জীবনে সকলেই ভবিষ্যতের কথা ভেবে অর্থ সঞ্চয় করেন এবং এই কাজে নিজের সেরা শক্তি ও বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করেন । আমাদের সমাজে যেখানে ছোটোবেলা থেকেই পকেট মানি বাঁচিয়ে মাটির তৈরি লক্ষ্মীর ভাঁড় কিংবা পিগি ব্যাঙ্কে টাকা জমানোর পাঠ দেওয়া হয় সেখানে সাধারণ ব্যাঙ্কগুলি জনসাধারণের চোখে আস্থা এবং বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতিমূর্তি । একটু বেশি সুদের মোহে ও ব্যাঙ্ক তো ব্যাঙ্কই হয়— সেই বিশ্বাসে ভর করে লাখ লাখ মানুষ তাঁদের কষ্টার্জিত অর্থ সমবায় ব্যাঙ্কগুলিতে জমা রাখেন । কিন্তু পঞ্জাব-মহারাষ্ট্র কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের (PMC) সাম্প্রতিক কেলেঙ্কারি ব্যাঙ্ক নামক মিথের সত্যতা প্রকাশ্যে এনেছে । একইসঙ্গে ব্যাঙ্ক নিয়ন্ত্রণ তথা নজরদারি সংগঠন যেমন RBI-এর নিষ্ক্রিয়তাও তুলে ধরেছে । যদিও এই ধরনের দুর্নীতির পুনরাবৃত্তি যে ভবিষ্যতে আর হবে না—সাম্প্রতিক বাজেটে সেই সংকল্প প্রতিফলিত হয়েছে । কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন জানিয়েছেন, সমবায় ব্যাঙ্কগুলি যাতে পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করে, যাতে সেগুলিতে বিনিয়োগের সুযোগ বাড়ে এবং যাতে RBI–র নজরদারিতে ব্যাঙ্কগুলি আরও ভালোভাবে কাজ করতে পারে তা সুনিশ্চিত করতে "ব্যাঙ্কিং রেগুলেশন অ্যাক্ট"-এ প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে । পাশাপাশি দেশের 1 হাজার 540টি সমবায় ব্যাঙ্কগুলির আওতায় থাকা 8.6 কোটিরও বেশি দেশীয় গ্রাহকদের স্বার্থের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে RBI-এর হাতে ব্যাঙ্কগুলির নজরদারি তুলে দেওয়ার মতো জরুরি আইন পাসে ইতিমধ্যেই সবুজ সংকেত দিয়েছে মোদি সরকারও । অতীতে সমবায় রেজিস্ট্রার এই সমবায় ব্যাঙ্কগুলির মালিকানা সংক্রান্ত দিকগুলি দেখাশোনা করতেন । যত দিন যাচ্ছে, সমবায় ব্যাঙ্কগুলি RBI–র তরফে জারি হওয়া নির্দেশিকা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে । বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের মতোই সমবায় ব্যাঙ্কগুলির ক্ষেত্রেও চিফ এগজ়িকিউটিভ অফিসার (CEO) নিয়োগ করার ক্ষেত্রে RBI-র অনুমোদন বাধ্যতামূলক । RBI-র নির্দেশিকা মেনেই নিয়মিত অডিটও করা উচিত । দুর্বল সমবায় ব্যাঙ্কগুলিকে অধিগ্রহণ করার ক্ষেত্রে ক্ষমতা প্রদান করা হবে RBI-কে । তবে, সমবায় ব্যাঙ্কগুলির ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে এবং সমস্ত ধরনের জালিয়াতি রুখতে এই সব সংস্কার অনেক আগেই করা উচিত ছিল ।
সমবায় ব্যাঙ্কগুলিকে চাঙ্গা করতে বিশেষ পদক্ষেপ কেন্দ্রের
একটু বেশি সুদের মোহে ও ব্যাঙ্ক তো ব্যাঙ্কই হয়— সেই বিশ্বাসে ভর করে লাখ লাখ মানুষ তাঁদের কষ্টার্জিত অর্থ সমবায় ব্যাঙ্কগুলিতে জমা রাখেন । কিন্তু পঞ্জাব-মহারাষ্ট্র কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের (PMC) সাম্প্রতিক কেলেঙ্কারি ব্যাঙ্ক নামক মিথের সত্যতা প্রকাশ্যে এনেছে ।
ছোটো শিল্পপতি, খুচরো বিক্রেতা, উদ্যোগপতি, ব্যবসায়ী এবং শহরে বসবাসকারী নির্দিষ্ট আয়ের মানুষরা যাতে আর্থিক সাহায্য পান তাই শহুরে সমবায় ব্যাঙ্ক গড়েই তোলা হয়েছিল । ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে এই ব্যাঙ্কগুলি উক্ত সব পেশার মানুষের পক্ষে লাভজনক হত । সব ধরনের অর্থনীতিতেই উন্নতির জোয়ার আনত । কিন্তু স্বার্থসংঘাতে জড়িয়ে পড়ে এই ব্যবস্থাই এখন সেই সব অসহায় বিনিয়োগকারীদের প্রতারণা করছে যাঁরা বিশ্বাস করে এখানে টাকা রেখেছিলেন । শহুরে সমবায় ব্যাঙ্কগুলির বর্তমান টালমাটাল অবস্থার অন্তর্নিহিত কারণ বিশ্লেষণ করেছে নরসিমা মূর্তি কমিটি । তাদের চোখে এই পরিস্থিতির জন্য দায়ি যথেষ্ট পুঁজির অভাব, জাল সদস্যপদ, ঋণদানকারী শক্তির কেন্দ্রীয়করণ, কাছের মানুষদের সুবিধা করে দেওয়ার জন্য ঋণবণ্টনে বৈষম্য করা, ঋণের টাকা উদ্ধারে তৎপরতার অভাব প্রভৃতি । একদিকে যেখানে এই সমস্ত ত্রুটি সংশোধনের ক্ষেত্রে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, অন্যদিকে তেমনই এই ধরনের ব্যাঙ্কের সংখ্যা এবং তাতে মজুত অর্থের পরিমাণ দিন দিন বিপুল হারে বাড়তেই থেকেছে । 1991 সালে দেশজুড়ে শহুরে সমবায় ব্যাঙ্কের সংখ্যা ছিল 1 হাজার 307 । আর জমা অর্থের পরিমাণ ছিল 8হাজার 600 কোটি টাকা । 2004 সালের মধ্যে সেই ব্যাঙ্কের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় 2 হাজার 105-এ । আর জমা অর্থের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় 1 লাখ কোটি টাকা । যদিও বারংবার ব্যর্থতার কারণে ব্যাঙ্কের সংখ্যা বর্তমানে কমে এসে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৪০-এ । তবু, জমার অঙ্কে পতন হয়নি । তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে 5 লাখ কোটি টাকায় । আর এর সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে জালিয়াতি, দুর্নীতির ঘটনাও । সাতটি রাজ্যে বিস্তৃত PMC ব্যাঙ্কের জমার পরিমাণ 11 হাজার 600 কোটি টাকারও বেশি । কিন্তু এই ব্যাঙ্কই নিজের সম্পদের 70 শতাংশেরও বেশি অর্থাৎ 6 হাজার 500 কোটি টাকা হাতিয়ে হাউজ়িং ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডকে দিতে 21 হাজারেরও অধিক জাল অ্যাকাউন্ট তৈরি করেছিল । জানাজানি হওয়ার পর এই ব্যাঙ্ককে ইতিমধ্যেই RBI-এর প্রত্যক্ষ নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে । এই মুহূর্তে RBI-র প্রত্যক্ষ নজরদারির আওতায় রয়েছে 25 টি ব্যাঙ্ক । আর এই ব্যাঙ্কগুলি যাতে আর কোনওভাবেই অবৈধ কার্যকলাপ চালাতে না পারে তা নিশ্চিত করতে আইনি নিয়ন্ত্রণ সুনিশ্চিত করা অত্যন্ত প্রয়োজন ।
2002 সালে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট ফান্ড নিজের উদ্যোগেই জানতে পেরেছিল যে, সমবায় ব্যাঙ্ক সেক্টরে যে দুর্নীতির ঘটনা ঘটে চলেছে তার কারণ হল যুগ্ম নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা । যখনই ব্যাঙ্কগুলির বোর্ডে রাতারাতি বদল এসেছে তখনই দায়িত্ব এড়ানোর জন্য সমবায় ব্যাঙ্কের রেজিস্ট্রার এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের একে অপরের দিকে আঙুল তোলার ছবিটা খুব সাধারণ হয়ে পড়েছে । গুনগত পরামর্শ যেমন—ব্যাঙ্কের ম্যানেজমেন্ট বোর্ডের উচিত ফাইন্যান্স ব্যাঙ্কিং এবং অডিট সেক্টর থেকে বিশেষজ্ঞদের বহাল করা, "শিডিউলড" ব্যাঙ্কগুলির তুলনায় 2 শতাংশের বেশি সুদ যেন সমবায় ব্যাঙ্কগুলি কখনওই না দেয় তা লক্ষ্য রাখা, ডিপোজিট ইনসিওরেন্স যেন বেড়ে 2.5 লাখ টাকা পর্যন্ত হয়—বিগত 16 বছর ধরে এই সবের কোনওটাই কার্যকর করা হয়নি । কেন্দ্রীয় সরকার বর্তমানে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যাতে সমবায় ব্যাঙ্কগুলির উপর লগ্নিকারীদের আস্থা পুনরায় অর্জন করা যায় । আর এর জন্য সাম্প্রতিক বাজেটে কেন্দ্রীয় সরকার ডিপোজ়িট ইনসিওরেন্সের পরিমাণ 1 লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে 5 লাখ টাকা করেছে । যেহেতু কোঅপারেটিভ সোসাইটিজ় অ্যাক্ট-এ সাংবিধানিক সমর্থন রয়েছে আর আমরা তা এড়িয়ে যেতে পারি না তাই প্রাক্তন ডেপুটি গভর্নর, আর গান্ধির নেতৃত্বাধীন কমিটি এই সুপারিশ করেছে যে "শিডিউলড" ব্যাঙ্কের ধারা মেনে সমবায় ব্যাঙ্কগুলিরও উচিত নিজেদের "বোর্ড অফ ম্যানেজমেন্ট"–এর ডিরেক্টরদের কাছে ক্ষমতা সমর্পণ করতে । চলতি বছরের গোড়ায় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া কিছু নির্দেশিকা জারি করেছে । যেমন সমবায় ব্যাঙ্কগুলি যেখানে জমার পরিমাণ 100 কোটি টাকারও বেশি, তাদের একটি বোর্ড অফ ডিরেক্টরস এবং বোর্ড অফ ম্যানেজমেন্ট গড়ে তুলতে হবে । কঠোর নিয়মনীতি, কড়া ব্যবস্থা এবং তীক্ষ্ন নজরদারির সাহায্যে "ভিতর থেকে সাহায্য নিয়ে প্রতারণা" চালানোর দুষ্ট চক্র অবশ্যই ভাঙা সম্ভব ।