ভারত ও চিনের সাম্প্রতিক সংঘাত আমদানি বিকল্পের প্রশ্নটিকে তুলে এনেছে । অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো সাধারণত নির্ভর করে একে অন্যের থেকে পণ্য বা পরিষেবা কেনা বা না কেনার ক্ষেত্রে সুবিধার উপর। ব্যবসা চলে সর্বোচ্চ লাভের ভিত্তিতে এবং তারপর অন্যান্য বিষয়গুলি বিবেচনায় আসে । তাই প্রতিটি ব্যবসার ক্ষেত্রে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্নটা আমাদের মনে আসে, তা হল- যদি চিনের কাছ থেকে জিনিস কেনা বন্ধ করতেই হবে তাহলে কীভাবে আমরা সেই জিনিসগুলো পাব এবং তার তুলনামুলক সুবিধা ও অসুবিধাই বা কী হবে ? আসল কথাটা হল যে চিন হল বিশ্বে সর্বনিম্ন মূল্যের উৎপাদক। তার অর্থ, যদি ভারতের চিনা পণ্যের আসক্তি দূর করতে হয় তাহলে তাকে সর্বনিম্ন মূল্যের উৎপাদকে পরিণত হতে হবে । আর এখানেই প্রশ্ন আসে, কীভাবে ভারত সর্বনিম্ন মূল্যের উৎপাদকে পরিণত হতে পারে ? সাধারণভাবে উৎপাদনের খরচ বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে, যার মধ্যে রয়েছে শ্রম (অথবা উৎপাদনশীলতা) দ্বারা তৈরি প্রতিটি ইউনিটের মূল্য, মাত্রার অর্থনীতি, পরিবহন খরচ, পুঁজি, সাংগঠনিক দক্ষতা এবং অন্তত নীতিগত সমর্থন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই সমস্ত মানদণ্ডেই ভারতের জায়গাটা দুর্বল। মূলগত এবং কাঠামোগত বিষয়গুলোতে মনোযোগ দেওয়ার বদলে শ্রম আইন আর জমির দামকেই দোষ দেওয়াটা এখন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে।
এখনও পর্যন্ত আমদানির ছবিটা
বর্তমানে যেমন চলছে, সে ধরনের সংকট সামলাতে কোনও দেশের দক্ষতা নির্ভর করে রফতানি করা পণ্যে ভ্যালু অ্যাডিশন এবং ভ্যালু চেনের শীর্ষে যাওয়ার জন্য লাগাতার সৃষ্টিশীল প্রয়াস। ভারতের পক্ষে চ্যালেঞ্জ হল তার বর্তমান অবস্থান থেকে সরে যাওয়া, যেখানে সে এমন একটা দেশ যারা গুরুত্বপূর্ণ দামি জিনিস আমদানি করে এবং কাঁচামাল ও কিছটা সম্পূর্ণ পণ্য রফতানি করে। বেশিরভাগ পণ্যের উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ার কারণে ভারত হাই-ভ্যালু সামগ্রী কম দামে রফতানি করতে অক্ষম। তার বিপরীতে, ভারত কয়েকটি প্রতিযোগিতামূলক সুবিধার কারণে পরিষেবা রফতানি করে। যদিও দীর্ঘমেয়াদীভাবে পরিষেবাক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক থাকতে গেলে, সুবিধাগুলোকে আরও উন্নত করতে হবে। এটা সবথেকে প্রকটভাবে চোখে পড়ছে ভারত-চিন বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। গত পাঁচ বছরে চিন থেকে ভারতের সবথেকে বেশি আমদানির পরিমাণ 336 বিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রতি বছরে 60 থেকে 74 বিলিয়ন ডলার পরিবর্তন হয়েছে)। এটা দেশের সার্বিক বার্ষিক আমদানির 12-14 শতাংশ। এর বিপরীতে, ভারত থেকে চিনের আমদানি হল, সেদেশের মোট আমদানির মাত্র 1 শতাংশ। 2019 সালে অধিকাংশ আমদানি হয়েছে বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম (19.9 বিলিয়ন ডলার), মেশিনের যন্ত্রাংশ (13.87 বিলিয়ন ডলার), ওষুধ শিল্পে ব্যবহৃত জৈব রাসায়নিক (8.23 বিলিয়ন ডলার), প্লাস্টিকের সামগ্রী (2.82 বিলিয়ন ডলার), সার (2.08 বিলিয়ন ডলার) লৌহ-ইস্পাত সম্পর্কিত জিনিস (1.69 বিলিয়ন ডলার), অপটিক্যাল সম্পর্কিত (1.46 বিলিয়ন ডলার), গাড়ি সম্পর্কিত (1.28 বিলিয়ন ডলার)। 2019 সালে চিনে ভারতের রফতানি ছিল 17.28 বিলিয়ন ডলারের, যা মোট রফতানির প্রায় 5 শতাংশ। এর মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল জৈব রাসায়নিক (3.11 বিলিয়ন ডলার), খনিজ সম্পর্কিত (2.14 বিলিয়ন ডলার), মৎস্যজাত পণ্য (1.37 বিলিয়ন ডলার), তুলো (1.04 বিলিয়ন ডলার) এবং অন্যান্য নানা সামগ্রী এবং নুনজাত পণ্য, কফি, চা, রঙ, প্রাণীজ নির্যাস ইত্যাদি অসম্পূর্ণ দ্রব্য। এভাবেই ভারত যা আমদানি করে, তা হাই-ভ্যালু সামগ্রী অথবা যাদের সহজ বিকল্প নেই, যেখানে তারা রফতানি করে এমন পণ্য বা অসম্পূর্ণ সামগ্রী, যার বিকল্প উৎস আছে। তাই ভারতের সমস্যাটা হল যে আমাদের পণ্য যথেষ্ট প্রতিযোগিতামূলক অথবা তাতে ভ্যালু অ্যাডিশন আছে কি না।
চড়া খরচের অর্থনীতির একটা কারণ হল এই যে আমাদের রফতানিতে তেমন ভ্যালু অ্যাডিশন নেই। আমাদের অর্থনৈতিক মডেল অনুযায়ী, অর্থনীতি গড়ে তোলা হয়েছে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রের জন্য, রফতানিকে মাথায় রেখে নয়। এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। যদিও আমরা খুশি এই ভাবে যে দেশে আরও প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আসছে, কিন্তু এটা ঘটছে তার কারণ ওয়ালমার্টের মতো বিরাট সংস্থা ফ্লিপকার্ট কিনছে, আমাজন বিনিয়োগ করছে, বা রিয়ালেন্স জিওতে বিদেশিরা লগ্নি করছেন। সমস্যা যেখানে, যে এগুলোর বেশিরভাগেরই লক্ষ্য ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজার, বিশ্বে প্রতিযোগিতামূলক রফতানির সুবিধা তৈরি নয়। দ্বিতীয়ত, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র আওতায় সাম্প্রতিক এফডিআইয়ের একটা বিরাট অংশই হয় লো-ভ্যালু অ্যাডিশন অথবা স্থানীয় বাজার ধরার লক্ষ্যে তৈরি। আসলে ভ্যালু চেন জুড়ে উৎপাদনের বদলে, বেশিরভাগ এফডিআই হচ্ছে জিনিসপত্র অ্যাসেম্বল করার ইউনিট: এমনকী মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রেও ভারতে যে ভ্যালু অ্যাডিশন হয়, তা পণ্যের মাত্র 15 শতাংশ।