দিল্লি, 2 এপ্রিল : ভারত এবং বিদেশে থাকা ভারতীয়দের মধ্যে সম্পর্ক আজ একটা অভূতপূর্ব অবস্থার মধ্যে এসে পৌঁছেছে । সৌজন্যে কোরোনা ভাইরাস । মা ভারতে রয়েছেন ৷ লকডাউনের জন্য দেশে ফিরতে পারছেন না ছেলে ৷
এই ভাইরাস সারা বিশ্বকে, বিশেষ করে যে সব দেশে ভারতীয়রা কাজ করেন এবং যে সব দেশে তাঁদের প্রভূত উন্নতি হয়েছে, সেখানেই এই ভাইরাসের প্রকোপ যেন সবচেয়ে বেশি । সারা বিশ্বকে শাসিয়ে চলেছে এই ভাইরাস । দাতা এবং গ্রহীতা হিসাবে ভারত এবং বিদেশে থাকা বিপুল ভারতীয় এবং ভারতের মধ্যে সম্পর্কটা ঠিক উল্টে যেতে পারে যদি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তিন কোটি ভারতীয় দাতার ভূমিকা থেকে সাহায্যের জন্য ভারতের ভারতের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে । বঞ্চনা আর দুর্দশার সীমা থাকবে না যদি এই সুবিশাল ভারতীয় জনসংখ্যার জীবন বিপন্ন হয় । যতক্ষণ পর্যন্ত করোনা ভাইরাসের প্রকোপ কমানো যাচ্ছে এবং বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, ততক্ষণ ভারতের ঘারে বিপুল দায় থেকে যাবে ।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পরিমাণ কমে যাওয়ায় বাইরে থেকে খুব বেশি সাহায্যের প্রত্যাশা করা ভারতের উচিত হবে না । চিনের একগুঁয়ে মনোভাবের সামনে রাষ্ট্রপুঞ্জও কেমন যেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছে । মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উগ্র জাতীয়তাবাদের সামনে যাদের দিকে বিশ্বের প্রায় সব দেশের নজর ছিল, সেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যদের আচরণও কেমন যেন অন্তর্মুখী । তারা যেন সব দেশকে নিজেদের বিষয়টা নিজেদেরই বুঝে নিতে বলছে । সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কোঅপারেশন (SAARC), G-20 এবং G-7-এর দূর নিয়ন্ত্রিত বৈঠকগুলিও এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কোনও সুস্পষ্ট পরিকল্পনার কথা শোনাতে পারেনি ।
উচ্চমানের অভিবাসীদের নিয়ে গর্ব করা ভারতের কাছে এই ভাইরাস মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, বিশ্বের বহু প্রাচীন এবং বিখ্যাত রাজত্ব আপন সম্পদ, গরিমা এবং দায়িত্বের চাপে ভেঙে পড়েছিল। বিদেশে থাকা ভারতীয়রা চিরকালই প্রযুক্তি, অর্থ এবং মেধার আকর। ভারতীয় অর্থনীতি যে দিন থেকে উদার হয়েছে এবং অত্যন্ত দ্রুত গতিতে এগিয়ে যেতে শুরু করেছে, সে দিন থেকে উন্নত দেশে থাকা আধুনিক অভিবাসী এবং পশ্চিম এশিয়ায় থাকা বিপুল সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক ভারতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসাবে সামনে এসেছে। তিন কোটি অভিবাসীর দুর্দান্ত সম্পদ ভারতের GDP-কে টপকে গিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে এই অভিবাসীরা ভারতকে বহু সাহায্য করেছে।
ভারতের এই অভিবাসী ‘সাম্রাজ্য’-এর বৃদ্ধির দিকে যদি নজর দেওয়া হয়, তা হলে দেখা যাবে যে, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে যাওয়ার জন্য এক ‘পরিযায়ী ঢেউ’ উঠেছে যার বেশির ভাগটাই ছিল অসংগঠিত অথবা বিশেষ কোনও কারণে। ভাল চাকরি বা ভাল ভবিষ্যতের আশায় এবং ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় বহু বার বহু ভারতীয় উন্নত দেশে গিয়েছেন। এক সময় এই বিষয়টাকে ‘ব্রেন ড্রেন’ হিসাবে দেখা হত। কিন্তু পরে দেখা গিয়েছে যে, এতে ভারতের উপকারই হয়েছে কেন না এ দেশে মেধাসত্বের কোনও অভাব ছিল না। বেশ কিছু বাধা সত্ত্বেও আমেরিকায় যাওয়ার সুযোগ পেয়ে বহু ভারতীয় পেশাদার সে দেশে চলে যান এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রভূত উন্নতি করেন। প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সে দেশে ভারতীয়ের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। আমেরিকায় প্রযুক্তি আর ভারতীয় প্রায় সমনাম হয়ে যায়। এই ভারতীয়রা কখনই কোনও জাতীয় পরিকল্পনার অংশ হননি। দেশের বিভিন্ন প্রকল্পের সঙ্গে খুব অল্প সংখ্যক অভিবাসীই যুক্ত।
পশ্চিম এশিয়ায় অর্ধ প্রশিক্ষিত এবং প্রশিক্ষিত শ্রমিকদের সংখ্যা বৃদ্ধিতেও ছিল না কোনও আগাম পরিকল্পনা। এমনকি অভিবাসীদের সংখ্যার এই বৃদ্ধি ছিল আশাতীতও। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা এবং কিছু বিবেকহীন দালালের মাধ্যমে এই বিশাল ভারতীয় শ্রমিক শ্রেণি বেড়ে ওঠে। কিন্তু দালালের অত্যাচার এবং আরও কিছু বাধা অতিক্রম করে এই ভারতীয় পরিযায়ী শ্রমিক শ্রেণির একটা বড় অংশ যা আয় করতেন, তা দেশের আয়ের চেয়ে অনেকটাই বেশি ছিল। এই সংখ্যাটা ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং এঁরা বিদেশ থেকে অর্থ রোজগার করে দেশে এনে ভারতীয় অর্থনীতির উপকার করতে থাকেন। এই অর্থের আবার অনেকটা অংশ নষ্ট হয় পরিকল্পনাহীন বিনিয়োগের ফলে এবং দীর্ঘকালীন বিনিয়োগের অভাবে। পরিযায়ীদের বেশ কয়েক জন আবার যথেষ্ট সম্পদের মালিকও হয়ে ওঠেন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এর ফলে উন্নত মানের চাকরিও তৈরি হতে থাকে। পশ্চিম এশিয়া থেকে পাওয়া এই ‘লটারি’র সঠিক অর্থ ধীরে ধীরে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলো বুঝতে শুরু করে এবং দুই পক্ষের মধ্যে একটা অদৃশ্য সমঝোতা তৈরি হয়। এই সব ভারতীয়ের কঠিন পরিশ্রম এবং সুনামের জোরে ভারতের সঙ্গে পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির সম্পর্কে উন্নতি হতে শুরু করে।
এই অভিবাসীদের জন্য হৃদয়ের দরজা খুলে দেয় ভারতও। বিদেশে এই ভারতীয়দের জন্য যতটা সম্ভব সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি দিল্লি এবং রাজ্যের রাজধানীগুলোতে আয়োজিত হতে থাকে প্রবাসী দিবস এবং প্রবাসী সম্মান। তাঁদের যতটা সম্ভব সমস্যা দূর করতে সচেষ্ট হয় সরকার। পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সহযোগিতার একটা সম্পর্ক তৈরি হয় সরকার এবং এই অভিবাসীদের মধ্যে। সরকারি মধ্যস্ততায় ধনী পরিযায়ীরা এ দেশে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। প্রবাসী ভারতীয় নেতাদের দলে টানতে এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে অদৃশ্য প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়। এই প্রবাসীরা দলগুলিকে অর্থ সাহায্য করতেন এবং বিনিময়ে কিছু সুবিধা পেতেন। যখনই আইন এই প্রবাসীদের দেশে ফিরতে বাধ্য করেছে, তখনই হয় সরকার মাঝখানে এসে তাঁদের সে দেশেই থাকার ব্যবস্থা করেছে, না হলে ঋণ বা অনুদান দিয়ে দেশে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
অন্য কথায় বলতে গেলে, পশ্চিম এশিয়ায় থাকা ভারতীয়রা ভারতের উন্নতিতে অংশ নিয়েছে এবং এর বিনিময়ে রাষ্ট্রের দেওয়া সুযোগ সুবিধা নিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যখনই প্রবাসীরা সমস্যায় পড়েছেন, তখনই এ দেশের সরকার এগিয়ে এসেছে। এই নীতি কিন্তু আগে অনেকটাই আলাদা ছিল। তখন বর্মা, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ বা উগান্ডার মতো দেশে যাওয়া ভারতীয়দের ক্ষেত্রে সরকার হাত গুটিয়ে বসে থাকত। এই নীতির পরিবর্তন আসে ১৯৮৮ সাল নাগাদ, যখন ফিজিতে ভারতীয়দের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী হামলা চালায় এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী কমনওয়েলথ থেকে সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকারকে বহিষ্কার করেন।