পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / bharat

"ভারতের প্রতি ঘরে মায়েরা যেন তোমার মতো সন্তান প্রসব করেন"

অত্যাচারী পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্টকে হত্যার জন্যই তিনি পৃথিবীতে এসেছেন । সহ-বিপ্লবীদের বারবার একথাই বলতেন গোপীনাথ সাহা । মাত্র 19 বছর বয়সে ফাঁসির মঞ্চে উঠে মৃত্যু বরণ করেছিলেন । হাসিমুখে মরণকে বরণ করেছিলেন যে সব নায়ক, তাঁরা কি যোগ্য সম্মান পেয়েছেন ? তাঁরা কি উপেক্ষিত নন ? প্রশ্ন আজও ওঠে ।

By

Published : Sep 3, 2020, 9:40 PM IST

Updated : Sep 3, 2020, 10:59 PM IST

FREEDOM FIGHTER GOPINATH SAHA
স্বাধীনতা সংগ্রামী গোপীনাথ সাহা

1919 ৷ অত্যাচারী ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে ফুঁসছে গোটা দেশ ৷ ওই বছরেরই 13 এপ্রিল ঘটে জালিয়ানওয়ালবাগের হত্যাকাণ্ড । ইংরেজ সেনার সিনিয়র অফিসার জেনেরাল রেজিনাল ডায়ারের নির্দেশে নিরীহ ভারতীয়দের উপর নির্বিচারে গুলি চালায় ব্রিটিশ সেনা । ব্রিটিশ রিপোর্ট অনুযায়ী যে হত্যালীলার বলি 379 । যদিও ভারতের তদন্ত-রিপোর্ট বলছে, প্রায় এক হাজার নিরীহ মানুষ মারা গেছিলেন । তার মধ্যে ছিল শিশু-মহিলা । ব্রিটিশ শাসকের এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা দেশকে । স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন একের পর এক কিশোর-তরুণ । তাঁদেরই একজন হুগলির শ্রীরামপুরের গোপীনাথ সাহা ।

1905 সালের, 5 ফেব্রুয়ারি বরানগরের পঞ্চাননতলায় জন্ম । শ্রীরামপুরের ক্ষেত্রমোহন শাহ স্ট্রিটে আদি বাড়ি হলেও, কলকাতায় ভাড়াবাড়িতে থাকতেন । বাবা বিজয়কৃষ্ণ সাহার আকস্মিক মৃত্যুতে মা সুরবালা দেবী চার পুত্রকে নিয়ে শ্রীরামপুরে ফিরে আসেন । ছোটোবেলা থেকেই গোপীনাথ স্বভাবে ধীর-স্থির, শান্ত ও সেবাপরায়ণ । শ্রীরামপুরের উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভরতি হন । এরপর স্বাধীনতা সংগ্রামের পীঠস্থান হুগলির বিদ্যামন্দিরে যোগদান ।

কিশোর গোপীনাথ তখন বিপ্লবীদের খাতায় নাম লেখাতে মরিয়া । মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে শুরু হওয়া অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের আহ্বানে সাড়া দেন (সেই সময় তিনি বিদ্যালয় ত্যাগ করেন বলে শোনা যায়) । প্রথম জীবনে অহিংস আন্দোলনের পথে ব্রতী ছিলেন তিনি । কিন্তু অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকের একের পর এক কারনামা কিশোর গোপীনাথকে সশস্ত্র সংগ্রামের পথে ঠেলে দেয় । সশস্ত্র বিপ্লবের পথে তাঁকে অনুপ্রাণিত করেন হুগলি বিদ্যামন্দিরের শিক্ষক জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ ওরফে মাস্টারমশাই । সান্নিধ্য লাভ করেন বিপ্লবী বিজয় মোদক, উত্তরপাড়ার বরেন চট্টোপাধ্যায়, ভূপেন চট্টোপাধ্যাসহ বহু বিপ্লবীর ।

গোপীনাথ সাহার আবক্ষ মূর্তি

পুরোপুরি দেশসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন গোপীনাথ । উত্তরবঙ্গে বন্যাদুর্গত হোক কিংবা বাংলাদেশের খুলনায় ত্রাণের কাজে-এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ছুটে বেড়িয়েছেন অবলীলায় । হুগলিতে থাকাকালীন গঙ্গায় ডুবতে বসা বৃদ্ধকে বাঁচিয়ে সেবা-শুশ্রূষা করেছিলেন গোপীনাথ। তাঁর এই সেবা-পরায়ণ মানসিকতা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ।

আরও পড়ুন : জেলবন্দী অবস্থায় শেষ অপারেশন, 20-তে ফাঁসির মঞ্চে অনন্তহরি মিত্র

কিন্তু, ভাগ্য-বিধাতা তাঁর জন্য অন্য কাজ নির্ধারণ করে রেখেছিল । বিদ্যামন্দিরে থাকাকালীন রিভোল্ট গ্রুপ চালাতেন মাস্টারমশাই ওরফে জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ । কলকাতার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্টের অত্যাচারের মাত্রা সেইসময় সীমা ছাড়ায় । বিপ্লবীদের দমনের জন্য একের পর এক স্বাধীনতা সংগ্রামীকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছিল । গ্রেপ্তার হন মাস্টারমশাইও । কিশোর গোপীনাথের ক্ষোভের আগুনে ঘি পড়ে ।

স্মরণে স্বাধীনতা সংগ্রামী গোপীনাথ সাহা

টেগার্টের দমননীতিতে এমনিতেই ক্ষুব্ধ ছিলেন গোপীনাথ, তার উপর মাস্টারমশাইয়ের গ্রেপ্তারি কিশোর গোপীনাথের বিপ্লবী-জীবন পালটে দেয় । টেগার্ট-হত্যার সংকল্প গ্রহণ করেন তিনি । যে কোনও মূল্যে । প্রায়ই তিনি সহ-বিপ্লবীদের বলতেন, স্বাধীনতার শত্রু টেগার্টের হাত থেকে ভারতমাতাকে মুক্তি দিতেই তাঁর পৃথিবীতে আসা । বিপ্লবী-জীবনের এই কাজটি তিনি নিজের জন্য নির্ধারণ করে নিয়েছিলেন । কিন্তু, আপামর নিরাপত্তা বলয়ে থাকা টেগার্টকে হত্যা করা যাবে কী করে ?

আরও পড়ুন : গুলি করে পালিয়ে যাননি, অনাথবন্ধু চড়ে বসেছিলেন ইংরেজ অফিসারের বুকে

শুরু পরিকল্পনা । বিভিন্ন জায়গায় টেগার্টকে অনুসরণ করা শুরু করে দেন গোপীনাথ । কখনও কিড স্ট্রিটে, তো কখনও টেগার্টের বাংলোর পাশে নির্মীয়মাণ বাড়ি থেকে তাঁকে লক্ষ্য রাখা । শুধু কি তাই, গাড়িতে বা হেঁটে যেভাবেই টেগার্ট যেতেন, তাঁর গতিবিধি লক্ষ্য রাখতেন গোপীনাথ । তবে টেগার্টের খুব কাছে যাওয়াও সম্ভব ছিল না । কারণ, আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলায় রাজসাক্ষী নিত্যগোপাল পুলিশের কাছে গোপীনাথের দৈহিক বিবরণ দিয়েছিল । কাজেই, টেগার্টের খুব কাছে গেলে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল । আবার ভালো করে চিনে না রাখলেই নয় । লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে । কিন্তু, গোপীনাথ দৃঢ় সংকল্প করে নিয়েছিলেন । যে কোনও মূল্যে টেগার্টকে হত্যা করতেই হবে । তাই ছদ্মবেশে টেগার্টের কাছে পৌঁছে গিয়ে তাঁর মুখের বিবরণ মনে গেঁথে নেন গোপীনাথ । যদিও ব্রিটিশ পুলিশ-বেষ্টিত টেগার্টকে কি গোপীনাথ ঠিক করে দেখে রাখতে পেরেছেন? অল্প হলেও মনে সংশয় ছিল সহ-বিপ্লবীদের । কিন্তু, আত্মবিশ্বাসী ছিলেন গোপীনাথ । টেগার্টকে হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয় গোপীনাথ এবং দেবেন দে-কে ।

স্বাধীনতা সংগ্রামী গোপীনাথ সাহা

এরপর সেই চূড়ান্ত ক্ষণ । 1924 সালের 12 জানুয়ারি । শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল । একাই হাজির গোপীনাথ । কিড স্ট্রিটে নিজের বাংলো থেকে প্রত্যহ ময়দানে প্রাতঃভ্রমণে যেতেন টেগার্ট । এই সময়টায় দেহরক্ষী থাকত না টেগার্টের । তাঁকে হত্যা করার ভালো সময় । ধুতি, খাকি শার্ট, পায়ে কালো জুতো আর শার্টের নিচে গুলিভরতি রিভলভার নিয়ে ওৎ পেতে বসে গোপীনাথ। এই অপেক্ষায় যে অত্যাচারী ইংরেজ কমিশনার এলেই গুলিতে তাঁকে ঝাঁঝরা করে দেবেন। সেইমতো ইংরেজ সাহেবকে দেখে গুলি চালান গোপীনাথ । এরপর সেখান থেকে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে যান । তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় লালবাজারে । জানতে পারেন, তাঁর গুলিতে নিহত হয়েছেন কিলবার্ন কম্পানির কর্মকর্তা আর্নেস্ট ডে । টেগার্টকে হত্যা না করতে পারা এবং নির্দোষ সাহেবকে মারায় মর্মাহত হন গোপীনাথ ।

আরও পড়ুন : দীপ্ত চোখে স্বাধীনতার স্বপ্ন, 21-এ ফাঁসির মঞ্চে রামকৃষ্ণ বিশ্বাস

14 জানুয়ারি প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে গোপীনাথের বিচারপর্ব শুরু হয় । আদালতে গোপীনাথ স্বীকারোক্তিতে বলেন, "আমি সবসময় চেষ্টা করেছি ভারতের মুক্তিকামী প্রতীকদের পথে বিষাক্ত কাঁটা টেগার্ট সাহেবকে হত্যা করতে । আমি তাঁকে ভালো করে চিনতাম । কিন্তু ভুলবশত আমি অন্য সাহেবকে হত্যা করে ফেলেছি । আমি হত্যা করেছি টেগার্টের মতো দেখতে এক নির্দোষ সাহেবকে । ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন টেগার্ট । আমার দুর্ভাগ্য যে আমার প্রতিজ্ঞা পূরণ হল না । দেশ ও জাতির শত্রুকে আমি হত্যা করতে পারলাম না । এখন টেগার্ট সাহেব হয়ত ভাবছেন তিনি নিরাপদ । কিন্তু আমার অসম্পূর্ণ কাজ ভারতের অসংখ্য তরুণ পূরণ করবেন । আমার প্রতিটি রক্তবিন্দু, ভারতের ঘরে ঘরে রক্তবীজের মতো স্বাধীনতা সংগ্রামী সৃষ্টি করুক ।"

এই মামলায় প্রথমে কোনও আইনজীবী না থাকলেও, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের পরামর্শে গোপীনাথকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছিলেন তৎকালীন বিখ্যাত উকিলরা । তবে টেগার্টকে হত্যার চেষ্টার পরিকল্পনায় আর কারা জড়িত তা জানাননি গোপীনাথ । আদালতে জবানবন্দীতে তিনি বলেছিলেন, "আমি নিজেই রিভলভার সংগ্রহ করে এই ঘটনা ঘটাতে গিয়েছিলাম ।"

আরও পড়ুন : ...মা তোমার প্রদ্যোৎ কি কখনও মরতে পারে ?

পয়লা মার্চ, 1924 সালে প্রেসিডেন্সি জেলে হাসিমুখে ফাঁসির মঞ্চে মৃত্যুবরণ করেছিলেন গোপীনাথ । কথা ছিল, ফাঁসির পর মরদেহ নিয়ে নেতাজির নেতৃত্বে নগর পরিক্রমা করা হবে । পরে শ্মশানঘাটের উদ্দেশে যাত্রা । কিন্তু, গোপীনাথের ফাঁসিতে ক্ষোভের আঁচ পাচ্ছিল ব্রিটিশ শাসক । অগ্নিগর্ভ অবস্থা দেখে ইংরেজ সরকার ভয়ে কারাগারের ভিতরেই তাঁর শেষকৃত্য করেন । শোনা যায়, ফাঁসির পর নেতাজি গোপীনাথের উত্তরীয় জোগাড় করেন । পরে তা মাথায় জড়িয়ে হরিশ পার্কে মিছিল করেন । পরদিন নেতাজিকে গ্রেপ্তার করেছিল ইংরেজ সরকার ।

শোনা যায়, মা-কে শেষ চিঠিতে গোপীনাথ লিখেছিলেন, ভারতের প্রতি ঘরে যেন মায়েরা তোমার মতো সন্তান প্রসব করেন... ।

গোপীনাথ সাহার স্মরণে গোপীনাথ স্মৃতি মার্কেট, গোপীনাথ ক্লাব ও রাজ্যধরপুর গ্রাম পঞ্চায়েতসহ বিভিন্ন জায়গায় স্মারক এবং মূর্তি বসিয়েছে শ্রীরামপুরবাসী ।

Last Updated : Sep 3, 2020, 10:59 PM IST

ABOUT THE AUTHOR

...view details