পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / bharat

নিকৃষ্টতম মানবাধিকারমূলক সংকটের সাক্ষী থাকছে ভারত

জঁ দ্রিজ হলেন বেলজিয়ামের বংশোদ্ভূত একজন ভারতীয় অর্থনীতিবিদ । বিগত চার দশকে ভারত যে একাধিক উন্নয়ন নির্ভর সমস্যার মুখে পড়েছে যেমন ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ এবং সামাজিক অসাম্য–তিনি এই বিষয়গুলির উপর কাজ করেছেন । তিনি মনে করেন যে, অতিথি (পরিযায়ী) শ্রমিক, যারা বর্তমানে উল্টো পথে হেটে নিজ নিজ রাজ্যে ফিরতে উদ্যত, তাদের প্রতি কেন্দ্র এবং রাজ্যগুলির প্রধান দায়িত্ব হল খাদ্য এবং আর্থিক নিরাপত্তা প্রদান করা । দ্রিজ বর্তমানে দিল্লি স্কুল অফ ইকোনমিক্সের অধ্যাপক এবং রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অফ ইকোনমিক্সের অতিথি অধ্যাপক পদে অধিষ্ঠিত । তিনি এই বিষয় নিয়ে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছেন । যেমন, দরিদ্রদের খাদ্যশস্য বণ্টন, গণবণ্টন ব্যবস্থার সুদৃঢ়করণ এবং কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্পের বাস্তবায়ন । পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রসঙ্গে নানা বিষয়ে ইনাডুর বিশেষ সংবাদদাতা, এমএল নরসিমহা রেড্ডির সঙ্গে তিনি সম্প্রতি কথা বলেন ।

পরিযায়ী শ্রমিক
পরিযায়ী শ্রমিক

By

Published : May 24, 2020, 6:54 PM IST

প্রশ্ন: লকডাউনের জেরে ভারতে হওয়া খাদ্য সংকটের পরিস্থিতি বর্তমানে ঠিক কেমন ?

গণবণ্টন ব্যবস্থা (PDS) ক্ষুধা নিবৃত্তি করতে পারে অনেকাংশেই । তিন মাসের জন্য ভরতুকিযুক্ত খাদ্যশস্যের পরিমাণ দ্বিগুণ করার সিদ্ধান্ত কেন্দ্রের ভাল পদক্ষেপ । কিন্তু PDS-এর আওতার বাইরে ৫০ কোটি মানুষ আছেন । তাদের মধে্য সকলেই যে দরিদ্র, তা নয় ৷ কিন্তু বেশিরভাগই দরিদ্র । প্যানডেমিকের জন্য এদের মধে্য সংখ্যাগরিষ্ঠই দারিদ্র‌্যসীমার নিচে অবস্থান করছেন । ঝাড়খণ্ডে হাজার হাজার দরিদ্র মানুষ বাস করছেন রেশন কার্ড ছাড়াই । এই খাদ্য সংকটের পরিধি নিরুপণ করা কঠিন কিন্তু আমরা অত্যন্ত সংকটজনক মোড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি । এর মোকাবিলা করার জন্য এই সমস্ত পরিবারকে PDS-এর আওতাভুক্ত করতে হবে । ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (FCI) এর কাছে প্রচুর খাবার মজুত আছে । সরকারের উচিত অবিলম্বে সেই সব খাদ্য শস্য বণ্টন করা ।

প্রশ্ন: পরিযায়ী শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার কী কোনও জরুরি পদক্ষেপ করছে ?

রাজ্য সরকারগুলির তরফে নেওয়া পুনর্বাসনমূলক উদ্যোগকে সমর্থন করে কেন্দ্র আরও ভালোভাবে নিজের ভূমিকা পালন করতে পারে । কেন্দ্রের উচিত রাজ্যগুলিকে খাবারের যোগান দেওয়া এবং নন-রেশন কার্ড হোল্ডারদেরও খাদ্যশস্য বণ্টন করা । যেহেতু রাজস্বে ঘাটতি হয়েছে, সুতরাং কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত রাজ্যগুলিকে দেওয়া আর্থিক অনুদানের পরিমাণ বাড়ানো । ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়েমেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্টের আওতায় কর্মসংস্থানের সুযোগ দিতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকাগুলির উচিত একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখা । PDS, পেনশন, কর্মসংস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পগুলি দরিদ্রদের বর্তমান সংকট কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে । জনকল্যাণমূলক কাজ যেমন গণ-হেঁসেল তৈরি করা এবং সত্ত্বভোগীদের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো এক্ষেত্রে সহায়ক হবে । অন্যান্য জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলিও আরও সক্রিয়ভাবে বাস্তবায়িত করা উচিত ।

প্রশ্ন: ভারতের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এত বড় খাদ্য সংকট কি আগে হয়েছে?

স্বাধীনতার আগে ভারত সাক্ষী ছিল বাংলার দুর্ভিক্ষের । বর্তমানে যা আমরা দেখছি, তার থেকে তখন পরিস্থিতি অনেক বেশি ভয়ংকর ছিল । তারপর দুর্ভিক্ষের ফলে মাঝেমাঝে খাদ্যসামগ্রীর ঘাটতির ঘটনা ঘটেছে । ১৯৬৬-৬৭ সালে আমরা বিহারের মহাদুর্ভিক্ষ দেখেছি । বর্তমানে যে খাদ্য সংকট চলছে, স্বাধীনতার পর থেকে এমন ভয়ানক সংকট হয়নি ।

প্রশ্ন: পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রস্থানের ঘটনা সামাল দিতে সরকারের ব্যর্থতার নেপথ্যে কী কী কারণ আছে?

সাধারণত পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গী কিছুটা হলেও রূঢ় । এবার সেই দৃষ্টিভঙ্গী আমরা সকলে দেখতে পেয়েছি টিভি এবং ইন্টারনেটের সৌজন্যে । গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কেন্দ্র এবং আশ্রয়দাতা রাজ্যগুলি পরিযায়ী শ্রমিকদের দূরবস্থার ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে নিষ্ঠুর পদক্ষেপ করছে । কাজ না পেয়ে, খাবার না পেয়ে, এমনকী, সরকারের তরফে কোনও সাহায্যও না পেয়ে এই শ্রমিকরা নিজেদের বাড়ি পৌঁছতে হাজার হাজার কিলোমিটার পথ হাঁটাকেই বিকল্প হিসাবে বেছে নিয়েছে । দরিদ্রদের প্রতি আমাদের মানসিকতার এটাই প্রতিবিম্ব । সংকটে তাদের সাহায্য করার বদলে আমরা তাদের রসাতলের আরও গভীরে ঠেলে দিয়েছি ।

প্রশ্ন: ভারত কি বড়সড় পুষ্টি সংকটের মুখে পড়তে চলেছে?

নিশ্চয়ই । সবচেয়ে বেশি অপুষ্টিতে ভোগা জনসংখ্যার হার রয়েছে ভারতেরই । PDS এবং জনকল্যাণমূলক প্রকল্প সত্ত্বেও ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য বেশিরভাগ মানুষের কাছে হয় শূন্য বা নামমাত্র উপায় রয়েছে । পুষ্টির মাপকাঠি কেবল পেট ভরা খাবার নয় । বরং সুষম পুষ্টির তালিকায় পড়ে সঠিক সময় খাওয়ার অভ্যাস, পরিষ্কার খাবার এবং জল । ভারতীয় দরিদ্ররা এর কোনওটিই পায় না । সমস্যা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে এই লকডাউন । সরকারের থেকে আর্থিক সাহায্য না পেলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে উঠবে ।

প্রশ্ন: ভবিষ্যতে পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে রাজ্যগুলির কি আরও বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত? এরকম কোনও উদ্যোগ কি নেওয়া হয়েছে?

দরিদ্র রাজ্য যেমন, উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির আরও সাহায্য প্রয়োজন । তারা সমূহ ক্ষতির মুখে পড়েছে । উত্তর-পূর্বের সুলভ শ্রমিকদের মাধ্যমে সংস্থাগুলি উপকৃত হয়েছে কিন্তু এই শ্রমিকরাই যখন সংকটের মুখে পড়েছে, তখন তাদের সংস্থাগুলি পরিত্যাগ করেছে । কেন্দ্রের সাহায্য ছাড়া এই সব রাজ্য এই শ্রমিকদের কোনওভাবেই সাহায্য করতে পারবে না । বরং কেন্দ্রের উচিত পরিযায়ী শ্রমিকদের সাহায্য করতে আরও বেশি দায়িত্ব গ্রহণ করা ।

প্রশ্ন: শ্রমিকরা নিজেদের গ্রামে ফিরে যাওয়ার পর তাঁদের পুনরায় ভিন রাজ্যে কাজে ফেরার সম্ভাবনা কম । এতে সেই সব রাজ্য শ্রমিক সংখ্যার ঘাটতির মুখে পড়বে । আপনি কী বলেন?

একদিন না একদিন পরিযায়ী শ্রমিকরা কাজে ফিরবেই । তবে কিছুদিনের জন্য তারা তাঁদের নিজ রাজ্যে কাজ খুঁজে নিতে পারে । বিহার ও ঝাড়খণ্ডের মতো রাজ্যে শ্রমিক সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় মজুরি কমে গিয়েছে । শিল্পপতিরা এর অন্যায্য সুযোগ নিতে পারেন । আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি শ্রমিকদের জন্য সহায়ক, এমন শ্রম আইনে পরিবর্তন আনতে, আগের সেই সব আইন বাতিল করছে বেশ কিছু রাজ্য । কর্মসংস্থানের অভাব এবং খাদ্য সংকট এই শ্রমিকদের আরও শোচনীয় অবস্থার মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে, যা তাদের শ্রম আইনে হওয়া এই সব পরিবর্তনের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে বাধা দিচ্ছে ।

ABOUT THE AUTHOR

...view details