লিপস্টিক । বর্তমানে মেয়েদের এই প্রসাধনী সামগ্রী একটি ফ্যাশন স্টেটমেন্টে পরিণত হয়েছে । তবে এই প্রসাধনীর পিছনেও রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস । রয়েছে নানা সামাজিক রীতি-নীতি, আভিজাত্য প্রদর্শনের কাহিনি । কখনও রং বেরঙের পতঙ্গ পিষে তৈরি হয়েছে ঠোঁটে মাখার রং । কখনও আবার দামি রত্নকে চূর্ণ করে তাতে রং মিশিয়ে মাখা হয়েছে । এই লিপস্টিককে একসময় মনে করা হত পতিতাদের প্রতীক । যা আবার পরে উচ্চবংশের মেয়েদের পরিচিতি হয়ে দাঁড়ায় ।
লিপস্টিকের অবয়ব
সাধারণত মোম, রঙ, রাসায়নিক দ্রব্য ও তেল দিয়ে তৈরি হয় লিপস্টিক । একটি লিপস্টিকের ডায়ামিটার 10 মিলিমিটার । 50 মিলিমিটার দীর্ঘ হয় এটি ।
সুমেরিয় সভ্যতা ও লিপস্টিকের অস্তিত্ব
অতীতে মানুষজন ছবিতে নানা ধরনের রং ব্যবহার করত । কখনও কখনও সুন্দর দেখার জন্য সেই রঙ নিজেদের শরীরে মাখত । রং মেখে নিজেদের নানাভাবে সাজাত তখনকার মেয়েরা । ইতিহাসের নানা গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে সেই অনুয়ায়ী আজ থেকে 5,000 বছর আগে সুমেরিয় সভ্যতাতেও লিপস্টিকের অস্তিত্ব ছিল । তখন নানা পাথর ভেঙে বা রত্নচূর্ণ করে তাতে রং মাখিয়ে ঠোঁটে লাগাত মেয়েরা । ইতিহাসে বলছে, রানি ক্লিওপেট্রা না কি নানা ধরনের রঙিন ছোটো-ছোটো পতঙ্গ সংগ্রহ করতেন এবং তা পিষে লাল রঙ বের করতেন । পরে সেই রং ঠোঁটে লাগাতেন । পরের দিকে অ্যালজিন, আয়োডিন ও ব্রোমিনের মিশ্রণে লাল রং তৈরি করেও ব্যবহার করা হত ।
নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে লিপস্টিকের পথচলা
খ্রীস্টপূর্বাব্দ 200-250 । মিশরীয় সভ্যতার মানুষজন প্রথমের দিকে লিপস্টিককে পতিতাদের চিহ্ন বলে মনে করত । পরের দিকে সেই ধারণায় বদল আসে । 700 খ্রীস্টপূর্বাব্দে উচ্চ শ্রেণীর মহিলারা নিজেদের ঠোঁটে লাল রং লাগাতেন । সেইসময় ঠোঁটে রং দেওয়াটা ছিল আভিজাত্যের পরিচয় ।
উনিশ শতকের শেষের দিকে বাজারে আসে লিপস্টিক আজ থেকে হাজার বছর আগে চিনের মহিলারাও ফুলের রং দিয়ে ঠোঁটে রং করতেন । তখন একরকম রীতি ছিল এটি । পরের দিকে অস্ট্রেলিয়ায় লিপস্টিককে নিয়ে একটি কুসংস্কার তৈরি হয় । সেখানকার মহিলারা বিশ্বাস করতেন, ঠোটে রং মাখলে না কি খারাপ শক্তির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় । কিন্তু তখনও লিপস্টিক নামক এই আধুনিক দ্রব্যের প্রচলন হয়নি ।
উনিশ শতক ও বাণিজ্যিকভাবে লিপস্টিকের আত্মপ্রকাশ
রানি এলিজাবেথের সময় লিপস্টিক নামক দ্রব্যটির পথচলা শুরু । কুসংস্কার, আভিজাত্যের সমস্ত বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে লিপস্টিক তখন শুধুমাত্র সৌন্দর্যের প্রতীক । তবে তা শুধু উচ্চবংশের মেয়ে ও অভিনেত্রীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল । লিপস্টিকের রং বলতে জনপ্রিয় ছিল কালচে লাল । 1880 সালে প্রথমবার লিপস্টিক নামক শব্দটি ব্যবহার করা হয় । 1884 সাল । প্যারিসের একটি সুগন্ধি প্রস্তুতকারক সংস্থা বাজারে প্রথমবার লিপস্টিক আনে ।
বিংশ শতক
1915 সাল । প্রথমবার ধাতব টিউবে লিপস্টিক তৈরি করে বাজারে আনা হয় । তিরিশের দশক থেকেই অ্যামেরিকার বাজারগুলিতে লিপস্টিকের বিক্রি শুরু হয়ে যায় । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ধাতব টিউবের জায়গায় আসে প্লাস্টিক টিউব । ব্যাপক জনপ্রিয় হয় এই লিপস্টিক । হলিউডের লাস্যময়ী অভিনেত্রীদের ঠোঁটে জায়গা করে নেয় লিপস্টিক । এলিজাবেথ টেলর, মারলিন মনোরে । ধীরে ফ্যাশন স্টেটমেন্ট হয়ে দাঁড়ায় লিপস্টিক ।
1950 সালে হ্যাজেল বিশপ নামে এক কম্পানি লিপস্টিককে বিশ্ববাজারে পরিচিতি দেয় । এরপর সত্তর ও নব্বইয়ের দশকে গাঢ় খয়েরি ও কালো শেডের লিপস্টিক জনপ্রিয়তা পায় । তারপর বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা । 2000 সালের আশপাশে ত্বকের PH -এর মাত্রা বজায় রেখে তৈরি হয়েছে লিপস্টিক । 2010-র পর হুডা বিউটি, NYX কসমেটিকস নিয়ে আসে লিকুইড লিপস্টিক । যা এখনও অন্যতম ফ্যাশন স্টেটমেন্ট ।