নয়াদিল্লি, 31 অগাস্ট: উত্তর-পূর্বের উন্নয়নমুখী প্রকল্পগুলিতে যদিও ভারত বিদেশি শক্তির যোগদান কখনওই চায় না, তবু জাপানের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। উত্তর-পূর্বের এলাকায় ওই প্রকল্পগুলিতে জাপানের জড়িত হওয়ার কারণ জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের উপরে নয়াদিল্লির বিশ্বাস। এমনই মত এক প্রাক্তন ভারতীয় কূটনীতিবিদের। প্রসঙ্গত, এই সপ্তাহেই আবে শারীরিক অসুস্থতার কারণে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়ার কথা ঘোষণা করেছেন।
গেটওয়ে হাউস থিঙ্ক ট্যাঙ্কের ডিস্টিংগুইশড ফেলো তথা মায়ানমারে ভারতের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনকারী রাজীব ভাটিয়া ETV Bharat-কে বলেছেন, "ঐতিহ্যগতভাবে, উত্তর-পূর্ব ভারতে কোনও বিদেশি শক্তিকে দেশের কোনও কাজে জড়ানোর বিষয়ে ভারত বরাবরই সংবেদনশীল।" যদিও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের কার্যকলাপ নিয়ে প্রায়ই প্রতিক্রিয়া প্রদানকারী ভাটিয়ার মতে, "কিন্তু এখন নয়াদিল্লি নিজে থেকে উত্তর-পূর্বের বিকাশে জাপানের যোগদান চাইছে। এটাই স্পষ্ট ইঙ্গিত যে আবের নেতৃত্বের উপর ভারতের ঠিক কতটা আস্থা আছে।" ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল হল নয়াদিল্লি এবং টোকিওর যৌথ সহযোগিতার ক্ষেত্র এবং এক্ষেত্রে ভারতের উত্তর-পূর্বাংশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জাপানকে ভারতের "পূবে তাকাও" নীতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হিসাবে অভিহিত করেছিলেন এবং ভারত ও জাপান, এই দুই দেশই যে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য আরও সক্রিয় ও সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করতে উদে্যাগী হয়েছে, তাতে উত্তর-পূর্বাংশ একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্র হিসাবে উঠে এসেছে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল জাপানের পূর্ব উপকূল থেকে শুরু করে আফ্রিকার পূর্ব উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত৷ ভারত ও জাপান, দুই দেশই এই বিষয়ে সহমত যে, 10 সদসে্যর অ্যাসোসিয়েশন অফ সাউথ-ইস্ট এশিয়ান নেশনস (ASEAN) আঞ্চলিক ব্লককে এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতাবস্থা রক্ষায় প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে।
2018 সালে টোকিওয় মোদি এবং আবের মধে্য বার্ষিক দ্বিপাক্ষিক সম্মেলন হওয়ার পর ইন্ডিয়া-জাপান ভিশন স্টেটমেন্ট ইশু করা হয়, তাতে উভয় পক্ষই "মুক্ত এবং নিরপেক্ষ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল গড়ে তোলায় একযোগে কাজ করার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ" হওয়ার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, "দুই রাষ্ট্রনেতাই জানিয়েছেন যে, ASEAN-এর ঐক্য এবং কেন্দ্রীভবনই হল ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ধারণার মূল নির্যাস, যা এককথায় সামগ্রিক এবং অবাধ, অর্থাৎ সকলের জন্য খোলা।" "অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি"-র আওতায় ভারতের উত্তর-পূর্বাংশ, যার সঙ্গে ASEAN অঞ্চলের ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যগত যোগসূত্র রয়েছে৷ তাকে আদপে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতের নানা প্রকল্পে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের "স্প্রিংবোর্ড" হিসাবেই দেখা হচ্ছে। আর এর জন্য নয়াদিল্লি টোকিওর উপর বড় দায়িত্ব আরোপ করেছে। ভাটিয়া বলেছেন, মোদি এবং আবের মধে্য বিশেষ বন্ধুত্বের সম্পর্ক রয়েছে৷ ভারত-জাপান সম্পর্কের স্বর্ণালী অধ্যায় হল 2012 থেকে 2020 সাল। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী, ভারত-জাপান সম্পর্কের মধে্য তিনটি প্রধান দিক রয়েছে৷ যাকে ২০১৪ সালে টোকিওয় মোদির সফরে "স্পেশ্যাল স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড গ্লোবাল পার্টনারশিপ"-এর স্তরে উন্নীত করা হয়েছিল। এগুলি হল দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব, উত্তর-পূর্বাংশের উপরে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা এবং ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকায় চিনের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য খর্ব করা।
ভাটিয়ার মতে, "উত্তর-পূর্বে গুরুত্ব আরোপের নেপথে্য আবার দু’টি দিক রয়েছে। এক উন্নয়নমুখী প্রকল্প এবং সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা প্রকল্প। ঐতিহাসিক কারণের জন্যই জাপানের উত্তর-পূর্বাংশের প্রতি বিশেষ নৈকট্য রয়েছে।"
যদিও উত্তর-পূর্বের উন্নয়নে জাপান বেশ কিছু সময় ধরেই কাজ করে চলেছে, তবে সেই কাজে গতি আরও বেড়েছে 2017 সালের ডিসেম্বর মাসে "ইন্ডিয়া-জাপান অ্যাক্ট ইস্ট ফোরাম"-এর সূচনা হওয়ার পর থেকে। এই ফোরামের লক্ষ্য নয়াদিল্লির "অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি" এবং টোকিওর "ফ্রি অ্যান্ড ওপেন ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি"র নিয়মনীতির আওতায় ভারত-জাপানের অংশীদারিত্বকে জরুরি মঞ্চ দেওয়া। উত্তর-পূর্বের নির্দিষ্ট কিছু প্রকল্পের অর্থনৈতিক আধুনিকীকরণ করা। এর আওতাতেই আরও রয়েছে যোগাযোগ বৃদ্ধি করা, উন্নয়নশীল পরিকাঠামো গড়ে তোলা, শিল্পভিত্তিক যোগসূত্র বৃদ্ধি এবং পর্যটন, সংস্কৃতি ও খেলাধূলা বিষয়ক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনসংযোগ বাড়ানো। ভারতের উত্তর-পূর্বাংশের উন্নয়ন সংক্রান্ত (DoNER) রাষ্ট্রমন্ত্রী (স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত) জিতেন্দ্র সিং এবং ভারতে তৎকালীন জাপানি রাষ্ট্রদূত কেনজি হিরামাৎসুর নেতৃত্বে ভারতে আসা জাপানি প্রতিনিধিদলের মধে্য একটি বৈঠক হওয়ার পর 2019 সালের জুন মাসে জাপান প্রতিশ্রুতি দেয়, তারা উত্তর-পূর্ব ভারতের একাধিক রাজে্যর চলতি এবং নতুন বিভিন্ন প্রকল্পে অন্তত 205.784 বিলিয়ন ইয়েন (প্রায় 13,000 কোটি টাকা) বিনিয়োগ করবে। যে যে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলিতে জাপান অংশীদারিত্বের কথা জানায়, তার মধে্য রয়েছে অসমে গুয়াহাটি ওয়াটার সাপ্লাই প্রোজেক্ট এবং গুয়াহাটি সিওয়েজ প্রোজেক্ট, অসম ও মেঘালয়ের মধে্য বিস্তৃত নর্থইস্ট রোড নেটওয়ার্ক কানেক্টিভিটি ইমপ্রুভমেন্ট প্রোজেক্ট, মেঘালয়ে নর্থইস্ট নেটওয়ার্ক কানেক্টিভিটি ইমপ্রুভমেন্ট প্রোজেক্ট, সিকিমে বায়োডায়ভারসিটি কনজারভেশন অ্যান্ড ফরেন্স ম্যানেজমেন্ট প্রোজেক্ট, ত্রিপুরায় সাসটেনেবল ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট প্রোজেক্ট, মিজোরামে টেকনিক্যাল কোঅপারেশন প্রোজেক্ট ফর সাসটেনেবল এগ্রিকালচার অ্যান্ড ইরিগেশন এবং নাগাল্যান্ডে ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট প্রোজেক্ট। ভারতের "অ্যাক্ট ইস্ট" নীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেহেতু সংযোগ, তাই নয়াদিল্লি উত্তর-পূর্বে পরিকাঠামোর উন্নয়নে বেশি জোর দিচ্ছে । জাপানের মুক্ত এবং অবাধ "ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি"-রও মূলে রয়েছে এই সংযোগ। আর তাই এটি পূর্ব আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর ও জাপান পর্যন্ত বিস্তৃত ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকায় পণ্য ও পরিষেবার বিঘ্নহীন চলাচলের উপর গুরুত্ব দিচ্ছে। এখন, যেহেতু ভারতের উত্তর-পূর্বাংশকে টোকিওর "ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’র অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে দেখা হচ্ছে, তাই জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (JICA) ওভারসিজ ডেভলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স (ODA) ঋণ হিসাবে 25,483 মিলিয়ন ইয়েন (প্রায় 1570 কোটি টাকা) ব্যয় করবে ভারতের দীর্ঘতম সেতু নির্মাণে। 19.3 কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুর অবস্থান অসমের ব্রহ্মপুত্র নদের উপর৷ এটি ব্রহ্মপুত্রের উত্তরে অসমের ধুবড়ি থেকে দক্ষিণে মেঘালয়ের ফুলবাড়ি পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সেতু পড়ছে নর্থইস্ট রোড নেটওয়ার্ক কানেক্টিভিটি ইমপ্রুভমেন্ট প্রোজেক্টের আওতায়৷ যা জাপানের অংশীদারিত্বেই রূপায়িত হচ্ছে।
ভাটিয়ার মতে, দু’দেশের মানুষের মধে্য সম্পর্ক বাড়াতে "সফট পাওয়ার"-এরও ব্যবহার হচ্ছে। জাপানি পর্যটকরা উত্তর-পূর্বের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বৌদ্ধ ধর্মীয়স্থান এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ধ্বংসাবশেষের প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হয়ে এদেশে আসছেন। সম্প্রতি জাপানের বিখ্যাত ফুল, চেরি ব্লসমও মেঘালয়ে ফুটতে শুরু করেছে। ভাটিয়া জানিয়েছেন, 2006-07 সালে আবে যখন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনিই প্রথম ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন। জাপান, আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ভারতও একটি চতুর্দেশীয় শক্তি বা "কোয়াড"-এর অংশ৷ যারা ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকায় চিনের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য সত্ত্বেও সেখানে শান্তি, উন্নয়ন এবং সংযোগ বজায় রাখার কাজে নিয়োজিত।
ভাটিয়া বলেছেন, "বৃহত্তর ক্ষেত্রে ভারত-জাপান সহযোগিতার সম্পর্কে উদে্যাগী হওয়ার জন্য শিনজো আবেকে সকলেই মনে রাখবেন।"