পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / bharat

ডেভেলপমেন্ট ফিনান্স ইনস্টিটিউশন পরিকাঠামো তৈরির কাজে গতি বাড়াবে - Development Finance Institution will speed-up infra building

উদারীকরণের পর তিন দশক কেটে গিয়েছে । ভারত অবশেষে একটি আধুনিক আর্থিক বাজার তৈরিতে উদ্যোগী হয়েছে । যার সঙ্গে পর্যাপ্ত দীর্ঘমেয়াদী ঋণের ব্যবস্থাও থাকবে । এই উদ্যোগ যদি সাফল্য পায়, তাহলে একদিকে যেমন পরিকাঠামো তৈরিতে লাভ হবে, অন্যদিকে তেমনই আর্থিক ব্যবস্থায় এনপিএ-র ধাক্কার ঝুঁকি অনেকটাই কমবে ।

ডেভলপমেন্ট ফিনান্স ইনস্টিটিউশন পরিকাঠামো তৈরির কাজে গতি বাড়াবে
ডেভলপমেন্ট ফিনান্স ইনস্টিটিউশন পরিকাঠামো তৈরির কাজে গতি বাড়াবে

By

Published : Feb 4, 2021, 2:31 PM IST

1973 সালে মুক্তি পাওয়া হিন্দি ছবি ‘সওদাগর’-এ বাড়িতে তৈরি ‘গুড়’ বিক্রেতা অমিতাভ বচ্চন নূতনের গুরুত্ব তখনই বুঝতে পেরেছিলেন, যখন ক্রেতারা তাঁর তৈরি সামগ্রীকে নিতে অস্বীকার করেছিল । ওই সিনেমায় অমিতাভ সুন্দরী পদ্মা খান্নার জন্য নূতনের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ করেছিলেন ।

অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন ডেভলপমেন্ট ফিনান্স ইনস্টিটিউশন (ডিএফআই) -কে পুনরায় তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন । প্রাথমিক ভাবে 20 হাজার কোটি টাকা মূলধন হিসেবে বরাদ্দ করেছেন । আর এই জাতীয় আরও ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সংস্থাগুলির জন্য জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন । পরিকাঠামো ক্ষেত্রে অর্থ বিনিয়োগ ও আরও অনেক কিছুর জন্য এটাই সওদাগর মুহূর্ত ।

উদারীকরণের পর তিন দশক কেটে গিয়েছে । ভারত অবশেষে একটি আধুনিক আর্থিক বাজার তৈরিতে উদ্যোগী হয়েছে । যার সঙ্গে পর্যাপ্ত দীর্ঘমেয়াদী ঋণের ব্যবস্থাও থাকবে । এই উদ্যোগ যদি সাফল্য পায়, তাহলে একদিকে যেমন পরিকাঠামো তৈরিতে লাভ হবে, অন্যদিকে তেমনই আর্থিক ব্যবস্থায় এনপিএ-র ধাক্কার ঝুঁকি অনেকটাই কমবে এবং বিশেষত পেনশন তহবিল থেকে এফআইআই (বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী) আসার পরিমাণ বৃদ্ধি করবে ।

  • দাশমুন্সি সঠিক প্রমাণ করলেন

ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভলপমেন্ট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া (আইডিবিআই) আইন, 1964 সংসদ দ্বারা বাতিল হওয়ার আগে 2003 সাল পর্যন্ত ডিএফআই-গুলি ভারতের আর্থিক ব্যবস্থার একটি অংশ ছিল ।

আইডিবিআই ছিল প্রধান ডিএফআই । যা তখন আরও ২ টি বড় ডিএফআই এর নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করত । সেই ২ টি প্রতিষ্ঠান হল, ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফিনান্স কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (আইএফসিআই) এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিট অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (আইসিআইসিআই)। এছাড়া আরও কয়েকটি ছোট প্রতিষ্ঠান ।

1998 সালে যখন আরবিআইয়ের প্রাক্তন গভর্নর এম নরসিমহান এবং আইডিবিআইয়ের চেয়ারম্যান এস এইচ খানের নেতৃত্বে দুটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি মেয়াদী ঋণের উপর ডিএফআই-এর একাধিপত্য বাতিলের সুপারিশ করেছিল, তখনই এই সিদ্ধান্তের পূর্বাভাস ছিল ।

ওই প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে সরকার প্রথমে ব্যাঙ্কগুলিকে মেয়াদী ঋণ দেওয়া শুরু করার অনুমতি দেয় । আইসিআইসিআই এর সুযোগ নেয় এবং ব্যাঙ্ক চালু করে । আর তার পর তখন ডিএফআই নিয়ন্ত্রক আইন বাতিল হওয়া নিছক আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে থেকে গিয়েছিল ।

বিশেষজ্ঞরা যুক্তি দিয়েছিলেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটিও ডিএফআই ছাড়া কাজ চালিয়ে যাচ্ছে । কিন্তু সংসদে অন্তত একজন সাসংদ, কংগ্রেসের প্রয়াত প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছিলেন । তিনি চেয়েছিলেন সরকার এই বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে দেখুক । দুই দশক পরে দাশমুন্সিই সঠিক প্রমাণিত হলেন ।

  • গুরুতর ত্রুটি

ব্যাঙ্কিংয়ের ভাষায় মেয়াদী ঋণকে ‘স্যানস-রিকোর্স লোন’ বলা হয় । যার অর্থ হল, এমন ঋণ যেখানে ব্যালান্স-শিটের কোনও ভরসা থাকেন এবং তাই এই ঋণ ঝুঁকিপূর্ণ হয় । তবে এই ধরনের ঋণ ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে খুব বেশি আর্থিক সম্পদ ছাড়াই ক্ষুদ্র উদ্যোগপতিরা বড় লক্ষ্য অর্জন করতে পারেন । এই পথ বন্ধ করে দেওয়ার অর্থ ঋণ কেবল বড় গ্রুপগুলিকে এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্পকে দেওয়া হবে ।

একজন পেশাদার থেকে উদ্যোগপতি হওয়ার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হল হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস । গত এক দশকে কম পরিচিত ব্যবসায়ীদের দ্বারা বেশ কয়েকটি তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হয়েছে মেয়াদী ঋণের সুবিধা নিয়ে ।

সড়ক পরিকাঠামো তৈরিতে প্রয়োজনীয় বুট (বিল্ড-ওন-অপারেটর-ট্রান্সফার) প্রকল্পগুলির ক্ষেত্রেও মেয়াদী ঋণ জরুরি ।

একজন বুট ডেভলপার তাঁর দিক থেকে কোনও ভুল হলে, তা শুধরে দেওয়ার গ্যারান্টি দেন । তবে তিবি জমি অধিগ্রহণে দেরি বা যা হিসেব কষা হয়েছিল, তার থেকে কম টোল আদায় হল, তা নিয়ে তাঁকে কাঠগড়ায় তোলা যায় না । আর যদি অনুমান ভুল হয়ে যায়, তাহলে ঋণদানকারীর কাছে অর্থ পুনরুদ্ধারের খুব বেশি বিকল্প থাকে না ।

এই দীর্ঘ গল্পকে সংক্ষিপ্ত ভাবে বলতে গেলে মেয়াদী ঋণ হল একটি বিশেষ কাজ । ব্যাঙ্কিং খাতে উদারীকরণ ন্যায়সঙ্গত হওয়া সত্ত্বেও অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকার (1999-2004) এবং মনমোহন সিং সরকার (2004-2014) এই ধরনের বিশেষ ক্ষেত্রে জায়গা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছিল ।

দেশে দীর্ঘমেয়াদী বন্ডের বাজার নেই । ঋণ বৃদ্ধির উপর আরবিআই-এর নিষেধাজ্ঞা এই ধরনের বাজার তৈরির ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণমূলক বাধা তৈরি করছে । এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ড অর্গানাইজেশন (ইপিএফও), যা সমাজতান্ত্রিক নীতি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, তারা বাজারচালিত পেনশন তহবিলের বৃদ্ধিকে কঠিন করে তুলছে ।

ফলাফল ছিল বিপর্যয়কর । 2004 থেকে 2009 সালের মধ্যে ছোট আকারের ব্যাঙ্কগুলি মেয়াদী ঋণ দেওয়ার উন্মাদনায় যোগ দেয় । তারা সড়ক তৈরিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্বল্প-মেয়াদী (দুই থেকে তিন বছর) আমানত ব্যবহার করছিল, যেখানে টাকা ফেরত পেতে 15 বছরের বেশি সময় লাগে ।

এবং সড়ক তৈরির প্রকল্প জমি অধিগ্রহণে বিলম্বের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয় বা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি প্রত্যাশার মতো শুল্কে বেশি বিদ্যুৎ বিক্রি করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হয় । যিনি দেবেন, তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হলে, ডেভলপার ঋণ শোধ করতে পারেন । এর ফলে ব্যাঙ্কগুলিতে এনপিএ-র স্তূপ হতে থাকে ।

  • মেয়াদী ঋণ নয়

এর ফলে এখন ব্যাঙ্কগুলিতে অনেক নগদ অর্থ রয়েছে । কিন্তু তারা মেয়াদী ঋণ দেওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে । তারা শক্তিশালী ব্যালেন্স-শিট যুক্ত সংস্থাগুলির প্রকল্পের জন্যই টাকা দিচ্ছে । ব্যাঙ্কিংয়ের ভাষায় একে বলে কর্পোরেট ঋণ । নিশ্চিত ফেরতের জন্য নগদ নিরাপদে আরবিআই-এ রাখা থাকে ।

মোদি সরকার 2014 সালের শুরুতে পরিকাঠামো বৃদ্ধিতে জোর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয় । এই সমস্যার সমাধানে মোদি সরকার প্রথমে হাইব্রিড অ্যানুইটি মডেল (এইচএএম) অনুসরণ করার চেষ্টা করে । যেখানে বেসরকারি ক্ষেত্রের বুট ডেভলপারকে প্রস্তাবিত রাজস্বের একটি অংশ দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয় ।

তবে এই প্রচেষ্টাও ব্যাঙ্কগুলিকে প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয় এবং শেষ পর্যন্ত সরকার ইপিসি (ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রোকিওরমেন্ট ও কনস্ট্রাকশন) মডেল অনুসরণ করে । যেখানে ন্যাশনাল হাইওয়ে অথরিটি (এনএইচএআই) বা ন্যাশনাল হাইওয়ে অ্যান্ড ইনফ্রাস্টাকচার ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন (এনএইচআইডিসিএল) প্রকল্পগুলির অর্থায়ন হয়। বেসরকারি ক্ষেত্র ঠিকাদার হিসাবে কাজ করে ।

ভারতের আর্থিক ঘাটতি এবং পরিকাঠামো তৈরির বিপুল প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে বলা যায় যে এটা কোনও কার্যকরী মডেল নয় । কারণ, এনএইচএআই বা এনএইচআইডিসিএল-এর ব্যালেন্স শিটের ক্ষমতার জন্য তহবিল জোগাড় একটি নির্দিষ্ট সীমায় সীমাবদ্ধ করে ।

উন্নত দেশগুলি পরিকাঠামো উন্নয়নরে ক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহণের সমস্যার মধ্যে পড়ে না । তার উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি সমৃদ্ধ বন্ড বাজার আছে। অস্ট্রেলিয়ায় একটি সমৃদ্ধ প্রকল্প নগদীকরণ শিল্প রয়েছে ।

  • প্রকল্প নগদীকরণ

বাজেট প্রস্তাবনায় অর্থমন্ত্রী তিনটি ক্ষেত্রের দিকে নজর দিয়েছেন :

প্রথমত, সরকার এখন প্রকল্পের নগদীকরণের বিষয়টি তুলে ধরার পরিকল্পনা করেছে । এর অর্থ হল জাতীয় পরিকাঠামোর অংশ থেকে শেষ হয়ে যাওয়া প্রকল্পগুলি এই ক্ষেত্রে দেওয়া হবে এবং বেসরকারি সংস্থাকে নির্দিষ্ট পরিমাণ মূল্যের বিনিময়ে তা দেওয়া হবে । বেসরকারি সংস্থা ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে তা ফেরত দেবে ।

এর ফলে এনএইচএআই বা এনএইচআইডিএল এর মতো নির্বাহী সংস্থার ব্যালেন্স শিটকে খুলে দেওয়া যাবে এবং তাকে আরও জোরদার করা যাবে । যার ফলে তাদের ঋণ নেওয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে । এর ফলে ভবিষ্যতে পরিকাঠামো তৈরির কাজের গতিও বাড়বে । এটি একটি নতুন ধারণা এবং কার্যকরী হতে সময় নিতে পারে । তবে পদক্ষেপটি প্রশংসনীয় ।

সীতারমনও ঋণের বাজারকে আরও উন্নত হতে দেখতে সমান ভাবে আগ্রহী । যাই হোক এটা কিন্তু কোনও মসৃণ কাজ হতে যাচ্ছে না । শুরু করার জন্য তিনি ইনফ্রাস্টাকচার ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট এবং রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট তৈরির প্রস্তাব করেছেন, যা পোর্টফোলিও বিনিয়োগকারীদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করবে বলে আশা করা হচ্ছে ।

এই গুলি হল পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ এবং এই উদ্যোগের সাফল্য নির্ভর করছে নির্দিষ্ট শিল্পে নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থার উপর । টেকসই রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি এবং নীতিগত ধারাবাহিকতা মূল ভূমিকা পালন করবে ।

তবে সরকার একটি ডিএফআই তৈরি করার প্রস্তাব দিয়ে মেয়াদী ঋণের সংস্কৃতি এবং দক্ষতার পুনর্জাগরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে । বেসরকারি ক্ষেত্রগুলিকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে সরকার একাধিপত্য তৈরি করবে না, বরং সক্ষমতা তৈরিতে ভূমিকা নিতে আগ্রহী ।

এবং এটা এই মুহূর্তের সেরা খবর । সরকারের উপস্থিতি ঋণে সংস্কৃতিকে নষ্ট করে দেয় এবং সরকারি ব্যাঙ্কগুলি (পিএসবি) এর আদর্শ উদাহরণ ।

এদিকে পিএসবি-গুলির একত্রীকরণ মেয়াদী ঋণ দেওয়ার সুযোগও তৈরি করবে । স্টেট ব্যাঙ্ক এই ক্ষেত্রে দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে । সরকার এখন সঠিক পরিবেশ তৈরির দিকে মনোনিবেশ করেছে । এর ফলে বড় ব্যাঙ্কগুলির জড়তা ঢেকে যেতে পারে এবং তৈরি হওয়া সুযোগ কাজে লাগাতে পারে ।

(লিখেছেন প্রতীমরঞ্জন বোস । লেখক কলকাতার একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক । মতামত লেখকের নিজস্ব ।)

For All Latest Updates

TAGGED:

ABOUT THE AUTHOR

...view details