মহাভারতে বিদুর বলেছিলেন, "সেইসব মানুষের থেকে সাবধান, যারা বলে এক, করে আর এক ।" তিনি প্রবঞ্চকদের বিরুদ্ধে রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে পরামর্শ দিচ্ছিলেন কিন্তু তিনি সহজেই ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার প্রসঙ্গও টানতে পারতেন যেখানে বহু মিথ্যা বিশ্বাসের গভীরে রয়েছে দ্বিচারিতার শিকড় । কোরোনা পরবর্তী বিশ্বে এই দ্বিচারিতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে । যেখানে শুধু দক্ষ, নমনীয় এবং সৃজনশীলরাই টিকে থাকবেন । দুর্ভাগ্যজনকভাবে সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষা নীতি যা শীঘ্রই মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য আনা হবে তা এই বাস্তবের মুখোমুখি হয়নি ।
এরকমই একটি মিথ হল, জনগণের ভালো করতে গেলে সরকারকেই শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে । তাই, বেসরকারি স্কুলগুলিকে সহ্য করতে হবে । একটা দ্বিচারিতায় পূর্ণ মিথ্যার ভিত্তিতে যা তাদের লাভ করতে আটকাবে যেখানে সবাই জানে যে অনেক স্কুলই আসলে আর্থিক লাভ করে । দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রকে সবসময় বেসরকারি স্কুলগুলিকে লাইসেন্স-রাজের শিকল পরিয়ে রাখতেই হবে যাতে তারা ঠিকঠাক আচরণ করে । এই মিথ সেই ভুল বিশ্বাসের উপর তৈরি । যেখানে বলা হয়, এগিয়ে থাকা দেশগুলিতে না কি শিক্ষা শুধুই সরকারি । সত্যিটা হল যে অ্যামেরিকা, ব্রিটেন, এমনকী সমাজতান্ত্রিক স্ক্যান্ডিনেভিয়ানের শিক্ষাক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সংস্কারে বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। উন্নত দেশগুলোর বহু স্কুলই আজ সরকারি অর্থ সাহায্যে বেসরকারি পরিচালনার মডেলের দিকে এগোচ্ছে ।
এই মিথের পিছনে ছুটতে গিয়ে ভারত সরকারি স্কুলগুলিতে বিপুল বিনিয়োগ করে ফেলেছে । কিন্তু তার ফল যন্ত্রণাদায়ক । ভারতের ছেলেমেয়েরা আন্তর্জাতিক PISA পরীক্ষায় 74টি দেশের মধ্যে 73তম স্থান পেয়েছে । পিছনে রয়েছে শুধু কিরঘিজ়স্তান । ক্লাস ফাইভের অর্ধেকেরও কম সংখ্যক পড়ুয়া, ক্লাস টু-র টেক্সট থেকে একটা প্যারাগ্রাফ পড়তে পারে; ক্লাস ফাইভের অর্ধেকেরও বেশি পড়ুয়া ক্লাস টু-র টেক্সট থেকে পাটিগণিতের অঙ্ক করতে পারে না । কয়েকটি রাজ্যে 10 শতাংশেরও কম শিক্ষক টিচার্স এলিজিবিলিটি টেস্ট (TET) পাশ করেছেন । উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে চারজনের মধ্যে তিনজন শিক্ষকই ক্লাস ফাইভের বই থেকে শতাংশের অঙ্ক করতে পারেন না । গড়পরতা সরকারি স্কুলে চারজনের একজন শিক্ষক গরহাজির থাকেন। এবং যাঁরা থাকেন তাঁদের দু'জনের মধ্যে একজন পড়ানই না ।
এই পরিস্থিতির ফলে 2010-11 এবং 2017-18-র মধ্যে 2.4 কোটি পড়ুয়া সরকারি স্কুল ত্যাগ করে বেসরকারি স্কুলে ভরতি হয়েছে, বলছে সরকারের DISE তথ্য । আজ ভারতের ছেলেমেয়েদের 47 শতাংশই বেসরকারি স্কুলে পড়ে । 12 কোটি পড়ুয়া সহ আমাদের বেসরকারি স্কুল-ব্যবস্থা হল বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম । এই বেসরকারি ব্যবস্থায় 70 শতাংশ অভিভাবক মাসিক 1000 টাকারও কম ফি দেন এবং 45 শতাংশ অভিভাবক দেন 500 টাকারও কম । এক্ষেত্রে সেই মিথটাও নষ্ট হচ্ছে যে বেসরকারি স্কুল শুধু বড়লোকদের জন্য ।
যে গতিতে সরকারি স্কুলগুলো খালি হচ্ছে, সেই অনুযায়ী আরও 1 লাখ 30 হাজার বেসরকারি স্কুলের প্রয়োজন আছে । একটা ভালো স্কুলে সন্তানকে ভরতি করাতে চেয়ে অভিভাবকদের লম্বা লাইন একটা হৃদয়বিদারক দৃশ্য । ভালো বেসরকারি স্কুলের অভাবের পিছনে তিনটি কারণ রয়েছে । একটি হল লাইসেন্স রাজ । একজন সৎ মানুষের পক্ষে একটা স্কুল চালু করা খুবই কঠিন । রাজ্য অনুযায়ী 35 থেকে 125টি অনুমতির প্রয়োজন হয়, এবং প্রতিটি অনুমতির জন্যই দৌড়ঝাঁপ এবং ঘুষের প্রয়োজন হয় । সবথেকে বেশি ঘুষ দিতে হয় এসেনশিয়ালিটি সার্টিফিকেটের (যাতে প্রমাণ হয় যে স্কুলটির প্রয়োজন আছে) জন্য আর অনুমোদন এবং অন্যান্য প্রক্রিয়ার জন্য পাঁচ বছরও লাগতে পারে ।