ভারতের বিদেশ নীতিতে 2019 সালটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । চলতি বছরের মে মাসে লোকসভা নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফের BJP নেতৃত্বাধীন NDA সরকার ক্ষমতায় আসে । দ্বিতীয় NDA সরকারের আমলে বিদেশমন্ত্রী করা হয় এস জয়শঙ্করকে । প্রাক্তন এই IFS (Indian Foreign Service) আধিকারিক অ্যামেরিকা-সহ একাধিক দেশে ভারতের রাষ্ট্রদূত হিসেবে সফলভাবে কাজ করেছেন । তাই নরেন্দ্র মোদির সরকার জয়শঙ্করকে বিদেশমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করায় বোঝা গিয়েছিল যে, ভারত বিদেশনীতিতে আমূল পরিবর্তন এনে বিশ্বে অন্যতম শক্তিধর ও গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে চাইছে ।
কিন্তু এই উদ্দেশ্য সাধনে ভারত সবচেয়ে বড় বাধার সম্মুখীন হল চলতি বছরের অগাস্টে, যখন রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে চিন কাশ্মীর ইশুকে ফের আন্তর্জাতিক মঞ্চের আলোচনার টেবিলে আনার চেষ্টা করল । এই বিষয়টি রাষ্ট্রসংঘের টেবিলে শেষবার আলোচিত হয়েছিল 1971 সালে । কাশ্মীর ইশুতে আলোচনা চেয়ে চিন স্পষ্টতই পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের মজবুত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে তুলে ধরে ভারতকে কড়া বার্তা দিল । চিনের এই বহুমাত্রিক বিদেশ নীতি ভারতের সঙ্গে তাদের চেন্নাইতে চলতি বছরের ঘরোয়া বৈঠকের তাৎপর্যকে অনেকটাই গুরুত্বহীন করে তুলেছে । ফলে এশিয়ার দুই বৃহৎ শক্তিধর দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরির যে সোনালী রেখা দেখা গিয়েছিল, তা এখন অনেকটাই ম্রিয়মান মনে হচ্ছে ।
পুলওয়ামায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের মদতপুষ্ট জঙ্গিদের হামলায় 40জনের বেশি CRPF জওয়ান প্রাণ হারান । এর জেরে ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছায় । পরবর্তীতে ভারত বালাকোটে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ শিবিরে বিমান হানা চালিয়ে পুলওয়ামার হামলার জবাব দেয় । অগাস্টে পাকিস্তান একতরফাভাবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটায় এবং সেপ্টেম্বর থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে কাশ্মীর ইশুতে ভারতের বিরোধিতা করে প্রচার শুরু করে । তবে এই পরিস্থিতিতেও একটা ভালো খবর হল যে, পাকিস্তানে শিখদের ধর্মস্থানে ভারতীয়দের যাওয়ার সুবিধার জন্য অক্টোবরে কার্তারপুর করিডর খুলে দেয় ইসলামাবাদ ।
2019-এ ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলিতে একাধিক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে । প্রতিটি ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় ভারত তার বৈদেশিক স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখেছে । 2014 সালের SAARC থেকে যদি সাম্প্রতিককালের BIMSTEC-কে একটি সময়সীমা হিসেবে ধরা হয়, তবে দেখা যাবে ভারতের বিদেশ নীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে । ভারত তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির মধ্যে কাদের বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে, তা স্পষ্ট হয়েছিল যখন দ্বিতীয় NDA সরকার শপথ নেওয়ার সময় বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মায়ানমারকে দিল্লির তরফে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল । এছাড়া নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বিদেশ সফরের জন্য প্রথম দেশ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মালদ্বীপকে । পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষর বিদেশ সফরের প্রথম গন্তব্য ছিল ভারত । এসবের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে ভারতের নতুন বিদেশ নীতির সমীকরণের একটা আভাস পাওয়া যায় ।
কিন্তু চলতি বছরের শেষে বিভিন্ন ইশুতে দেশের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে তুমুল বিক্ষোভ শুরু হয়, যা ভারতের ‘পূবে তাকাও’ বিদেশ নীতিতে, বাংলাদেশ ও মায়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করে । এছাড়া চলতি বছর জাপানের সঙ্গে ভারতের গুয়াহাটিতে যে শীর্ষ বৈঠক হওয়ার কথা ছিল তা বাতিল হয়েছে । অন্যদিকে RCEP-তে ভারত যোগ দিতে অস্বীকার করেছে । RCEP ভারতকে বাণিজ্যিকভাবে ASEAN ভুক্ত দেশগুলির পাশাপাশি চিন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজ়িল্যান্ডের কাছাকাছি আনতে পারত । এই সিদ্ধান্ত ভারতের সঙ্গে তার প্রতিবেশী দেশগুলির সম্পর্কের পাশাপাশি আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকার উপরেও প্রভাব ফেলবে ।
তবে চলতি বছর ভারত বিদেশ নীতিতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে । এই সিদ্ধান্তগুলি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারতের ভূমিকা ও সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ । প্রথম সিদ্ধান্ত হল, ভারত রাষ্টসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ছাগোস দ্বীপপুঞ্জের প্রশাসনিক ক্ষমতা ছয়মাসের মধ্যে হস্তান্তরিত করার জন্য ইংল্যান্ডের উপর চাপ দিয়ে মরিশাসকে সমর্থন করেছিল । উল্লেখ্য, মরিশাসের ছাগোস দ্বীপপুঞ্জে অ্যামেরিকা সেনাবাহিনীর ডিয়েগো গার্সিয়া বেস রয়েছে । দ্বিতীয়, ডিসেম্বরে দিল্লি বৈঠকে ভারত জোর দিয়ে বলেছে যে, "ইন্দো-প্যাসিফিক উদ্যোগ স্বাভাবিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিম মহাসাগরীয় প্রতিবেশীদের, আরব মহাসাগরীয় অঞ্চলের দ্বীপরাষ্ট্রগুলিকে ও আফ্রিকার বন্ধু রাষ্ট্রগুলিকে অন্তর্ভূক্ত করে ।" এর জেরে এটা স্পষ্ট যে, পশ্চিমী ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারত তার প্রভাব ক্রমশ বাড়াতে চাইছে । তৃতীয়, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে চেন্নাই বন্দর থেকে রাশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় বন্দর ভ্লাদিভোস্তক পর্যন্ত নতুন সমুদ্রপথ চালু হয় । এই সিদ্ধান্তের ফলে প্রশান্ত মহাসাগরের ওই এলাকায় রাশিয়ার পাশাপাশি ভারতের প্রভাব বাড়ল বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল ।
চলতি বছরে ভারতের সঙ্গে অ্যামেরিকা, রাশিয়া ও ফ্রান্সের সম্পর্ক অনেকটাই নির্ভর করেছে বিষয়ভিত্তিক সমঝোতার উপর । বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কিছুটা মনকষাকষি হলেও ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও শক্তি ক্ষেত্রে অ্যামেরিকার সম্পর্ক এখন যথেষ্ট পোক্ত । দুই দেশের প্রতিরক্ষা ও বিদেশমন্ত্রী পর্যায়ে ডিসেম্বরে টু প্লাস টু বৈঠকে এই বিষয়গুলি নিয়ে মূলত আলোচনা হবে । রাশিয়ার সঙ্গে একাধিক বিষয়ে ভারতের সম্পর্ক এখন যথেষ্ট ভালো । যৌথ উদ্যোগে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সরঞ্জাম তৈরির ক্ষেত্রে রাশিয়া ও ভারত এখন যথেষ্ট ভালো কাজ করছে । ব্যবসায় অগ্রগতির জন্য এক বিলিয়ন ডলার মূল্যের ‘লাইন অফ ক্রেডিট’ ও রাশিয়ায় গিয়ে ভারতের শ্রমিকদের কাজ করার সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে । ফ্রান্সের সঙ্গেও ভারত বিভিন্ন ক্ষেত্রে একসঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । সেগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রতিরক্ষা, বিশ্ব পরিবেশ, আন্তর্জাতিক সৌর সহযোগিতা ইত্যাদি । এর মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক বিশেষ জোরদার হয়েছে, যা দুই দেশের বিদেশ নীতিকেই বহুমাত্রিকভাবে সাহায্য করবে ।
আন্তর্জাতিকস্তরে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হয়ে ওঠার জন্য ভারত এখন অর্থনীতি ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিশেষ জোর দিচ্ছে । পাশাপাশি UNSC ও IMF-র মতো গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চে বিশেষভাবে অংশ নেওয়ার বিষয়টিকেও ভারতের বিদেশ নীতিতে এখন প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে । 2019-র আর মাত্র কয়েকদিন বাকি, ভারতের বিদেশ নীতির এখন মুখ্য উদ্দেশ্য হল, এমন একটি বহু-মেরু বিশ্ব তৈরি করা যার মধ্যে থাকবে বহু-মেরু এশিয়া ।
অশোক মুখোপাধ্যায়, রাষ্ট্রসংঘে নিযুক্ত ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত