মুম্বই, 7 নভেম্বর :
সম্প্রতি ভারতের অন্যতম বড় শহুরে সমবায় ব্যাঙ্ক পঞ্জাব ও মহারাষ্ট্র সমবায় ব্যাঙ্ক (PMC)-এর দুর্নীতি সামনে আসায় এ দেশে সমবায় ব্যাঙ্কগুলোর কার্যকলাপের উপর নতুন করে নজর পড়েছে । PMC থেকে নগদ তোলার উর্ধ্বসীমা বেঁধে দিয়েছে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক (RBI)। স্বভাবতই ব্যাঙ্কের গ্রাহকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে মারাত্মক আতঙ্ক । অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে, শেষ কয়েক সপ্তাহে চার জন গ্রাহকের মৃত্যু হয়েছে । দেশের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং তা যথেষ্ট স্থিতিশীল, তা দেশের জনগণকে ফের বোঝানোর দায়িত্ব এখন রিজার্ভ ব্যাঙ্কেরই । এই অবস্থায় তাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এই জাতীয় ব্যাঙ্কগুলির বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যতে এরা কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে তার পর্যালোচনা করা।
বর্তমান অবস্থা ও চ্যালেঞ্জ
দেশের মানুষের একটা বড় অংশকে, বিশেষ করে যে সব জায়গায় ব্যাঙ্কিং পরিষেবা উন্নত নয় বা বাসিন্দাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই, তাঁদের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা থাকে এই সব সমবায় ব্যাঙ্কের । ভারতে সমবায় ব্যাঙ্কের ইতিহাসটা কিন্তু বেশ পুরনো । গ্রামের ঋণগ্রহীতাদের কথা ভেবে ১৯ শতকের গোড়ায় সমবায় ব্যাঙ্কের পথ চলা শুরু । মূলত ছোট ব্যবসায়ী ও কম পরিমাণে অর্থের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কাজ করত এই ব্যাঙ্কগুলি। গ্রাহকরা এই ব্যাঙ্কগুলির দিকে আকৃষ্ট হতেন উচ্চ সুদের হার ও ব্যক্তিগত মনোযোগের জন্য । ২০১৮ সালের হিসেব অনুযায়ী, দেশে এক হাজার ৫৫১টি শহুরে সমবায় ব্যাঙ্ক (UCB) এবং ৯৬ হাজার ৬১২টি গ্রামীণ সমবায় ব্যাঙ্ক রয়েছে । গ্রামীণ ব্যাঙ্কগুলি যেখানে গ্রাম এবং ছোট মফস্বলগুলিতে পরিষেবা দিয়ে থাকে, UCB গুলি শহর ও আধা শহর এলাকাগুলিতে কাজ করে । তবে সমবায় ব্যাঙ্কগুলির বৃদ্ধির হার ব্যাঙ্কিং সেক্টরের সার্বিক বৃদ্ধির সঙ্গে একেবারেই তুলনীয় নয় । ২০১৭ সালের হিসেব অনুযায়ী এই ব্যাঙ্কগুলি নথিভুক্ত বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির মোট সম্পদের ১১ শতাংশ । ২০০৪-০৫ সালে যা ছিল ১৯ শতাংশ।
২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের একটি রিপোর্টে বর্তমানে দেশের সমবায় ব্যাঙ্কগুলির অবস্থা সম্বন্ধে বলা হয়েছে । গ্রামের সমবায়গুলির ক্ষেত্রে পারফরম্যান্স অনেকটাই নির্ভর করেছে ব্যাঙ্কের মোট সম্পদের পরিমাণ এবং এবং লাভের উপর । রাজ্য সমবায় ব্যাঙ্কগুলি অনুৎপাদক সম্পদের পরিমাণ কমিয়ে লাভ বাড়াতে পারলেও এই দুই ক্ষেত্রেই হতাশ করেছে জেলা সমবায় ব্যাঙ্কগুলি (DCCB)। কৃষিক্ষেত্রে কাজ করা সমবায় ব্যাঙ্কগুলির আর্থিক বৃদ্ধিও একেবারেই সন্তোষজনক নয় ।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট অনুযায়ী, শহুরে সমবায় ব্যাঙ্কগুলি তাদের মোট সম্পদের পরিমাণ বাড়াতে সক্ষম হলেও খুব একটা বেশ লাভ করতে পারেনি । এক হাজার ৫৫১টি এই ব্যাঙ্কের মধ্যে ২৬টির ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং ৪৬টিতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে । শহুরে সমবায় ব্যাঙ্কগুলিতে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগও সামনে এসেছে । যেমন মাধবপুরা সমবায় ব্যাঙ্ক । ২০০১ সালে গুজরাতের এই ব্যাঙ্কের দুর্নীতির বিষয়টি সামনে আসে । বিষয়টি আরও চাঞ্চল্য ছাড়ায় যখন জানা যায়, এই ব্যাঙ্কের মোট সম্পদের একটা বড় অংশ ঋণ হিসাবে স্টক ব্রোকার কেতন পারেখকে দেওয়া হয়েছে । PMC-এর বর্তমান দুর্নীতিতে তিনটি সমস্যা সামনে এসেছে— (১) বড়সড় আর্থিক অমিয়ম, (২) ব্যাঙ্কের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কাজ না করা, (৩) ব্যাঙ্কের কাজকর্ম সম্পর্কে ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়া । PMC যে নিজেদের মোট সম্পদের ৭৩ শতাংশ হাউজ়িং ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড (HDIL) কে দিয়েছে, এ কথা এখন অনেকেই জানেন । রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নজরদারি এড়াতে ২১ হাজার ভুয়ো অ্যাকাউন্ট খুলেছে PMC। আবাসন ক্ষেত্রে জালিয়াতি থেকে নজর ঘোরাতে এই বিপুল পরিমাণ ভুয়ো অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা হত ।
১৯৬৬ সালে সমবায় ব্যাঙ্কগুলি সরাসরি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নজরদারিতে আসে । কিন্তু এ ক্ষেত্রে দ্বৈত নথিভুক্তির সমস্যা দেখা দেয় । শহুরে সমবায় ব্যাঙ্কগুলিকে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ছাড়াও একটি রাজ্যে কাজ করার জন্য স্টেট রেজিস্ট্রার্স অব কোঅপারেটিভ সোসাইটিজ (RCS) এবং একাধিক রাজ্যে কাজ করতে সেন্ট্রাল রেজিস্ট্রার অব কো-অপারেটিভ সোসাইটিজ (CRCS)-এ নাম নথিভুক্ত করতে হয় । ব্যাঙ্কগুলির নির্বাচন-সহ একাধিক প্রশাসনিক কাজ দেখভাল করে RCS । রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আওতায় রয়েছে ব্যাঙ্কগুলির লাইসেন্স, নগদ ও খুচরো অর্থের পরিমাণ এবং নজরদারি । কিন্তু বিশেষজ্ঞ-সহ অনেকের দাবি, এই ব্যাঙ্কগুলোর উপর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ততটা নিয়ন্ত্রণ নেই যতটা রয়েছে বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোর উপর । এর প্রধান কারণ অবশ্যই দ্বৈত নিয়ন্ত্রণের সমস্যা ।
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক লাইসেন্স পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনায় ১৯৯৩ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত শহুরে সমবায় ব্যাঙ্কের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে । এর পরই ব্যাঙ্কিংয়ের এই ক্ষেত্রের সমস্যাগুলো প্রকট হওয়া নতুন লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক । বদল আনা হয় বেশ কিছু নীতির ক্ষেত্রেও । দুর্বল অথচ সম্ভাবনাময় বেশ কিছু ব্যাঙ্ককে সংযুক্ত করা হয় । বেশ কিছু দুর্বল ব্যাঙ্ক বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয় । নীতির পরিবর্তন, নজরদারি বৃদ্ধি হলেও এই সব ব্যাঙ্কগুলির ক্ষেত্রে বড় সমস্যা দুর্বল প্রশাসন, পেশাদারিত্বের অভাব এবং প্রযুক্তির অব্যবহার । বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি ব্যবসা বাড়ানোর ফলে এবং প্রযুক্তির কম ব্যবহারে দৌড়ে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে সমবায় ব্যাঙ্কগুলি । এই ব্যাঙ্কগুলিকে কড়া টক্কর দিচ্ছে পেমেন্ট ব্যাঙ্ক, ছোট আর্থিক ব্যাঙ্ক এবং অ-ব্যাঙ্ক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি (NBFC)। সমস্যা রয়েছে মূলধনের ক্ষেত্রেও । শহুরে সমবায় ব্যাঙ্কগুলি শেয়ার ছেড়ে বাজার থেকে টাকা তুলতে পারে না ।
সমবায় ব্যাঙ্কগুলির প্রধান সমস্যা হল, এদের নিয়ন্ত্রণ করা বোর্ড কখনওই পেশাদার হয় না । উপরন্তু কোনও ক্ষেত্রে তা রাজনৈতিক নেতাদের ইচ্ছায় গঠিত হয় । এই ব্যাঙ্কগুলোর মাধ্যমে ঋণ দেওয়া, বা এখানে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার মতো কাজগুলো অনেক নেতাই করে থাকেন ।