পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / bharat

রাজনৈতিক তহবিল পরিচালনায় কতটা স্বচ্ছতা এনেছে ইলেকটোরাল বন্ড ? - ভারতীয় জনতা পার্টি

2018 সালের জানুয়ারি মাসে প্রবর্তিত ইলেকটোরাল বন্ড নির্বাচন প্রক্রিয়ার আমূল সংস্কার সাধন করবে, এই আশা নিয়ে চালু করা হলেও রাজনৈতিক তহবিল পরিচালনায় এই বন্ড কোনও স্বচ্ছতা আনেনি । এই বিষয়ে লিখেছেন সঞ্জয় কুমার ও নীল মাধব ৷ সঞ্জয় কুমার সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ ডেভেলপিং সোসাইটিস (CSDS), দিল্লির অধ্যাপক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, ভোট বিশেষজ্ঞ। নীল মাধব ইউনিভার্সিটি অফ দিল্লির সাংবাদিকতার ছাত্র ও ‘লোকনীতি, CSDS–এর একটি গবেষণা কর্মসূচি’র সঙ্গেও যুক্ত।

Electoral Bond
ইলেকটোরাল বন্ড

By

Published : Mar 10, 2020, 11:01 AM IST

দিন কয়েক আগে এক লিখিত জবাবে অর্থ মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর সংসদে জানিয়েছিলেন যে ভারতের নির্বাচন কমিশন চায় না, রাজ্যগুলি ভোটের খরচ বহন করুক ৷ তিনি বলেছিলেন, “নির্বাচন কমিশন সরকারকে জানিয়েছে, রাজ্যগুলি ভোটের জন্য তহবিল হিসাবে কাজ করুক, তারা তা চায় না । কারণ কোথায় প্রার্থীরা নিজেরা খরচ করছেন বা কোথায় তাঁদের হয়ে অন্যরা ব্যয়ভার বহন করছেন বা কোথায় শুধুমাত্র রাজ্যের তরফেই অর্থের সংস্থান করা হচ্ছে, এত কিছু তাদের পক্ষে নজরদারি করা সম্ভব নয় ।” তিনি জানিয়েছিলেন যে প্রকৃত ইশু বিচার করার ক্ষেত্রে কমিশনের দৃষ্টিভঙ্গি হল, রাজনৈতিক দলগুলির আর্থিক মদত পাওয়ার নিয়মনীতিতে বৈপ্লবিক বদল আনা উচিত, আর তা-ও এমনভাবে যে, সেই বিধিতে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা বজায় থাকে । সেই অর্থে বলতে গেলে নির্বাচন কমিশন প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদির দেওয়া সেই পরামর্শ একপ্রকার খারিজই করে দিয়েছে, যেখানে তিনি নির্বাচনে রাজ্যের অর্থ ব্যবহারের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন । 2016 সালে নোটবন্দী ঘোষণা হওয়ার পরই প্রধানমন্ত্রী এই পরামর্শ দিয়েছিলেন । সে সময় তিনি লোকসভা এবং বিধানসভা ভোট যাতে একসঙ্গে করানো হয়, তার সপক্ষে সওয়াল করেছিলেন, যাতে দুর্নীতি কমে আর সরকার ও নির্বাচন কমিশন, উভয়েরই সময় বাঁচে ।

যদিও ECI হয়তো ভোটে রাজ্যের অর্থ ব্যয় হওয়ার বিরুদ্ধেই মত দিয়েছে, তবু মন্ত্রী জানিয়েছেন যে নির্বাচনে টাকার ক্ষমতা খর্ব করতে এবং রাজনৈতিক তহবিল গড়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনার বিষয়ে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ । তিনি বলেছিলেন, নগদে লেনদেন বন্ধ করতে এবং রাজনৈতিক তহবিল গড়ার উৎস নির্বাচনে স্বচ্ছতা আনতে সরকার আয়কর আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনেছে এবং নামহীন নগদ অনুদানের পরিমাণ সর্বোচ্চ 2000 টাকা পর্যন্ত চূড়ান্ত করা হয়েছে । তিনি এ কথাও উল্লেখ করেছেন যে, 2018 সালে সরকার ইলেকটোরাল বন্ড চালু করেছিল যাতে রাজনৈতিক তহবিল পরিচালনায় স্বচ্ছতা আসে এবং তা পরবর্তীকালে সহজে অডিট-ও করা যায় । কিন্তু প্রশ্ন হল, আইনে যে সব বদল সরকার এনেছে, যেমন এই ইলেকটোরাল বন্ড চালু করা প্রভৃতি, তা কি আদৌ রাজনৈতিক তহবিল পরিচালনার কাছে স্বচ্ছতা এনেছে? স্বচ্ছতা আনার দুরূহ চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার বদলে ইলেকটোরাল বন্ডের মাধ্যমে কীভাবে রাজনৈতিক দলগুলি টাকার যোগান পায়, তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে—বড় এবং সুপ্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলি কীভাবে রাজনৈতিক তহবিল পরিচালনার কাজকে গোপনীয় এবং নিজেদের জন্য সুবিধাজনক করে রেখেছে । সেই তুলনায় ছোট এবং আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলি অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে ।

2018 সালের জানুয়ারি মাসে প্রবর্তিত ইলেকটোরাল বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলি অর্থের যোগান পাওয়ার নতুন প্রক্রিয়া হল—যে কোনও ভারতীয় নাগরিক বা ভারতীয় সংস্থা স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার নির্দিষ্ট শাখা থেকে এক হাজার, দশ হাজার, এক লক্ষ, 10 লক্ষ এবং এক কোটি টাকার মূল্যের ইলেকটোরাল বন্ড কিনতে পারেন এবং 15 দিনের মধ্যে নিজের পছন্দের রাজনৈতিক দলের নামে তা দান করতে পারেন । রাজনৈতিক দলগুলি সেই টাকা ব্যবহার করতে পারে এই শর্তে যে, রাজ্য বিধানসভার ভোট হোক বা লোকসভা ভোট, রাজনৈতিক দলগুলিকে সাম্প্রতিকতম নির্বাচনে মোট ভোটের অন্তত এক শতাংশ পেতেই হবে । এই শর্তের জেরে সবচেয়ে বেশ সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে সদ্য নথিবদ্ধ হওয়া রাজনৈতিক দলগুলি, কারণ এক শতাংশ ভোট পাওয়া মুখের কথা নয় । অন্যদিকে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং জনতার গরিষ্ঠ অংশের সমর্থনপ্রাপ্ত রাজনৈতিক দলগুলির পক্ষে এটি বেশ লাভজনক পরিণত হয়েছে ।

রাজনৈতিক তহবিল পরিচালনায় ইলেকটোরাল বন্ড কোনও স্বচ্ছতা আনেনি । আইন অনুযায়ী, রাজনৈতিক দলগুলিকে এই ধরনের বন্ডের সাহায্যে কারা অর্থের যোগান দিচ্ছে, তা গোপন রাখা হয় । কিন্তু নির্বাচনে কালো টাকা তথা হিসাব বহির্ভূত অর্থের ভূমিকা খর্ব করার বদলে, অর্থের যোগানকারীর নাম গোপন রাখলে তা ব্যক্তিবিশেষ এবং সংস্থাকে, রাজনৈতিক দলগুলিকে অনুদানের নামে কালো টাকার যোগান দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও উৎসাহিত করবে । গত কয়েক বছরে ভোট প্রক্রিয়ার উন্নয়ন সাধনের পরিবর্তে আমরা কেবল গোটা ব্যবস্থাকে আরও অস্বচ্ছ এবং কোণঠাসা করে ফেলেছি, আর এই অবস্থায় বদল আনার সম্ভাবনা খুব কম । তার উপর আবার ফরেন কন্ট্রিবিউশন (রেগুলেশন) অ্যাক্টের (FCRA) আওতায় আনা সংশোধনীতে রাজনৈতিক দলগুলিকে বিদেশ থেকে অর্থের যোগান গ্রহণে যেভাবে সম্মতি প্রদান করা হয়েছে, তা রীতিমতো বিপজ্জনক । অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অর্থের এই সব উৎস অত্যন্ত সন্দেহজনক কারণ এগুলিতে অর্থদানকারীর পরিচয় গোপন থাকে । পরবর্তীকালে বিদেশ থেকে এভাবে আমাদের দেশে অর্থ আসার প্রক্রিয়া আমাদের গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপরই বড় সড় প্রভাব ফেলতে পারে ।

নির্বাচন প্রক্রিয়ার আমূল সংস্কার সাধন করবে, এই আশা নিয়ে ইলেকটোরাল বন্ড চালু করা হলেও এর ফাঁকফোকর এবং খামতিগুলি দেশের নির্বাচনগুলিতে আর্থিক ক্ষমতা খর্ব করার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর রাজনৈতিক দলগুলিকে রাজ্যের তরফে অনুদান দেওয়া উচিত কি না—দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা এই বিবাদকেই ইলেকটোরাল বন্ডের প্রচলন নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে । ভোট-রাজনীতির সংস্কারে চোখে পড়ার মতো বদল আনতে আমাদের উচিত এই পাহাড় প্রমাণ সুযোগ কাজে লাগানো । কারণ বহু সময়েই যদিও বহু রাজনৈতিক দল বার বার এ কথা জোর দিয়ে বলেছে যে, রাজনৈতিক সংস্কার সাধনের ক্ষেত্রে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি পালনের ক্ষেত্রে তাদের উদ্যোগে কোনও গতি চোখে পড়েনি কারণ বর্তমান ব্যবস্থা থেকে তারা প্রচুর সুযোগ পেয়ে চলেছে । এই অবস্থার বদল সত্বর প্রয়োজন ।

রাজনৈতিক দলগুলির তহবিলের উৎস কী, তা জানার অধিকার ভোটারদের থাকা উচিত, কারণ এই দলগুলির মধ্যে কোনও একটিই পরবর্তীকালে সরকার গড়ে এবং জনগণের জন্য কর্মসূচি তৈরি করে । রাজনৈতিক তহবিল পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব রয়ে গেলে অধিকাংশ সময়ই সরকারের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ ওঠে যে, তারা কতিপয় নামজাদা বাণিজ্য সংস্থার স্বার্থরক্ষা করে চলেছে । পাশাপাশি জনগণ এটাও বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, এই সব বাণিজ্য সংস্থাই রাজনৈতিক দলের তহবিলে টাকা ঢেলেছে । পূর্বতন UPA সরকারের বিরুদ্ধে এরকমই কিছু বড় ও প্রভাবশালী শিল্পসংস্থার ঘনিষ্ঠ হওয়ার অভিযোগ উঠেছিল । যদিও ছ’বছর পরেও পরিস্থিতিতে বিরাট কোনও বদল আসেনি ।

সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিস সম্পাদিত এক সমীক্ষায় ফল বলছে, 2019 সালের লোকসভা ভোটে রাজনৈতিক দল এবং প্রার্থীরা সব মিলিয়ে অন্তত 60 হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছেন, যার ফলে এই নির্বাচন দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল নির্বাচন হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে । এর মধ্যে ভারতীয় জনতা পার্টি একাই বহন করেছে 45 শতাংশ ব্যয়ভার । এর থেকে স্পষ্ট যে, কীভাবে আর্থিক ক্ষমতা আগের থেকে আরও বেশি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে । রাজনৈতিক দলের প্রচারে কোনও প্রার্থীর তরফে সর্বোচ্চ 80 লক্ষ টাকা ব্যয় করার ঊর্ধ্বসীমা রয়েছে, কিন্তু নির্বাচনে দাঁড়ানো প্রায় প্রত্যেক পরিচিত প্রার্থীই সে নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখান । বর্তমানে গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থাই কোটিপতিদের অবাধ বিচরণক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে ক্ষমতা দখলের জন্য অর্থের বিরুদ্ধে অর্থেরই প্রয়োগ হয় । এ সবের জন্য রাজনৈতিক দল এবং প্রার্থীদের দায়ী করে গোটা ব্যবস্থায় যথাযথ নজরদারি আনতে এবং সমস্যা বিশ্লেষণ করে সমাধান খোঁজায় বর্তমান ব্যবস্থা চূড়ান্ত ব্যর্থ । আর ইলেকটোরাল বন্ডও এ ক্ষেত্রে কোনও কাজে আসেনি ।

নির্বাচনী বিধিব্যবস্থায় আমূল সংস্কার প্রয়োজন । পাশাপাশি রাজনৈতিক তহবিল পরিচালনার ক্ষেত্রেও দরকার স্বচ্ছতা । যে কোনও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুটি গুণ হল দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা এবং স্বচ্ছতা ৷ রাজনৈতিক তহবিল পরিচালনাও তার ব্যতিক্রম নয় । আইন লঙ্ঘনকারীদের যথাযথ শাস্তি দিতে পারবে, এমন কোনও পর্যাপ্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত সুনির্দিষ্ট নজরদারি সংস্থা না থাকলে, এ লক্ষ্য কখনও পূরণ করা সম্ভব নয় এবং সেক্ষেত্রে ভারতের নির্বাচনগুলি এমন এক পটভূমি হয়ে দাঁড়াবে, যেখানে শুধু তাদেরই রাজত্ব চলবে, যাদের অর্থ আছে । যাদের টাকার জোর নেই, তারা চিরকাল আড়ালেই থেকে যাবে।

ABOUT THE AUTHOR

...view details