের নদীদের জন্য । মনে পড়ে যাচ্ছে গরুড় পুরাণের কথা - "গঙ্গার শুধু দর্শনেই মানুষের হাজারো পাপ মুছে যায় এবং গঙ্গা উচ্চারণ করলে, তার জল স্পর্শ করলে, বা পান করলে, মানুষ শুদ্ধ হয় ।" এমনই শুদ্ধ আর পবিত্র ছিল আমাদের মা গঙ্গা । এখন সময় হয়েছে নিজেদের পরিচ্ছন্ন করার এবং লোভ, স্বার্থপরতা এবংপরিবেশ ধ্বংস থেকে সমাজকে মুক্ত করার, সৎ ভাবনার মধ্যে দিয়ে গঙ্গাকে আবার আমাদের পবিত্র মা -তে পরিণত করে তোলার ।

ABOUT THE AUTHOR

...view details