দিল্লি, ২৮ মে: লাদাখের ডেমচক, গালওয়ান ও প্যাংগং এবং উত্তর সিকিমের নাথুলার একাধিক জায়গায় ভারতীয় সেনাবাহিনী ও চিনা PLA-র মধ্যে উত্তেজনা খুব শীঘ্রই মিটে যাওয়ার নয় ৷ এমনটাই মনে করেন ভারতীয় সেনার নর্দান কমান্ডের প্রাক্তন প্রধান ডি এস হুডা ৷ সাংবাদিক স্মিতা শর্মার সঙ্গে এক্সক্লুসিভ আলোচনায় অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুডা জানিয়েছেন, LAC বরাবর চিনের এবারের কার্যকলাপ মোটেই অতীতের মতো বিছিন্ন বা কোনও স্থানীয় ঘটনাও নয় ৷ বরং এবার তা বেজিংয়ের শীর্ষস্তর থেকে পূর্ব পরিকল্পিত এবং পরিচালিত হচ্ছে ৷ উরিতে সন্ত্রাসবাদী হামলার পর সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে নেতৃত্ব দেওয়া এই সেনাবাহিনীর প্রাক্তন শীর্ষকর্তা জানিয়েছেন, কোরোনা ভাইরাসের উৎপত্তি সংক্রান্ত বিতর্কে চিন এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দ্বারা কোণঠাসা ৷ তার উপর হংকং ও তাইওয়ান ফের চিনা কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ৷ এই পরিস্থিতিতে LAC বরাবর ভারতের বিরুদ্ধে ‘আগ্রাসন’ দেখাচ্ছে বেজিং ৷ তারা যে দুর্বল নয়, এই বার্তাই সারা বিশ্বে পৌঁছে দিতে চাইছে চিন ৷ জেনারেল হুডার মতে, উপত্যকায় জঙ্গিদের বাড়বাড়ন্ত এবং LOC-তে গুলি বর্ষণ LAC-এর ঘটনার থেকে বিচ্ছিন্ন নয় ৷ ভারতীয় সেনাবাহিনী সীমান্তে একাধিক লড়াইয়ের চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত ৷ অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্টের একটি টুইটে জানিয়েছিলেন, ভারত ও চিন তাদের সমস্যা দ্বিপাক্ষিকভাবে মিটিয়ে নিতে পারবে ৷ ট্রাম্পের এই বিতর্কিত টুইটটিকেও তিনি উড়িয়ে দিচ্ছেন ৷ নীচে দেওয়া হল সেই এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার ৷
প্রশ্ন: চুমার থেকে ডোকলামে আগেরবারের তুলনায় এবারের পরিস্থিতি কেন আলাদা? আপনি এই সীমা লঙ্ঘন, সংঘর্ষ ও লড়াইয়ের সময়কালকে কীভাবে দেখছেন ?
উ: হ্যাঁ, এটা অতীতের থেকে আলাদা ৷ আমার কাছে তো বেশ তাৎপর্যপূর্ণভাবেই আলাদা ৷ যদি অতীতের চুমার, ডোকলাম এমনকী ২০১৩ সালের ডেপস্যাং-এর উত্তপ্ত পরিস্থিতির দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব, সেগুলো আসলে স্থানীয় ঘটনা ৷ স্থানীয় ভিত্তিতেই কয়েকদিনের জন্য উত্তপ্ত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল ৷ ডোকলামে চিনের তরফে রাস্তা তৈরির করার চেষ্টা করা হচ্ছিল ৷ তাতে আমাদের বাহিনী (ভারতীয় সেনা) পদক্ষেপ করে চিনকে রাস্তা তৈরি না করার অনুরোধ করে ৷ একই ঘটনা ঘটেছিল চুমারেও ৷ এখানেও তারা রাস্তা তৈরি চেয়েছিল ৷ আমাদের বাহিনী তা বন্ধ করে দেয় ৷ এটা ওই এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল ৷ ডোকলামের ঘটনার পর অন্যত্র ছড়িয়ে যায়নি ৷ দুই তরফ থেকে কী চাইছে, সেই বিষয়ে আমাদের কাছে স্পষ্ট ধারণা ছিল ৷
এবার বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা ৷ প্রথমত, এটা ভৌগোলিকভাবে বহু বছর ধরে ছড়িয়ে পড়েছে ৷ এর মধ্যে অনেক জায়গায় সীমান্ত নিয়ে কোনও মতবিরোধ নেই ৷ উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গালওয়ানে আমাদের কখনও সমস্যা হয়নি ৷ অনেক বেশি পরিমাণ বাহিনী মোতায়েন করতে হয়েছে ৷ এটাকে কখনওই স্থানীয় ঘটনা বলা যায় না ৷ চিন আসলে বোঝাতে চাইছে, পরিকাঠামো তৈরি ও ইত্যাদি নিয়েই সমস্যা ৷ এটা নিয়মিত শীর্ষস্তর থেকে পরিকল্পনা করা হচ্ছে ৷ তারা একেবারে পরিকল্পিত ভাবে এসেছে ৷ সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল, তাদের দাবি কী? তারা আসলে কী চায় তা নিয়ে কোনও স্বচ্ছতা নেই ৷ সুতরাং, এটা এমন একটা পরিস্থিতি যা আমাদের গুরুত্ব দিয়ে পর্যালোচনা করা উচিত ৷
প্রশ্ন: গতকাল বেজিং বলেছে সীমান্তের পরিস্থিতি সার্বিকভাবে স্থিতিশীল এবং নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ৷ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প টুইট করেছেন, তিনি ভারত ও চিনের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে রাজি ৷ এটাকে তিনি ‘আবেগের বশবর্তী হয়ে বিরোধ’ বলে অভিহিত করেছেন ৷ কোরোনা ভাইরাসের উৎসস্থল সংক্রান্ত বিতর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দ্বারা কোণঠাসা হওয়া থেকে শুরু করে হংকংয়ে প্রতিবাদ ও তাইওয়ানের নতুন পরিস্থিতি সংক্রান্ত ভূ-রাজনৈতিক অবস্থার সঙ্গে কি সীমান্তের ঘটনা কোনওভাবে সম্পর্কযুক্ত ?
উ:যা ঘটছে, তার সঙ্গে অবশ্যই ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে ৷ চিন এখন মারাত্মক চাপের মধ্যে রয়েছে ৷ প্রযুক্তি ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চিনের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই চলছে ৷ এর ফলেই চিনের তরফে এই ধরনের আগ্রাসী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে ৷ আপনি যদি দক্ষিণ চিন সাগরের দিকে তাকান তাহলে দেখতে পাবেন হংকংয়ে নতুন আইন পাস করানো হয়েছে ৷ দেখবেন তাইওয়ানের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী মনোভাবের পুনরাবৃত্তি ঘটছে ৷ অস্ট্রেলিয়ার উপর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে ৷ এগুলির প্রত্যেকের সঙ্গে চিনের সম্পর্ক রয়েছে ৷ তারা বোঝাতে চাইছে যে কোরোনা ভাইরাসের জন্য ‘আমাদের দুর্বল ভেবো না’ ৷
চিনের কূটনীতিকের দেওয়া বিবৃতিকে আমরা ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে ধরতেই পারি ৷ কিন্তু যতক্ষণ না পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে, ততক্ষণ এটাকে আমরা সামান্য পদক্ষেপ বলে ধরতে পারি ৷ আর ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কেউ আর কোনও গুরুত্ব দেন বলে মনে হয় না ৷ এই সমস্যার জন্য কোনও তৃতীয় পক্ষের প্রয়োজন নেই ৷ এটা ভারত ও চিনের মধ্যেই সমাধান করতে হবে ৷
প্রশ্ন : ভারত অতীতে BRI-এর বিরোধিতা করেছে ৷ যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের আমেরিকানদের নিয়ে তৈরি চতুর্পাক্ষিক নিরাপত্তা আলোচনার অংশ ৷ এই বিষয়গুলি চিনের উপর কতটা প্রভাব ফেলছে ?
উ: এই বিষয়গুলি অবশ্যই তাদের ভাবনাচিন্তার মধ্যে রয়েছে ৷ ভারত কীভাবে মার্কিন শিবিরের দিকে চলে যাচ্ছে এবং চিন বিরোধী অবস্থান নিচ্ছে তা গ্লোবাল টাইমসের একটি লেখায় বলা হয়েছে ৷ ওদের কাছে এটা একটা চিন্তার বিষয় ৷ ভারত মহাসাগরের তরফে শক্তিশালী নৌবাহিনী রয়েছে ৷ যদি তারা মনে করে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ওই চার পক্ষ এক হয়ে যাবে, তাহলে ভারত মহাসাগরে চিনের জন্য বিপদ অপেক্ষা করছে ৷ তারা অবশ্যই একটা বার্তা দিতে চাইছে ৷ আর প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (LAC) বরাবর আগ্রাসী ব্যবহারের মাধ্যমে ভারতকে চাপে ফেলতে চাইছে ৷
প্রশ্ন: পরিকাঠামোগত উন্নয়ন এবং বাহিনী মোতায়েনে ভারত LAC বরাবর কতটা শক্তিশালী ?