হায়দরাবাদ : COVID-19 প্যানডেমিকের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে গোটা বিশ্ব যখন নাকানিচোবানি খাচ্ছে, তখন অভিযোগের সমস্ত আঙুল উঠছে একটা ছোট্ট প্রাণীর দিকে ৷ একটা সন্দেহ ক্রমশই বাড়ছে যে এই ভাইরাস হয়তো ওই নিশাচর স্তন্যপায়ী প্রাণীর থেকেই ছড়িয়েছে ৷ ইবোলা, SARS এবং MERS-এর মতো আগের মহামারিগুলি ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে বাদুড়ের নাম জড়িয়ে পড়েছিল ৷ বাদুড় অন্তত দুই ধরনের ভাইরাসকে ধারণ করতে পারে ৷ কখনও কখনও এই ভাইরাসগুলি মানুষের শরীরের সরাসরি ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং আবার কখনও কখনও ভাইরাস অন্য কোনও প্রাণীর মাধ্যমে মানুষের শরীরে আসতে পারে ৷ এই দ্বিতীয় পদ্ধতিতেই নভেল করোনা ভাইরাস মানুষের শরীরে বাসা বেঁধেছে বলে মনে করা হচ্ছে ৷ বাদুড় কীভাবে এই মারাত্মক ভাইরাসকে ধারণ করছে ? প্যাথোজেন ছড়াতে কতদূর পর্যন্ত তাদের ভূমিকা রয়েছে ? এগুলি কি মানুষের পক্ষে উপকারী ? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তরগুলিই সবচেয়ে বেশি চিন্তার ৷ এখনও পর্যন্ত প্রায় অধিকংশ মহামারিই পশুপাখির মাধ্যমে ছড়িয়েছে ৷ এগুলিকে বলা হয় জোনোটিক রোগ (যে রোগ পশুপাখি এবং মানুষের মধ্যে ছড়ায়) ৷ গবেষকরা দেখেছেন বাদুড় অন্তত 60 ধরনের ভাইরাসের একেবারে সঠিক ধারক হতে পারে ৷
কোনও আঘাত বা টান আমাদের পেশির ক্ষতি করে, যা থেকে কোষের স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ৷ অন্যদিকে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সঙ্গে সঙ্গে পেশিকে সুস্থ করতে কাজ শুরু করে দেয় ৷ এই পদ্ধতি চলাকালীন আমরা পেশিতে ব্যথা অনুভব করি, পেশি ফুলে যায় এবং জ্বরও হতে পারে ৷ শরীর প্রকৃতিগত ভাবে এই কাজ করে কোষের ক্ষতি মেরামত করার জন্য ৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অত্যাধিক সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে ৷ সেক্ষেত্রে নিউমোনিয়ার মতো প্রাণসংশয়ী রোগ হতে পারে ৷ COVID-19 এর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে ৷ এখানেই বাদুড় খুবই স্বতন্ত্র৷ যেহেতু ভেসে থাকার জন্য তারা এক মিনিটে একশোবার ডানা ঝাপটাতে পারে, তাই সহজেই তাদের পেশির ক্ষতি হওয়া সম্ভব ৷ কিন্তু তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এই ক্ষতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে ৷ যেহেতু তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই কম অত্যধিক সক্রিয় হয়, তাই এক্ষেত্রে তারা কিছুটা হলেও এগিয়ে ৷ কিছু কিছু বাদুড়ের ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সব সময় ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত থাকে ৷ যদি তারা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে নাও পারে, তাও ওই স্তন্যপায়ীর যাতে কোনও ক্ষতি না হয়, তা নিশ্চিত করতে পারে ৷ এই কারণেই বাদুড় প্যাথোজেনের একেবারে সঠিক ধারক হয়ে উঠতে পেরেছে ৷ তার মানে ভাইরাস বাদুড়ের উপর কোনও প্রভাব ফেলতে পারে না ৷ এটা শুধু সেখানে থাকে যতক্ষণ না অন্য কোনও সঠিক ধারকের সন্ধান পাচ্ছে ৷
বাদুড় খুব কম সময়ে অনেক বেশি দূরত্ব উড়ে যেতে পারে ৷ এই সময়ের মধ্যে তারা পশু বা পাখিকে কামড়ে, কিংবা মল-মূত্র ত্যাগ করে ভাইরাস ছড়াতে পারে ৷ বাদুড় খুবই সংক্রামক, যদি তাদের ছোঁয়া হয়, শিকার করা হয় কিংবা খাওয়া হয় ৷ তার মানে মানব শরীর যতক্ষণ না তাদের সংস্পর্শে আসছে, ততক্ষণ তারা ভাইরাস ছড়াতে পারে না ৷ 2002 সালে SARS ভাইরাস বাদুড় থেকে খট্টাস বা গন্ধগোকুলের মধ্যে ছড়িয়েছিল ৷ চিনের বাজারে ময়ূর, বাদুড়, হরিণ, এবং কাঠবেড়ালির মতো 120 টি প্রজাতির প্রাণী পাওয়া যায় ৷ তাদের খাঁচার মধ্যে রাখা হয় ৷ গ্রাহকের অনুরোধের ভিত্তিতেই তাদের কাটা হয় ৷ চিনে প্রায় 20 হাজার বণ্যপ্রাণী পালন খামার রয়েছে ৷ উহানের বাজারেই 1000 মাংসের দোকান রয়েছে ৷ এমনই কোনও একটা বাজার থেকেই nCoV ছড়িয়েছিল বলে একটি রিপোর্টে জানা গেছে ৷ অতীতে SARS ভাইরাস খট্টাস জাতীয় বিড়াল থেকেই ছড়িয়েছিল, যা চিনে একটি সুস্বাদু খাবার হিসেবেই বিবেচিত হয় ৷ এটা সন্দেহ করা হচ্ছে যে নভেল করোনা ভাইরাসও এমনই একটি পথে মানুষের শরীরে চলে এসেছে ৷
COVID-19 এর ছড়িয়ে পড়া আটকাতে বাদুড় মারার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন বিশেষজ্ঞরা ৷ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার ক্ষেত্রে বাদুড় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ৷ পরিবেশের কাছে তারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ৷ খাদ্যশস্যের ক্ষতি করে এমন কীটপতঙ্গদের শিকার করে বাদুড় ৷ তাছাড়া খাবারের খোঁজে উড়তে থাকার সময় তারা বিস্তীর্ণ এলাকায় ফলের বীজ ছড়িয়ে দেয় ৷ পরিবেশপ্রেমীদের আশঙ্কা যে COVID-19 যেভাবে মারাত্মক আকারে ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে বাদুড়ের পুরো প্রজাতিকেই না ধ্বংস করে দেওয়া হয় ৷ হায়দরাবাদের 100 কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে 16 টি প্রজাতির বাদুড় থাকে ৷ তেলেঙ্গানায় 18 ধরনের বাদুড় থাকে ৷ 1990 সাল পর্যন্ত হায়দরাবাদের গোলকুণ্ডা দূর্গে 12 হাজার বাদুড় থাকত ৷ সেই সংখ্যা এখন চার হাজারে নেমে এসেছে ৷
প্রাকৃতিক ভারসাম্য পরিবর্তনে চিনের প্রচেষ্টা বুমেরাং হয়েছে এবং যার ফলে কয়েক মিলিয়ন মানুষের জীবনে প্রভাব পড়েছে ৷ 1958 সালে চিনের মাও জে-দংয়ের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল ফোর পেস্ট ক্যাম্পেন ৷ এই চারটি কীটপতঙ্গের মধ্যে ছিল মশা - যা ম্যালেরিয়া ছড়ায়, তীক্ষ্ণদাঁত জাতীয় প্রাণী - যারা প্ল্যাগ ছড়ায়, বাতাসে রোগ ছড়ানোর জন্য মাছি এবং ফসল নষ্ট করার জন্য চড়াই পাখি ৷ এই চারটি কীটপতঙ্গের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল চড়াই পাখি ৷ বেজিংয়ে অবস্থিত পোল্যান্ডের দূতাবাসে অনেক চড়াই পাখি আশ্রয় নেওয়ায় সেখানে চিনের মানুষের জমায়েত দেখা গিয়েছিল ৷ আধিকারিকরা প্রবেশের অনুমতি না দিলেও মানুষ সেখান থেকে সরে যাননি এবং ড্রাম বাজিয়ে সেখানে ঘেরাও করে রাখেন ৷ দুই দিন ধরে একটানা ড্রাম বাজানোর কারণে ওই ভবনে আশ্রয় নেওয়া চড়াই পাখিগুলি মারা যায় ৷ 1960 সালে চিনের শাসকরা নিজেদের মতামত পরিবর্তন করে ফেলে ৷ অন্যদিকে তাদের হিসেবে চড়াই পাখির গণহত্যার ফলে বছরের পর বছর ফসলে ক্ষতি হয় ৷ পঙ্গপালের জনসংখ্যা বেড়ে যায় ৷ অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জেরে অন্তত 1.5 কোটি মানুষের মৃত্যু হয় 1959 থেকে 1961 সালের মধ্যে ৷ হারানো ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে চিনের তরফে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে 2.5 লাখ চড়াই পাখি আমদানি করা হয় ৷ এ-কথা মাথায় রেখেই পরিবেশবিদরা জানিয়েছেন যে COVID-19 এর আতঙ্কের জেরে বাদুড় হত্যা করা চলবে না ৷