প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেশে প্রভাব বিস্তার করছে ৷ যখন বিভিন্ন রাজ্য প্রবল বর্ষণে ভুগছে, তখন বন্যা নিয়ন্ত্রণ করার কাজ খুবই জরুরি হয়ে ওঠে ৷ আর সরকারের উচিত এর জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা করা ৷
দেশকে একদিক থেকে আঘাত করেছে কোরোনা প্যানডেমিক ৷ আর অন্যদিক থেকে আঘাত হেনেছে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ৷ অসম, মহারাষ্ট্র, কেরালা এবং দিল্লি-সহ অন্য জায়গায় ভারী বৃষ্টিপাত ও বন্যার প্রকোপ দেখা দিচ্ছে ৷ ভারী বৃষ্টির ব্যাপক প্রভাব গত মাসে পড়েছিল অসমের উপর ৷ মুম্বই, যে শহর দেশের অর্থনৈতিক রাজধানী, সেখানে এই মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে ৷ এর ফলে নিচু এলাকাগুলিতে যানবাহন ও নাগরিক জীবন একেবারে থেমে গিয়েছিল ৷ 24 ঘণ্টার মধ্যে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল 200 মিলি মিটার ৷ যা গত 15 বছরের মধ্যে সর্বাধিক ৷ এই মাসের 8 তারিখ কেরালার ইদুক্কি জেলায় ভারী বৃষ্টিপাত হয় ৷ তার জেরে ঘটে ভূমি ধসের ঘটনা ৷ ওই ভূমি ধসে চাপা পড়ে যায় চা-বাগানের শ্রমিকদের বাড়ি ৷ তাতে মৃত্যু হয় বেশ কয়েকজনের ৷ বর্ষার সময় দেশের বিভিন্ন অংশে সম্পত্তির ক্ষতি হয়েছে এবং প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে ৷ তার পরও বন্যা ও ক্ষতি আটকাতে কোনওরকম আগাম ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি ৷ এটাই সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় ৷
একটি বার্ষিক রীতি!
অতীতে বন্যা সংক্রান্ত বিপর্যয় মোকাবিলার সমস্ত নজর থাকত গ্রামের উপর ৷ নদীর জল উপচে উঠলে শহর ও নগর এবং গ্রামের মধ্যে ক্ষতির প্রকৃতি একেবারে ভিন্ন রকম হয় ৷ দ্রুত নগরায়ণ এবং পরিকল্পনাহীন ও অবৈধ কাঠামো তৈরি করার জন্য বৃষ্টির জলের স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ হচ্ছে ৷ আর বৃষ্টির জল জমিয়ে রাখার প্রবণতা কমে যাচ্ছে ৷ এর ফলে যখন কোনও জায়গায় বৃষ্টি হচ্ছে বা মেঘ ভেঙে বৃষ্টি হচ্ছে, তখন বন্যা আটগুণ বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে ৷ এর ফলে জলের বৃদ্ধির পরিমাণ ছয় গুণ বেশি হচ্ছে ৷ আর নিচু এলাকাগুলি অনেকদিন ধরে জল জমে আটকে থাকছে ৷ মুম্বই, কেরালা ও দিল্লিতে সাম্প্রতিক বন্যার কারণ এইগুলিই ৷ শহর এলাকায় বন্যার ফলে সংক্রামক রোগ বৃদ্ধি পেতে পারে ৷ এটাই বর্তমানের উদ্বেগের বিষয় ৷ অসমে সাম্প্রতিক বন্যার জেরে জলে হাসপাতালের বর্জ্য, ফেলে দেওয়া PPE কিট, কোভিড কেয়ার সেন্টারের বর্জ্য ভাসতে দেখা গিয়েছে ৷ এর ফলে জল জমা এলাকাগুলিতে আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল ৷ মেট্রোপলিটন এলাকা ও শহরে বন্যার মূল কারণ হল বহু পুরনো নিকাশি ব্যবস্থা এবং খারাপ রক্ষণাবেক্ষণ ৷ নিকাশি নালা পরিষ্কার না করা এবং বর্জ্য ও অন্যান্য আবর্জনা জমে যাওয়ার ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই বন্যার পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যায় ৷ শহরে বন্যার আরও একটা বড় কারণ হল অবাধ নির্মাণ কাজ৷ এই ধরনের অবৈধ কাঠামোগুলিই দেশের প্রতিটি শহর ও নগরে বৃষ্টির জলের স্বাভাবিক প্রবাহমানতার কাছে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ৷ অবৈধ নির্মাণ কাজ, শহরের পুকুর ও জলাশয় দখল করে তা ভরাট করা, অকার্যকর নিকাশি ব্যবস্থাই নগরায়ণের খারাপ দিক হিসেবে সামনে আসছে ৷ এর ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে ৷ প্রতি বছর বন্যা এড়িয়ে যাওয়া কার্যত সম্ভব হচ্ছে না ৷ তাই বন্যার হাত থেকে বাঁচতে গেলে নিকাশি ও বন্যার জল যাওয়ার জন্য তৈরি করা ক্যানেলগুলির দখলদারি কমাতে হবে ৷ প্রতি বছর বর্ষার আগে নিকাশি নালাগুলিকে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিষ্কার করতে হবে এবং নালা আটকে যাওয়া ঠেকাতে হবে ৷
নিকাশি ব্যবস্থাকে আরও ভালো করতে হবে
বন্যার জলের পরিমাণ গণনা করে বন্যার ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ৷ প্রতি বছর বর্ষার সময় কতটা জল প্রবাহিত হয়, উপগ্রহ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তা নির্ণয় করা সম্ভব ৷ তার পর সেই তথ্যকে বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে যে নিকাশি ও বন্যার জল বের করার ব্যবস্থার উপর তার কতটা প্রভাব পড়তে পারে ৷ বর্ষার জল জমিতে জমিয়ে রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করতে না পারলে এই প্রচেষ্টা সফল হবে না ৷ যদি আমরা বৃষ্টির জলের প্রতিটি ফোঁটা সঞ্চয় করতে পারি এবং তা যদি জমির ভিতরে পাঠিয়ে দিতে পারি ৷ তাহলে বন্যাও থামানো যাবে ৷ আবার ভূগর্ভের জলস্তর বৃদ্ধি করা যাবে ৷ এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে প্রতি বছর বন্যার সমস্যা তৈরি হলেও তা নিয়ন্ত্রণ করতে আমরা কোনও কার্যকরী পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করতে পারিনি ৷ কয়েক হাজার বছর আগে হরপ্পা সভ্যতার সময় যে ধরনের পরিকল্পিত নিকাশি ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছিল, তার থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত ৷ নিকাশি ব্যবস্থা ও বন্যার জল নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলি যে সেরা পদ্ধতি ও অভ্যাস তৈরি করেছে, সেগুলি এখানকার পরিস্থিতি অনুযায়ী কার্যকরী ভাবে প্রয়োগ করতে হবে ৷ শহর ও নগরের জনসংখ্যা এবং ভৌগোলিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে নিকাশি ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ করতে হবে ৷ এর সঙ্গে পুকুর ও জলাশয় ভরাট করা এবং যেখানে সেখানে যেমন খুশি মাটি খোঁড়ার কাজকে বন্ধ করে দিতে হবে ৷ একমাত্র তখনই শহর ও নগরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে ৷ আর মানুষের জীবনযাত্রার মান আরও স্বচ্ছন্দ করা যাবে ৷