দিল্লি, 4 অক্টোবর : মা ও মাতৃভাষা দুটোই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ । মায়ের উপস্থিতি যেমন আমাদের আনন্দ দেয়, তেমনই মাতৃভাষা দেয় কদর, দেয় স্বস্তি । অন্য ভাষায় কথা বলতে যে জড়তা থাকে, স্থানীয় ভাষার ক্ষেত্রে তা থাকে না । একাধিক নোবেল জয়ী তাঁদের লেখায় এই বিষয়টির কথা উল্লেখ করেছেন এবং স্থানীয় ভাষায় সাহিত্য রচনার জন্য নোবেল পেয়েছেন । 2018 সালে পোলিশ লেখক ওলগা টোকাজ়ুর্ক বা 2019 সালে অস্ট্রিয়ান লেখক পিটার হান্টকের পুরস্কার প্রাপ্তি এ কথাই প্রমাণ করে ।
চার্লস ডিকেন্স, জর্জ এলিওট, থমাস হার্ডে, ওমিলি ব্রোনেট এবং স্যামুয়েল বুটলার রাণি ভিক্টোরিয়ার আমলের সাহিত্যকে ভিক্টোরিয়ান সাহিত্য বলে উল্লেখ করে থাকেন । এই সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য অগ্রগতি, আবেগ, উপযোগবাদ, ধারাবাহিকতা । বিশ শতকে মার্কিন সাহিত্যিকরা আধুনিকতাকে বয়ে আনলেন তাঁদের রচনায়-উপন্যাসে । তাঁরা সাহিত্যে আনলেন ছোট ছোট শব্দের প্রচলন, যেগুলির ধারণা অতি উচ্চমানের । এ প্রসঙ্গে 125 পাতার 'দা ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দা সি'-এর কথা উল্লেখ করতে হয় । যে বইটি লিখে বিখ্যাত হন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে । পরবর্তীতে পান নোবেল ।
ওলগা টোকাজ়ুর্কের বই 'দা বুকস অব জেকব' ( The Books of Jacob) একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে । তাঁর শব্দ চয়নের মধ্য দিয়ে ওলগা টোকাজ়ুর্ক 18 শতকের পোল্যান্ডে একটা ধর্মীয় আন্দোলনের সঞ্চার করেছিলেন, যা ফ্রাঙ্কিজিম নামে পরিচিত । তাঁর অপর একটি সাহিত্যের নাম বিয়েগুনি । ইংরাজি সাহিত্যের সঙ্গে লড়াই করে এই বইটির জন্য ওলগা 2018 সালে ম্যান বুকার জিতেছিলেন । তিনি 2018 সালে সাহিত্যে পোল্যান্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার জিতেছিলেন । 15তম মহিলা সাহিত্যিক হিসেবে নোবেল পান তিনি । পিটার হান্টকে তাঁর মাতৃভাষা জার্মানিতেই একাধিক উপন্যাস রচনা করেছেন । পিটার হান্টকের রচিত উপন্যাস ইউন্সলোসিস ইঙ্গলুক (Wunschloses Ungluck), যার বিষয়বস্তু মায়ের আত্মহত্যা এবং লেখকের উপর সেই ঘটনার প্রভাব আজও কালজয়ী । মাতৃভাষায় উপন্যাস লিখে পিটার হান্টকে একাধিক পুরস্কার জিতেছেন ।
আজ পর্যন্ত সাহিত্য 116 জন নোবেল জিতেছেন । এর মধ্যে মাত্র 29 জন ইংরাজি সাহিত্যের, আর তিনজন তাঁদের মাতৃভাষা এবং একই সঙ্গে ইংরাজিতে লিখে । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এশিয়ার প্রথম বাসিন্দা হিসেবে নোবেল পেয়েছিলেন । তাঁর গীতাঞ্জলি ইংরাজিতে অনুবাদ করা হয়েছিল । যা তাঁকে বিশ্বের সাহিত্যের দরবারে পরিচিতি দেয় । বিদ্যাধর সুরজপ্রসাদ নয়পল ত্রিনিদাদে জন্মেছিলেন । তিনি একজন ব্রিটিশ লেখক, 2001 সালে তাঁর কাজের জন্য নোবেল পান । ফ্রান্স এবং জার্মান দুই দেশেরই 14 জন করে এবং 11 জন স্পেনের , 7 জন সুইডেনের, 6 জন ইতালির, 6 জন রাশিয়ার, 5 জন পোল্যান্ডের, 3 জন ডাচ, 3 জন নাইজেরিয়ান, 2 জন চিনের, 2 জন জাপানের এবং 2 জন গ্রিক লেখক মাতৃভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির জন্য নোবেল পেয়েছেন । অন্যদিকে সব থেকে বেশি ফরাসি লেখকরা নোবেল পেয়েছেন । সংখ্যাটি 16 । এছাড়া অ্যামেরিকা থেকে 12 জন, ব্রিটেন থেকে 11 জন, জার্মান এবং সুইডেন থেকে 8 জন করে, পোল্যান্ড-ইতালি-স্পেন থেকে 6 জন করে, 4 জন অ্যায়ারল্যান্ডের এবং ডেনমার্ক এবং নরওয়ে থেকে তিন জন করে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন । 16 জন ফরাসি লেখকের মধ্যে 14 জন নোবেল পেয়েছেন স্থানীয় ভাষায় তাঁদের অবদানের জন্য ।
ভারতের একটা ভুল ধারণা প্রচলিত আছে, নোবেল পাওয়ার ক্ষেত্রে ইংরাজিতে লেখা বাধ্যতামূলক । সলমন রুশদি, অরুন্ধতী রায়, কিরণ দেশাইয়ের কথা বলতে হয় । ইংরাজি ভাষায় লিখে ভারতীয় লেখকরা বুকার পুরস্কার জিতেছেন । কিন্তু, আঞ্চলিক ভাষার বই ইংরাজিতে অনুবাদ করেননি, যা বিশ্ব মঞ্চে তুলে ধরা সম্ভব । আঞ্চলিক ভাষার অসাধারণ অনুবাদও হয়নি । সূত্র এবং অসাধারণ অনুবাদ এই দুটির প্রতিই একজন সাহিত্যিকের পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্ঞান থাকা প্রয়োজন । ইউরোপীয় এবং অ্যামেরিকান সাহিত্যগুলি ইংরাজিতে অনুবাদ করা হচ্ছে । গুরাজাদা রচিত কন্যাসুলকমের খুব শীঘ্রই ইংরাজি অনুবাদ প্রকাশিত হবে । একই সঙ্গে বলতে হয়, ভারতে খুব অল্প সংখ্যক মানুষ লেখাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে চান । লেখার অভ্যাসকে পাঠ্যক্রমে তেমন ভাবে উল্লেখ করা হয় না । পরিকল্পিত অনুবাদক এবং লেখক তৈরির জন্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে এবং উত্সাহ দিতে হবে ।