হায়দরাবাদ : অঞ্চলভিত্তিক অধিকারকে কেন্দ্র করে একাধিক জটিল এবং বিতর্কিত বিষয়ের জেরে ভারত এবং চিনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে সমস্যা তৈরি হয়েছে । রয়েছে চাপা দ্বন্দ্বও । চার হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ LoAC, লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর এলাকায় তৈরি হওয়া সমস্যা সেই দ্বন্দ্ব আরও বাড়িয়ে তুলেছে । স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বর্তমানে বিতর্কিত LoAC এলাকায় সেনার সংখ্যা অনেকটাই বেশি এবং বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমের দাবি, পূর্ব লাদাখসহ গালওয়ান নালা এলাকায় এবং পানগং লেকের উত্তর দিকে অন্তত পাঁচটি এলাকায় 1200 থেকে 1500 PLA সেনা প্রায় চোখে চোখ রেখে মুখোমুখি প্রত্যাঘ্যাত করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে । যদিও এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে, বিষয়টি নিয়ে বিনয় দেখিয়েছে ভারত এবং চিন উভয়ই । কোনও দেশই এনিয়ে সরকারিভাবে এমন কোনও বিবৃতি দেয়নি, যাকে উত্তেজক বলা যায় । কিন্তু এই দূরদর্শিতা এবং সংযম কী এই অশান্তি ধীরে ধীরে প্রশমিত হওয়া পর্যন্ত স্থায়ী হবে ?
এই রাজনৈতিক এবং সামরিক বিবাদের জেরে বেজিংও ঘোষণা করেছে যে, তারা আগামী সপ্তাহ অর্থাৎ জুনের গোড়ায় ভারত থেকে সেইসব চিনা নাগরিককে উদ্ধার করে নিয়ে যাবেন, যাঁরা COVID 19 এবং লকডাউনের জেরে এতদিন আটকে রয়েছেন । এই ঘোষণাকে চিনের একতরফা নীতি হিসেবেই দেখা হচ্ছে। কারণ এই পদক্ষেপ গৃহীত হচ্ছে ভারতে থাকা মাত্র কয়েক হাজার চিনা নাগরিকের জন্য। যেখানে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে এক লাখের বেশি চিনা নাগরিক আটকে রয়েছেন । এইভাবে বিশ্বের দুই বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের (জনসংখ্যার বিচারে) দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে বিবাদ এবং অনৈক্যের ছবিটা প্রাথমিক পর্যালোচনাতেই স্পষ্ট । এর ফলে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে তাতে ভবিষ্যতে অনুরূপ আরও ঘটনা ঘটতে পারে ।
ভারত এবং চিন স্বাধীনতা অর্জন করেছিল যথাক্রমে 1947 এবং 1949 সালে । ইতিহাসে এই দুই দেশই প্রাচীন সভ্যতা হিসেবে চিহ্নিত । যারা সেই সময়ে রাজত্ব করেছিল । তবে বর্তমানে দুই দেশই তুলনামূলকভাবে নবীন ও আধুনিক । ঔপনিবেশিক শাসনের জেরে ঊনবিংশ শতকে এই দুই দেশের মানচিত্রে বিভাজন হয় । ফলে ঔপনিবেশিক আধিপত্যের অঙ্গ হিসেবে দুই দেশের যে সীমান্ত ছিল, তা অধরা থাকবে বলে ভারত এবং চিন উভয় দেশই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ।
অঞ্চলভিত্তিক অধিকারের জটিলতার জেরে উভয় দেশই 1962 সালের অক্টোবর মাসে অল্প সময়ের জন্য যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে । কিন্তু তাতে তাদের সমস্যার কোনও নিষ্পত্তি হয়নি এবং এর অন্তত সাত দশক পরও সম্পর্কে সেই অস্বস্তি চলছে । বর্তমানে অবশ্য দুই দেশেরই LoAC বা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা রয়েছে যা আদতে ধারণাগত এবং একটি দাবি রেখা (ক্লেম লাইন) হয়ে গেছে । যা চিহ্নিত করে সেই সীমা, যতটা পর্যন্ত সেনাবাহিনী টহলদারি চালাতে পারে । আর রয়েছে একটি CCL অর্থাৎ চাইনিজ় ক্লেম লাইন এবং তার ভারতীয় সংস্করণ । তবে সেখানে বিবাদের চূড়ান্ত রাজনৈতিক নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দু’দেশের জন্যই LoAC-র পিছনে নিজস্ব দাবি থাকাটা সমীচিন । সেখানেই বাস্তবটা এর থেকে অনেকটা আলাদা ।
LoAC বরাবর এলাকায় সেনাবাহিনীর টহলদারি অতীতে বহু উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করেছে । কিন্তু দু’দেশেরই উদ্যোগে রাজীব গান্ধির সময়কালে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং পরে প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও (1993)-এর আমলে তা বাস্তবায়িত হয় । সেই অনুসারে LoAC সংলগ্ন এলাকায় দু’দেশের তরফে পর্যাপ্ত সেনা নিয়োগ সত্ত্বেও গত প্রায় 25 বছরেরও বেশি সময় ধরে রাগের মাথায় কেউ একটিও গুলি ছেড়েনি । যদিও LoAC সংলগ্ন এলাকায় বিগত দশকে সামরিক উত্তেজনার তিনটি বড় ঘটনা ঘটেছিল দেপসাং (2013), চুমার (2014) এবং ডোকলাম (2017)-এ । যার নিষ্পত্তি পরে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পথে করা হয় ।
ভারতে বর্তমানে যে ধরনের ঘটনা ঘটছে, তা অনুসারে দাবি উঠেছে যে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে লাদাখের LoAC সংলগ্ন এলাকায় PLA সেনাবাহিনী নিজেদের গতিবিধির পরিবর্তন ঘটিয়ে আক্রমণাত্মকভাবে টহলদারি শুরু করে, যা অনেক পরে নজরে আসে । এটা কী কার্গিলের ছায়া ছিল? মে মাসের গোড়ায় এই PLA-র এই বহিরাক্রমণ বা সীমা লঙ্ঘন পরে অন্যান্য স্থানেও ছড়িয়ে পড়ে । এবং PLA-র সংখ্যা বেড়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি হয়ে যায় । ভারতের তরফে এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পদক্ষেপ করা হয় অর্থাৎ PLA-র সীমা লঙ্ঘনের ঘটনার অনুরূপ প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয় ভারতীয় সেনার তরফেও । পরিস্থিতি খারাপ হয় ।