হায়দরাবাদ, 6 ডিসেম্বর : তেলেঙ্গানা গণধর্ষণ কাণ্ডে শিউরে উঠেছে গোটা দেশ ৷ গণধর্ষণের পর জ্বালিয়ে দেওয়া হয় নির্যাতিতাকে ৷ ঘটনার 9 দিনের মাথায় ভোরটা ছিল একেবারেই অন্যরকম ৷ পুলিশ এনকাউন্টারে মৃত্যু হয় ধর্ষণে অভিযুক্ত চার ব্যক্তি ৷ বেশিরভাগই এই খবরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও মিশ্র প্রতিক্রিয়াও এসেছে কোনও কোনও তরফে ৷
এক নজরে দেখে নেওয়া যাক হায়দরাবাদ গণধর্ষণের ঘটনা পরম্পরা ৷
27 নভেম্বর: হায়দরাবাদের কাছে শামশাবাদ টোল প্লাজার কাছেই নিখোঁজ হন বছর ছাব্বিশের পশু চিকিৎসক ৷ গণধর্ষণের পর তাঁকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে, খবর আসে এমনটাই ৷ নির্মীয়মাণ একটি সেতুর কাছে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় নির্যাতিতার দেহ ৷
সন্ধ্যা 6.15 মিনিট নাগাদ দু চাকার যানটি খারাপ হয়ে যাওয়ায় সেটি পার্ক করে ক্যাব নিয়ে গাছিবোলি যান যুবতি ৷ রাত 9টা নাগাদ ফিরে এসে দেখেন টায়ারটি ফ্ল্যাট ৷ রাত 9.22 মিনিটে শেষবারের মতো বোনের সঙ্গে কথা হয়েছিল যুবতির ৷ জানিয়েছিলেন, তিনি ভয় পেয়েছেন কোনও কারণে ৷
28 নভেম্বর : যুবতির দেহ উদ্ধার করে পুলিশ ৷ ঘটনার প্রতিবাদে উত্তাল হয় সারা দেশে ৷ একই সময়ে পর পর আরও বেশ কয়েকটি ঘটনায় সরব হন প্রত্যেক সংবেদনশীল নাগরিক ৷ দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয় ৷
29 নভেম্বর: চার অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে বিচারবিভাগীয় হেপাজতে পাঠানো হয় ৷ চেরলাপল্লি সেন্ট্রাল জেলে হাই-সিকিউরিটি সেলে রাখা হয় অভিযুক্তদের ৷ ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী খুন (302), ধর্ষণ (375) ও অপহরণের মামলা (362) রুজু হয় ৷
30 নভেম্বর : অভিযুক্তদের চেরলাপল্লি সেন্ট্রাল জেল থেকে চঞ্চলগুড়া সেন্ট্রাল জেলে স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ৷ স্থানান্তরিত করার পূর্বে অভিযুক্তদের কিছু সময়ের জন্য শাদনগর থানায় রাখা হয় ৷ তখনই শাদনগর থানার বাইরে জড়ো হয় বিক্ষুব্ধ জনতা ৷ পুলিশের তরফে অভিযুক্তদের শাস্তির আশ্বাস দেওয়া হয় ৷ এরপরেও প্রতিবাদরত জনতা শান্ত না হলে তাদের সড়ানোর জন্য লাঠিচার্জ করে পুলিশ ৷ এরই মাঝে জাতীয় মহিলা কমিশনের কাছে পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছে নির্যাতিতার পরিবার ৷ যে গুরুত্বপূর্ণ সময়টা নির্যাতিতার প্রাণ বাঁচাতে ব্যবহার করা যেত তা হেলায় নষ্ট করেছে পুলিশ ৷ এমনই অভিযোগ আনা হয় নির্যাতিতার পরিবারের তরফে ৷
1 ডিসেম্বর : নির্যাতিতার যে এলাকায় থাকত, সেই কলোলির গেটে তালা পড়ে ৷ "সংবাদ মাধ্যম, পুলিশ ও বহিরাগতদের প্রবেশ নিষেধ"," কোনও সহানুভুতি নয়, শুধু ন্যায়বিচার চাই" এরকমই প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয় কলোনির গেটে ৷ নির্যাতিতার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে আসা রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে একাধিক চিত্রতারকাকে কলোনি থেকে বের করে দেন এলাকার বাসিন্দারা ৷ তেলাঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে মামলাটি তোলার কথা বলেন ৷ একইসঙ্গে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইনকে আরও কঠোর করার জন্য ভারতীয় দণ্ডবিধিতে পরিবর্তন আনার কথাও বলেন তিনি ৷
2 ডিসেম্বর: হায়দরাবাদ কাণ্ডের প্রতিবাদে মুখ হন সাংসদরা ৷ অভিযুক্তদের প্রকাশ্যে গণপিটুনি দিয়ে মারা থেকে শুরু করে ফাঁসি, নির্বীজকরণ সহ একাধিক মত নিয়ে সরব হন তারা ৷ সমাজবাদী দলের সাংসদ জয়া বচ্চন বলেন, "অভিযুক্তদের প্রকাশ্যে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা উচিত ৷" কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজনাথ সিং এই ধরণের ঘৃণ্য অপরাধ দমনের জন্য আলোচনায় বসার কথাও বলেন ৷
4 ডিসেম্বর: তেলাঙ্গানা সরকার মামলাটির জন্য বিশেষ ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট গঠন করে ৷ নির্যাতিতার নিখোঁজ হওয়ার FIR দেরিতে নথিভুক্ত করার জন্য তিন পুলিশ আধিকারিককে বরখাস্তও করা হয় ৷
6 ডিসেম্বর : পুলিশি এনকাউন্টারে নিহত হয় ধর্ষণ করে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় চার অভিযুক্ত ৷ হায়দরাবাদ পুলিশ প্রধান জানিয়েছেন, অভিযুক্তদের ঘটনাস্থানে নিয়ে গিয়ে অপরাধের পুনর্নিমাণের চেষ্টা করা হচ্ছিল ৷ তখনই অভিযুক্তরা পুলিশের উপর হামলা করে এবং বন্দুক কেড়ে নেয় ৷ পুলিশের দিকে লক্ষ করে গুলি চালানোও শুরু করে বলে জানান তিনি ৷ পুলিশ বারবার তাদের আত্মসমর্পণ করার কথা বলতে থাকলেও তারা গুলি চালাতে থাকে ৷ এরপরেই পুলিশ আত্মরক্ষার জন্য গুলি করে অভিযুক্তদের ৷
এদিকে আজকের হায়দরাবাদ পুলিশের এনকাউন্টারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া এসেছে বিভিন্ন মহল থেকে ৷ সমাজবাদী পার্টির সাংসদ জয়া বচ্চন ঘটনার সমর্থন করে বলেছেন, " কাজটি অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল ৷ দেরিতে হলেও সঠিক কাজ হয়েছে ৷ " কংগ্রেসের মুখপাত্র সঞ্জয় ঝাঁ থেকে শুরু করে BSP প্রধান মায়াবতী সহ একাধিক ব্যক্তিত্ব প্রশংসা করেন হায়দরাবাদ পুলিশের ৷ মায়াবতী বলেন, "কীভাবে দোষীদের শাস্তি দেওয়া উচিত শিখুক উত্তরপ্রদেশ পুলিশ" ৷
এনকাউন্টারের পক্ষে সওয়াল করেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়ালও ৷ বিচার ব্যবস্থার উপর থেকে আস্থা হারিয়েছেন বলেও জানান তিনি ৷ মধ্য প্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান ঘটনা প্রসঙ্গে বলেছেন, "গোটা দেশ আজ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে ৷ তারা (অভিযুক্তরা) যা করেছে তার শাস্তি পেয়েছে ৷"
আরও পড়ুন : কীভাবে দোষীদের শাস্তি দেওয়া উচিত শিখুক উত্তরপ্রদেশ পুলিশ : মায়াবতী
পুলিশি এনকাউন্টারের ভূয়সি প্রশংসা করেছেন BJP নেত্রী উমা ভারতীও ৷ তিনি টুইট করেন, 'নারী সুরক্ষার দিক থেকে এটি চলতি শতাব্দীর সবথেকে বড় পদক্ষেপ ৷ যে সকল পুলিশ আধিকারিকরা এই ঘটনায় যুক্ত ছিলেন তাদেরকে সম্মান জানাই ৷'
আরও পড়ুন : এনকাউন্টার : অন্তত সরকারি অতিথি হয়ে দুষ্কৃতীরা থাকবে না, মত স্বাতীর
অন্যদিকে হায়দরাবাদ পুলিশের এই ভূমিকাকে ইতিবাচক চোখে দেখছে না অভিযুক্তদের পরিবার ৷ অভিযুক্তদের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে খুন করেছে হায়দরাবাদ পুলিশ ৷ এমনই অভিযোগ উঠছে অভিযুক্তদের পরিবারের তরফে ৷ কংগ্রেস নেতা শশী তারুরও টুইটারে জানান, 'আমাদের আরও জানা উচিত ৷ বিস্তারিত না জেনে এখনই ঘটনার নিন্দা করা ঠিক নয় ৷ তবে আইনের বাইরে গিয়ে কিছু করা কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় ৷' এনকাউন্টারের প্রতিবাদে মুখ খুলেছেন মুখ খুলেছেন মানেকা গান্ধিও ৷ জাতীয় নারী কমিশনের প্রধান রেখা শর্মাও জানিয়েছেন অভিযুক্তরা মারা যাওয়ায় তিনি খুশি ৷ তবে ঘটনাটি আইনি প্রক্রিয়ায় হলে ভালো হত বলেও জানিয়েছেন রেখা শর্মা ৷